ড. মোহাম্মদ আমীন
ঊনিশ নিরানব্বই।
সন্ধ্যা ছটায় অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের তিন নম্বর কক্ষে উঠি।
বান্দরবান থেকে টেলিফোনে কক্ষটা সংরক্ষণ করেছিলাম। রাত আটটায় ডা. শংকর সাহার চেম্বারে যেতে হবে। খুব ব্যস্ত ডাক্তার তিনি। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর সস্ত্রীক ডাক্তারের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলাম। চেম্বার বেশি দূরে নয়, তবে ভীড়, যেমন রাস্তায় তেমন চেম্বারে। প্রয়োজনীয় কাজ সেরে সার্কিট হাউজে ফিরতে ঘড়ির কাঁটা দশটা পাড় হয়ে যায়।
রুমের চাবি চাইতে কেয়ার টেকার আমতা আমতা করে বললেন : সরি স্যার, চাবি দেওয়া যাবে না।
আমি বললাম : কেন?
কেয়ার টেকার বললেন : আপনার কক্ষের বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে।
লজ্জা এবং ভয়ে আঁতকে উঠে বললাম : কেন?
: আগামীকাল এডিসি জেনারেল সাহেবের আত্মীয়ের বিয়ে।
: তাতে কী?
: বর যাত্রীদের জন্য সার্কিট হাউসের সাধারণ কক্ষগুলি তিনি দখল করে নিয়েছেন। ভিআইপি ছাড়া কোনো কক্ষ আপাতত খালি নেই।
: এত রাতে কোথায় যাই বলুন তো!
: আজ দুইজন মন্ত্রী আসবেন নইলে আমি আপনাকে ভিআইপি রুমে হলেও রাখার ব্যবস্থা করতাম। কিছু মনে করবেন না স্যার।
কেয়ার টেকারের সহানুভূতিতে মনটা ভরে উঠল। কিন্তু তিনি কেয়ারটেকার মাত্র। তার রুম বরাদ্দের অধিকার নেই।
বললাম : এডিসি সাহেবকে আমার স্ত্রীর অসুস্থতার কথা বলেন নি?
: বলেছি।
এত রাতে কোথায় যাব? মনটা ভীষণ মুষড়ে পড়ে। বউ না-থাকলে কিংবা সুস্থ থাকলে যে কোনো একটা হোটেলে উঠে যেতাম অথবা যে কোনোভাবে হোক বান্দরবান বা আমার নিজের বাড়ি চন্দনাইশ চলে যেতাম। এত রাতে অসুস্থ শরীর নিয়ে অতদূর যাওয়া উচিত হবে না। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, পকেটে এমন পরিমাণ টাকা নেই, যা দিয়ে প্রাইভেট যান ভাড়া করতে পারি।
কেয়ার টেকার বললেন, আপনি জেনারেল স্যারের সাথে দেখা করেন। তিনি পাঁচ নম্বর কক্ষে আছেন। বুঝিয়ে বললে হয়ত শুনবেন।
এডিসি সাহেবের নাম শহীদুল্লাহ মজুমদার। নোয়াখালী বাড়ি। এক মাস হয় চট্টগ্রামে জয়েন করেছেন। এর আগে ছিলেন রাঙ্গামাটি। ডিসি হাসান সাহেব নিয়ে এসেছেন। শহিদুল্লাহ সাহেব কয়েকজন লোকের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। পরিচয় দিয়ে রাতটা থাকার সুযোগ দিতে অনুরোধ করি।আমার অনুরোধে তার চোখেমুখে বিরক্তের বন্যা। মুখটা বিকৃত করে বললেন : আপনার স্ত্রী অসুস্থ তাতে আমার কী?
বিনয়ের সঙ্গে বললাম : এত রাতে কোথায় যাব?
