সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক (Central African Republic) ইতিহাস ও নামকরণ

ড. মোহাম্মদ আমীন

সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক  (Central African Republic)

‘অ্যাফ্রি’ একটি ল্যাটিন শব্দ। শব্দটি বর্তমান আফ্রিকা মহাদেশের অধিবাসীদের চিহ্নিত করার জন্য ব্যবহার করা হতো। এর দ্বারা মেডিটেরিনিয়ানের দক্ষিণে অবস্থিত সমগ্র ভূম-ল বা প্রাচীন লিবিয়াকে বুঝানো হয়। ইতিহাসবেত্তাদের অভিমত, স্থানীয় লিবিয়ান উপজাতির নাম হতে আফ্রি নামের উৎপত্তি। ‘আফ্রি’ ছিল প্রাচীন লিবিয়ার একটি জনবহুল ও প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী। অনেকে মনে করেন, আফ্রি শব্দের উৎপত্তির সঙ্গে হিব্রু আফার শব্দের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। হিব্রু আফার শব্দের অর্থ ধুলা বা ডাস্ট। কিন্তু ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের কিছু আবিষ্কার এ ধারণাটি প্রমাণ করে যে, বার্বার (ইবৎনবৎ) ভাষার শব্দ ইফ্রি হতে আফ্রিকান বা আফ্রিকা নামের উদ্ভব। ইফ্রি শব্দের বহুবচন ইফ্রান, এর অর্থ গুহা। যদ্বারা গুহাবাসী বুঝান হতো। আলজেরিয়া ও ত্রিপোলিতানিয়ার ‘বানু-ইফ্রান’ (Banu Ifran) একই শব্দের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। উল্লেখ্য, বার্বার উপজাতির লোকেরা প্রাচীন লিবিয়ার উত্তর-পশ্চিমাংশে বাস করত।

প্রাচীন রোমন ইতিহাস অনুসারে জানা যায়, আফ্রিকা পশ্চিম মিশরের অংশ এবং এশিয়া দ্বারা আনাতোলিয়া ও পূর্বের দেশসমূহ নির্দেশ করত। ভৌগোলবিদ টলেমি (৮৫-১৬৫ খ্রিস্টাব্দ) প্রাইম মেরিডিয়ানের  মধ্য দিয়ে আলেজেন্দ্রিয়া হতে সুয়েজ ও লোহিত সাগরকে সীমাবিন্দু ধরে আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের মধ্যে একটি সুনির্দিষ্ট সীমারেখা নির্দেশ করেছিলেন।

প্রথম শতকের ইহুদি ইতিহাসবেত্তা ফ্লাভিয়াস যোশেফাস (Flavius Josephus) লিখেছেন, জেন. ২৫.৪ অনুসারে নবি আব্রাহামের (আরবিতে ইব্রাহিম) এক দৌহিত্রের নাম ছিলেন ইফার। তার এক উত্তরসুরী লিবিয়া আক্রমণ করে বিশাল এক অঞ্চল নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসেন এবং এলাকাটির নাম দেন ইফার। কথিত হয়, আব্রাহামের দৌহিত্র ইফার নাম হতে, আফ্রিকা নামের উদ্ভব। ইটোমোলোগিয়ায় ইসডোর অব সেভাইল লিখেছেন, ল্যাটিন শব্দ আপ্রিকা (aprica) হতে আফ্রিকা নামের উদ্ভব। ল্যাটিন ভাষায় আপ্রিকা শব্দের অর্থ ছিল সানি বা রোদ্রময়। অঞ্চলটিতে বৃষ্টি কম ছিল। মেঘও থাকত না। প্রায় সময় রোদ্র থাকতো। তাই নাম হয় আফ্রিকা।

১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে ম্যাসে উল্লেখ করেছেন যে, মিশরীয় (af-rui-ka) আপ-রুই-কা হতে আফ্রিকা শব্দের উদ্ভব। কা (Ka-উন্মুক্ত হওয়ার দিকে ঘোরা বা ফেরা (to turn toward the opening of the Ka)। এখানে ‘কা (কধ)’ শব্দ দিয়ে ব্যক্তির শক্তিমত্তা ও খোলা গর্ভ বা জন্মস্থান ইঙ্গিত করা হয়েছে। এর অর্থ আফ্রিকা মিশরীয়দের জন্মস্থান। আফ্রিকা নামের উৎপত্তির সঙ্গে আর একটি কিংবদন্তি রয়েছে। মিচেল ফ্রুইটের (Michèle Fruyt) মতে ল্যাটিন শব্দ আফ্রিকাস (africus) হতে আফ্রিকার উদ্ভব। ল্যাটিন আফ্রিকাস অর্থ দখিনা-বায়ু। এ দখিনা বায়ু ছিল বৃষ্টির বাহন এবং বৃষ্টির বাহন হিসাবে সবুজ, জীবন ও সমৃদ্ধির উৎস। তাই আফ্রিকাস শব্দের প্রকৃত অর্থ ছিল বৃষ্টিবাহক বায়ু (rainy wind)। আধুনিক সেন্ট্রাল আফ্রিকা নামে পরিচিত এলাকাটি আফ্রিকা মহাদেশের মাঝামাঝি অবিস্থত বলে এর নাম সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক রাখা হয়।

সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের মোট আয়তন ৬,২২.৯৮৪ বর্গকিলোমিটার বা ২,৪০,৫৩৪ বর্গমাইল। তন্মধ্যে জলীয় ভাগের পরিমাণ প্রায় শূণ্য। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের হিসাবমতে, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের মোট জনসংখ্যা ৪৭,০৯,০০০ এবং প্রতি বর্গকিলোমিটার লোকসংখ্যা ৭.১ জন। আয়তন বিবেচনায় সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক পৃথিবীর ৪৫-তম বৃহত্তম দেশ এবং জনসংখ্যা বিবেচনায় ১১৯-তম। কিন্তু জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় পৃথিবীর ২২৩-তম জনবহুল দেশ। জনসংখ্যার ৮০.৩% খ্রিস্টান এবং ১৫% মুসলিম। এছাড়া অন্যন্য স্থানীয় ধর্মবিশ্বাসে অনুসারীও কিছু রয়েছে।

২০১৪ খ্রিস্টাব্দের হিসাবমতে, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের জিডিপি (পিপিপি) ২.৫৭৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ৫,৪৭ ইউএস ডলার। অন্যদিকে, জিডিপি (নমিনাল) ১.৬৮৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু ৩৫৮ ইউএস ডলার। মুদ্রার নাম ফ্রাঙ্ক। রাজধানী বাঙ্গুই। সরকারিভাবে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের অধিবাসীদের সেন্ট্রাল আফ্রিকান বা মধ্য-আফ্রিকান বলা হয়। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ১৩ আগস্ট ফ্রান্স হতে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর সেন্ট্রাল আফ্রিকান সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ সেপ্টেম্বর প্রজাতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১ ডিসেম্বর বর্তমানে ব্যবহৃত পতাকাটি গ্রহণ করা হয়। দেশটির সরকারি ভাষা সাঙ্গু ও ফ্রেঞ্চ।

সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের অধিকাংশ এলাকা সমতল এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ১,৬৪০ ফুট উচুতে অবস্থিত ঘুর্ণায়মান মালভূমি বা বৃক্ষহীন ঘাসময় প্রান্তর। এটি একটি কৃষিপ্রধান দেশ। কাসাভা, চিনাবাদাম, ভূট্টা, জোয়ার, বাজরা, তিল ও কলা অন্যতম অর্থকর ফসল।

ক্যামেরুন

Language
error: Content is protected !!