ড. মোহাম্মদ আমীন
সংস্কৃত ‘স্বর্ণ’ থেকে উদ্ভূত ‘সোনা’ অর্থ— বাতাস জল বা অ্যাসিডের সংস্পর্শে অক্রিয় থাকে এবং উত্তম বিদ্যুৎ পরিবাহী উজ্জ্বল হলুদাভ ঘাতসহ মৌলিক ধাতুবিশেষ যার পারমাণবিক সংখ্যা ৭৯, স্বর্ণ। এটি অত্যন্ত দামি এবং শক্ত একটি ধাতু। সোনার বাজার খুব চড়া। একসময় স্বর্ণমুদ্রা প্রচলিত ছিল। দামি হলেও অনেকে সোনা চাই না। কবির ভাষায়: সোনাদানা চাইনা আমি সোনাদানা বন্ধুরে- – -। প্রেমিক-প্রেমিকার আবেগে এত কঠিন ধাতু সোনাটাও কোনো তাপ ছাড়া শুধু আবেগে তরল ধাতু হয়ে যায়। প্রেমিকের কাছে প্রেমিকা এবং প্রেমিকার কাছে প্রেমিক হরদম সোনা। কবি উজাড় করে গান: একটা ছিল সোনার কন্যা মেঘ বরণ কেশ- – -।
কবি-সাহিত্যিকের কাছে দামি ধাতু না হয়েও অনেক কিছু সোনা হয়ে যেতে পারে— এমনকি মাটিও। যেমন: “ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি- – -।” সুতরাং, মাটিও সোনা। মাটি নিয়ে দেশ, দেশ নিয়ে মাটি। দেশকে সোনা বানিয়ে কবি গেয়েছেন:
“সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা সোনা নয় তত খাঁটি,
বলো যত খাঁটি তার চেয়ে খাঁটি বাংলাদেশের মাটি রে—
আমার বাংলাদেশের মাটি— আমার জন্মভূমির মাটি।”
বাংলাদেশে সোনা নামের যত স্থান আছে আর কোনো ধাতু নিয়ে তার এক ভাগও নেই। যেমন: সোনাপুর, সোনাদিয়া, সোনাখাড়া, সোনাচর। স্থানের মতো ব্যক্তি নামেও সোনার একচেটিয়া প্রাধান্য: সোনা মিয়া, সোনভান, সোনা বানু, সোনা খাতু, সোনা বিবি, সোনা আলী- – -।
মাটি আর দেশ প্রিয়জনের আবাস। তাই প্রিয়জনও সোনা।নাম যাই হোক, প্রিয়জনকে সোনা বলে ডাকেননি কিংবা প্রিয়জনের কাছে সোনা ডাক শুনেননি এমন সোনা মানুষ বিরল। তাই বাংলার সব মানুষই কারও না কারও কাছে সোনা। আমার সোনা যাদুমণি আয়রে আয়- – -।
অভিধানে স্বর্ণের একটি আলংকরিক অর্থ আছে। সেটি হচ্ছে: আদরের ধন। অতি প্রিয় কাউকে, বিশেষ করে সন্তান-সন্ততিদের আদর করে সোনামণি ডাকা হয়। যেমন: সোনামণি যাদুমনি আয়রে আয়– – -। আদরের সন্তানকে কী আদর করে ডাকা হয়— আমার সোনা, লক্ষ্মী সোনা; খাঁটি সোনায় অঙ্গ বোনা। প্রেমিকার আসল রং যাই হোক, প্রেমিকের কাছে সে সোনা: সোনার বরণি মেয়ে বলো কার পথ চেয়ে আঁখি দুটি উঠে জলে ভরিয়া- – -।
শুধু মানুষ নয়, মানুষের ভাষায় কোনো কোনো পাখিও সোনা হয়ে যায়। *সোনার বাংলাদেশের ময়নাও সোনা। কবির ভাষায়: আমার সোনার ময়না পাখি- – -। সোনা পাখি তো আর যেমন তেমন পিঞ্জরে থাকতে পারে না, তাই রবীন্দ্রনাথ পাখির জন্য বানিয়েছেন সোনার পিঞ্জর: “সোনার পিঞ্জর ভাঙিয়ে আমার প্রাণের পাখিটি উড়িয়ে যাক।”
স্বর্ণের অলংকারকেও বলা হয় সোনা। কানে সোনা, নাকে সোনা, চুলেও সোনা, পায়েও সোনা। কোমড়ের বিছার কথা বাদই দিলাম— ও আমার রসিয়া বন্ধুরে, তুমি কেন কোমড়ের বিছা হইলা না।
বিশেষণে সোনা শব্দের অর্থ সোনালি রঙ— হলুদিয়া পাখি সোনারই বরণ পাখিটা ছাড়িল কে?
আর একটি সোনা আছে। এটি খাঁটি সোনার চেয়েও খাঁটি। এর অর্থ অভিধানে পাওয়া না-গেলেও আঞ্চলিক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত। পুরুষাঙ্গ, বিশেষ করে শিশুদের শিশ্নও সোনা নামে পরিচিত।এটিও সৃষ্টির চিরন্তন অনবদ্যতা— সৃষ্টি ও জ্ঞানের উৎস।
সোনা শুধু সোনা, অলংকার, সোনাদানা বা উদ্ভিদ নয়, দেশের নামও হয় সোনা। যেমন : সোনার বাংলা। ধনধান্য পুস্পভরা আমার দেশ সোনার বাংলা নামে পরিচিত।এর দ্বারা দেশের দাম, মূল্য, সমৃদ্ধি ও দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা হয়। আমাদের জাতীয় সংগীতে দেখুন সোনার আধিপত্য : আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
শীতকালে বাংলাদেশে চাষ করা হয় এবং বসন্তকালে ফোটে এমন হলুদাভ ফুল ও সোনালি বহুবীজযুক্ত ভেষজগুণসম্পন্ন শুঁটি বা তার বীরুৎশ্রেণির বর্ষজীবী একটি উদ্ভিদ আছে, যার নাম সোনামুগ। লতাও সোনা হয়। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে জাত এবং শীতকালে ফোটে এমন গুচ্ছবদ্ধ সাদা সুগন্ধ ছোটো ফুল বা তার পত্রহীন শাখাপ্রশাখাবিশিষ্ট ভেষজগুণসম্পন্ন উজ্জ্বল সোনালি রঙের পরজীবী লতানো এক প্রকার উদ্ভিদের নাম সোনালতা। আর একটি উদ্ভিদের নাম সোনালু। সোনা হোক বা না হোক, সোনার মতো রং যার তাকে বলা হয় সোনালি। যেমন : সোনালি ধান।
আবার সোনার মতো রঙ না হয়েও কোনো বস্তু সোনালি হয়ে যেতে পারে। যেমন : সোনালি আঁশ। সোনাখাড়া নামের একটি ধানও আছে। এই নামের একটি স্থানও আছে বাংলাদেশে। এই গেল কয়েকটি সোনার কয়েকটি কথা। এখানেই কিন্তু শেষ নয়, আরও আছে সোনা। কোনো জিনিস যখন সোনার মতো মূল্যবান মনে করা হয় কিংবা অলংকার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তখন তা সোনা না হলেও সোনার খ্যাতি পেয়ে যায়। যেমন: হ্যান্ড স্যানিটাইজার এখন সোনা।
————————————————————–