: আমার আত্মীয়ের চেয়ে আপনার স্ত্রীর অসুস্থতা বড়ো হতে পারে না। শহরে কী হোটেলের অভাব আছে? একটাই উঠে যান।
: একটু বুঝার চেষ্টা করুন স্যার।
: আমি কী কম বুঝি? আপনি যান। গুরুত্বপূর্ণ আলাপ করছি। আগামী কাল আমার চাচাত বোনের বিয়ে।
তাঁর কথা যথেষ্ট রুক্ষ তবু সংযত থাকলাম, হাজার হোক সিনিয়র। সঙ্গে বউ না-থাকলে অনুরোধও করতম না, চলে যেতাম। বউয়ের সামনে এত বড়ো অপমান মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার।
আরও বিগলিত হয়ে বললাম : বিয়ে তো আগামী কাল। ভোরে চলে যাব। এত রাতে অসুস্থ মহিলা নিয়ে কোথায় যাব?
: যেখানে ইচ্ছা সেখানে যান, আমার কী? আপনি আমার কাছেই বা কেন এসেছেন?
: আপনিই তো চাবি দিতে নিষেধ করেছেন।
: তো বেশ করেছি। আমার আত্মীয় আসবে তাই আমি রুম পরিস্কার করে নিলাম, ঝামেলা করবেন না। যান বলছি।
তার কথা শেষ হবার আগে দরজার পেছন হতে নারী কন্ঠের আওয়াজ ভেসে এল। পেছনে তাকাই, আমার স্ত্রী। মূর্তি তার রুদ্র। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনছিল। তার শরীর কাঁপছে। চোখে-মুখে ক্রোধ, এমনিতে সে সাহসী, অধিকন্তু মেয়েলি ভয়ঙ্করতা তো আছেই। স্বামীকে যতই অপছন্দ করুক, কোনো স্ত্রীই স্বামীর সামান্য অপমান সহ্য করতে পারে না। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আমার মনটা শঙ্কায় আঁতকে উঠল।
বললাম : তুমি এখানে এলে কেন?
আমার স্ত্রী বলল : চলে এসো, দরকার হলে ফুটপাতে থাকব। তবু এ জাহান্নামে নয়। সারকিট হাউজ নয়, চার কীট হাউজ।
কণ্ঠ নরম করে বউকে বললাম : আমি আর একবার অনুরোধ করে দেখি।
আমার স্ত্রী বলল : কার কাছে অনুরোধ করছ? মানুষের কাছে মানুষ অনুরোধ করে, জানোয়ারের কাছে নয়। আগামী কালের মেহমানের জন্য যিনি আজকের মেহমানদের চরম অসুবিধা সত্ত্বেও রাত এাগরটায় বের করে দেন তাঁর কাছে অনুরোধ করার চেয়ে কুত্তার কাছে অনুরোধ করা অনেক ভালো, শুয়োরের কাছে অনুরোধ করা ভালো। আমি অনেক অমানুষ দেখেছি কিন্তু এমন অমানুষ দেখিনি। দেখতেও পশুর মত লাগছে। ছি! ছি!! জুনিয়র সহকর্মীদের প্রতি যার সহানুভূতি নেই সে তো হায়েনার চেয়েও নৃশংস।
আমার স্ত্রীর কথায় শহিদুল্লাহ সাহেব রাগে কাঁপছেন। আমার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন : আপনার স্ত্রীকে সরে যেতে বলেন। নইলে কিন্তু অসুবিধা হবে।
আমি কিছু বলতে চাইলাম, পারলাম না। মেয়েরা কথা বলতে চাইলে পুরুষদের সুযোগ শূন্য হয়ে যায়। স্ত্রী হলে তো আর কথায় নেই। আমার স্ত্রী আরো সামনে এগিয়ে এসে একদম শহিদুল্লাহ সাহেবের সামনে গিয়ে বললেন : সার্কিট হাউস আপনার বাবার সম্পত্তি নয়, সরকারি সম্পদ। এখানে আপনার মেহমানের চেয়ে আমাদের অধিকার বেশি। সার্কিট হাউসে অবস্থানের নীতিমালা আছে, সেটা পড়ে আসুন। এটা কমিউনিটি সেন্টার নয়, সার্কিট হাউজ।
সরে যান, সরে যান বলছি; চিৎকার করে উঠেন শহিদুল্লাহ মজুমদার।
সরে না গেলে কী করবেন? বেয়াদব, করাপ্টেড, বুচার, নৃশংস হারামি! আমার স্ত্রীর অগ্নিমূর্তি শহিদুল্লাহ মজুমদারকে ভয় পাইয়ে দিল। তিনি পিছিয়ে এলেন কিছু, তবু গোঁ ছাড়লেন না।
আমার দিকে তাকিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বললেন : আপনার স্ত্রীকে সরিয়ে নিন। নইলে – – ।
আমি কিছু বলার আগে আবার আমার স্ত্রীী বলে উঠেন : নইলে কী করবেন? অসভ্য কোথাকার। বিবেকহীন কুত্তা। হোটেল ভাড়া করে বরযাত্রী রাখার যোগ্যতা অর্জন করার আগে আত্মীয়কে বিয়ে করাচ্ছেন কেন? মুরোদ নেই যার তার আবার কথা। ভিক্ষেয় বের হলে তো পারতেন। অবৈধভাবে সার্কিট হাউস দখলের মজাটা আমি আজ দেখাব।
: কী করবেন আপনি?
আমার স্ত্রী পা হতে সেন্ডেল খুলে হাতে নিতেই মজুমদার সাহেব আমার পেছনে লুকিয়ে পড়েন। আমি সেন্ডেলটা নিয়ে নিলাম।
কাঁদো কাঁদো গলায় শহিদুল্লাহ বললেন : আপনারা যান, আমি চাবি নিয়ে আসছি।
আমি স্ত্রীকে টেনে নিয়ে ওয়েটিং রুমে চলে আসি। সে কাঁদছে। ওয়েটিং রুমে অনেক লোক। বন্দর সমস্যা নিয়ে আলোচনা হবে আগামী কাল নয়টায়। দুজন মন্ত্রী আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে দুই-মন্ত্রী সার্কিট হাউস ঢুকবেন।
আমার স্ত্রী বলল : আমি সার্কিট হাউজে থাকব না। মেইন গেইটে শুয়ে থাকব। দেখি মন্ত্রীরা কীভাবে সার্কিট হাউসে ঢুকেন।
আমি তাকে বুঝানোর চেষ্টা করি। তবু রাগ কমে না। গলায় ঘৃণার ঝড় এনে বলল : ছিঃ! কী চাকুরিতে ঢুকলে তুমি! যেখানে একজন সিনিয়র তার জুনিয়র সহকর্মীর অসুস্থ স্ত্রীকে রাত এগারটায় রাস্তায় বের করে দেয়। এ রকম ক্যাডারে চাকুরি করার চেয়ে ফুটপাথে ছোলা বিক্রি অনেক ভালো।
: প্লিজ, থাম।
: থামব না। বাইরে তো বেশ বড়াই কর, এডমিন ক্যাডার। আমি মন্ত্রীকে বিচার না দিয়ে যাব না।
মন্ত্রীকে জানালে ঘটনা অনেক বড়ো হয়ে যাবে। পত্রিকায় উঠবে। এমনি এডমিন ক্যাডারের দোষ খুঁজে সবাই। আবার বুঝানোর চেষ্টা করি। এবার মন গলে তার।
বলল : মন্ত্রীকে বিচার দেব না। তবে আবার শহিদুল্লাহ্র সঙ্গে দেখা করব।
শহীদুল্লাহ সাহেব কক্ষের বাইরে পায়চারি করছিলেন। মুখ ফ্যাকাশে। আমার স্ত্রীকে দেখে ভয়ে ভেতর ঢুকে যেতে চাইলেন।
আমার স্ত্রী ডাক দিলেন : দাঁড়ান।
তিনি দাঁড়ালেন।
আমার স্ত্রী বললেন : আমরা চলে যাচ্ছি। স্বামীর অনুরোধে আপনাকে ক্ষমা করলাম। নইলে আপনার আত্মীয়ের বিয়ের বারোটা বাজাতাম। অবৈধভাবে সরকারি সম্পদ ব্যবহার এবং আমাদের বৈধ অধিকার কেড়ে নিয়ে যে হীনম্মন্যতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে আপনার পরিচয় পেয়ে গিয়েছি। এ চেইন ইজ মিজারড বাই ইটস উইকেস্ট লিংক। আপনার মতো জানোয়ার যতোদিন প্রশাসনে থাকবে ততোদিন এ ক্যাডারের উন্নতি হবে না, বরং দিন দিন শেষ হয়ে যাবে।
ধরাপড়া চোরের মতো মুখটা মলিন করে জনাব মজুমদার নিঃশ্চুপ দাঁড়িয়ে। কোন কথা নেই, হ্যাঁ করে তাকিয়ে কাঁপছেন।
আমি, আমার স্ত্রীর হাত ধরে টানতে থাকি : এসো, চলে যাই।
তোমার এডিসি নাকি বিডিসি, তাকে একটা চড় দিতে এসেছিলাম। কিন্তু এমন আবর্জনায় হাত লাগাতে ইচ্ছা করল না। আমি চোখে ইশারা করতে মজুমদার সাহেব রুমে ঢুকে পড়লেন। বারান্দায় বেশ কিছু লোক। তারা প্রশংসার দৃষ্টিতে আমার স্ত্রীর দিকে চেয়ে।
রাত পৌনে এগারটার দিকে সার্কিট হাউস থেকে বেরিযে আসি। গেইট পাড় হতে না হতে সার্কিট হাউসে মন্ত্রীর গাড়িবহর ঢুকে পড়ে। ঘটনাটি মনে পড়লে আমি এখনো শিউরে উঠি। যদি আমার স্ত্রী ওই দিন মন্ত্রীকে বিষয়টা জানাত তো মজুমদার সাহেবের কি হতো?
এ ঘটনার কয়েক মাস পূর্বে আমার শালীর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। হবু স্বামী প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য ছিলেন। আমার স্ত্রীর কাছে সার্কিট হাউসের ঘটনা শুনে শ্বশুর মশায় বিয়ে ভেঙ্গে দিলেন। আমি অনুনয় করেছিলাম।শ্বশুর অনড়: এমন ক্যাডারের সদস্যের কাছে মেয়ে দেব না।
আমি চেষ্টা করেছিলাম শালিকার মাধ্যমে রাজি করাতে। শালিকা বাপের এককাঠি উপড়ে। শ্লেষগলায় বলেছিলেন দাদা ভাই : প্রয়োজনে রিক্সাওয়ালার সঙ্গে বিয়ে বসব। তবু প্রশাসন ক্যাডারের কাউকে নয়।
: কেন?
: এই ক্যাডারে শহিদুল্লাহ মজুমদার আছেন। আমাকে নিয়েও এমন ঘটনা ঘটতে পারে।
অতপর বিয়ে ভেঙ্গে দেন শালিকা। এখন শালিকাকে দেখলে গর্বে বুক ফুলে উঠে। তার স্বামী ক্যাডার সার্ভিসে, তবে প্রশাসন ক্যাডারে নয়। সার্কিট হাউস দেখলে এখনো ঘটনাটা মনে পড়ে, মনে পড়ে শহিদুল্লাহ মজুমদারের কথা, শালীর বিয়ে ভেঙে দেওয়ার কথা।স্ত্রীর সামনে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে লজ্জায় আনত হবার কথা।
সার্কিট হাউস আমার বুকটা চার কীটের মতো কষ্টে মুচড়ে দেয়।
পুনুশ্চ: এই ঘটনার বেশ সাত আট-দিন পর আমার এক সহকর্মী জানাল : শহীদুল্লাহ মজুমদার ওএসডি হিসেবে বদলি হয়ে গেছে। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আনিসুজ্জামান পূর্বনির্ধারিত একটি সভায় অংশগ্রহণের জন্য সকাল আটটায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে আসেন। আধঘণ্টা পাড় হয়ে গেলেও তাকে ভিআইপি-ওয়ান কক্ষে উঠানো গেল না। জানা গেল, ভিআইপি-ওয়ান রুমে শহীদুল্লাহ মজুমদার ঘুমিয়ে আছেন। তাকে ডেকেও তোলা যাচ্ছে না। তিনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। উপদেষ্টা সাহেব, তখনই শহীদুল্লাহ মজুমদারকে ওএসডি করার নির্দেশ দেন।