কীভাবে হলো দেশের নাম (ইউরোপ)
ড. মোহাম্মদ আমীন
স্পেন (Spain)
স্পেন দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের আইবেরীয় উপদ্বীপে অবস্থিত। এটি পশ্চিম দিকে পর্তুগাল এবং উত্তর-পূর্ব দিকে ফ্রান্স ও অ্যান্ডোরার

সঙ্গে সংলগ্ন। দেশটির উত্তরে বিস্কাই উপসাগর, দক্ষিণ দিকে জিব্রাল্টার প্রণালী, প্রণালীর দক্ষিণে মরক্কো, পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে আটলান্টিক মহাসাগর এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ভূমধ্যসাগর। স্পেনের সমুদ্র সীমা প্রায় ৭ হাজার ৮০০ কিলোমিটার লম্বা। দেশের সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট তেইদে ৩.৭১৮ মিটার। স্পেনের ম্যাপ দেখতে নিচের মেলে ধরা বাম হাতের মতো।
নরমান পেইন Spagne বা ল্যাটিন হিসপানিয়া (Hispania) শব্দ হতে স্পেন নামের উৎপত্তি। এর অর্থ হাইর্যাক্সেস দ্বীপ (Island of Hyraxes)। হাইর্যাক্স (hyrax) আফ্রিকান শব্দ। সম্ভবত এর অর্থ খরগোশ। এ দ্বীপে প্রচুর খরগোশ ছিল এবং খরগোশ শিকার ছিল স্থানীয়দের জীবন-জীবিকার অন্যতম উপায়। এ দ্বীপ হতে ইউরোপ-আফ্রিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে খরগোশ রপ্তানি হতো। তাই দ্বীপটি হাইরাক্স দ্বীপ নামে পরিচিতি পায়।
একটি ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, সাধারণ ব্যুৎপত্তিগ হিব্রু শব্দ ই-স্পানিয়া (i-shfania) শব্দের অর্থ (Island of the Hyrax) বা খরগোশের দ্বীপ (island of the hare” or “island of the rabbit)। এ ব্যাখ্যামতে, ই-স্পানিয়া হতে স্পেন নামের উদ্ভব।আবার অনেকে মনে করেন, পোনেসিয়ান (Phoenician) স্পান (span) শব্দ হতে স্পেন নামের উদ্ভব। এর অর্থ লুকানো বা ‘একটি লুকানো’ বা ‘এমন স্থান যা দেখা যায় না’। যারা আসল ও অন্তর্নিহিত অর্থ ‘একটি দূরবর্তী’ বা‘ অনেক দূরের দেশ’ বা অনেক দূরের ভূখণ্ড বা অতি দূরবর্তী দেশ far-distant land)।
এরিক প্যাট্রিজ {Eric Honeywood Partridge (6 February 1894 – 1 June 1979)} বিখ্যাত অরিজিন (Origins) গ্রন্থে স্পেন নামের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁরমতে, ইবেরিয়ান ভাষা হতে স্পেন নামের উদ্ভব। প্রাক- রোমান নাম সেভিল (Sevill), হিসপালিস (Hispalis) প্রভৃতি জোরালোভাবে প্রমাণ করে যে, হিস্পা ইবেরিয়ান বা সেলটিক শব্দ। সেভিলার

ইসিডোরের বর্ণনামতে, হিস্পানিয়া শব্দটি হচ্ছে হিস্পালিস শব্দের পরিবর্তিত রূপ। তিনি মনে করেন, মূলত হিসপালিস শব্দটি গ্রিক (Heliopolis) শব্দ হতে এসেছে। যার অর্থ সূর্যের শহর বা সূর্যনগর (city of the sun)। ম্যানুয়েল পেলিসার কাটালান (Manuel Pellicer Catalán)-এর মতে ফোনেসিয়ান (Phoenician) স্পাল কক(spal) শব্দ হতে স্পেন নামের উদ্ভব। যার অর্থ নিচুভূমি বা নিচুদেশ। হিস্পানিরা মাঝে মাঝে তাদের দেশকে হেস্পারিয়া আলটিমা (Hesperia Ultima) বলতেন। যার অর্থ পশ্চিমের শেষ দেশ বা সর্বপশ্চিম প্রান্তের দেশ (the last western land)।
আর একটা ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, বাস্ক (Basque) শব্দ ইজপানা (Ezpanna) হতে স্পেন নামের উদ্ভব। যার অর্থ সীমান্ত, সীমানা বা প্রান্ত। (border or edge)। যার অন্তর্নিহিত অর্থ দূরবর্তীতম এলাকা বা সবচেয়ে দূরের স্থান বা সবচেয়ে দূরের দেশ (farthest area or place)। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকের রোমান ইতিহাসবেত্তা নিয়াস পম্পেয়াস ট্রাগাস (Gnaeus Pompeius Trogus) স্পেন নামের ব্যুৎপত্তি সম্পর্কে একটি নতুন তথ্য দিয়েছে। তিনি স্পেন নামটি পৌরানিক বীর হিস্পান (Hispan) হতে উদ্ভুত বলে বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও অনেকের লেখা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। স্পেনের রাজধানীর নাম মাদ্রিদ। আরবি মেগ্রেতি শব্দ হতে নামটির উদ্ভর। এর অর্থ অনেক নদীর স্থান বা অনেক স্রোতের স্থান বা অনেক প্রবাহের স্থান (place of many streams)।
স্পেনের মোট আয়তন ৫,০৫,৯৯০ বর্গকিলোমিটার বা ১,৯৫,৩৬৪ বর্গমাইল। তন্মধ্যে জলীয় ভাগের পরিমাণ ১.০৪ ভাগ। ২০১৫

খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে সুইডেনের জনসংখ্যা ৪,৪৬,৩৯৮৬৪ এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ৯২। আয়তন বিবেচনায় স্পেন পৃথিবীর ৫১-তম বৃহত্তম দেশ কিন্তু জনসংখ্যা বিবেচনায় ২৯-তম বৃহত্তম দেশ। অন্যদিকে জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় এটি পৃথিবীর ১১২-তম জনবহুল দেশ। স্পেনের সরকারি ভাষা স্পেনিশ। আরাগোনিস, অস্ট্রিয়ান, বাস্ক, কাটালান, গ্যালিকিয়ান ও অসিটান প্রভৃতি আঞ্চলিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃত। সরকারিভাবে স্পেনের নাগরিকদের স্পেনিশ ও স্পেনিয়ার্ড বলা হয়। সরকার ব্যবস্থা সংসদীয় রাজতন্ত্র।
স্পেনের জিডিপি (পিপিপি) ১.৬১৯ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার এবং সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ৩৪,৮৯৯ ইউএস ডলার। অন্যদিকে জিডিপি (নমিনাল) ১.২৩০ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ২৬,৫১৭। মাথাপিছু আয় বিবেচনায় স্পেন পৃথিবীর ৩০-তম ধনী দেশ। মুদ্রার নাম ইউরো। মাদ্রিদ দেশের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর।
স্পেন এর প্রথম দিকের আধিবাসীরা মূলত কেল্ট ও আইবেরিয়রা। এক দীর্ঘমেয়াদী ও প্রবল যুদ্ধের পর আইবেরিয় উপদ্বীপ (Iberian Peninsula) রোমান রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং পরিচিত হয় হিসপিনিয়া (Hispinia) নামে। মধ্যযুগের প্রথমদিকে এটি জার্মান শাসনাধীনে গেলেও পরবর্তীতে মুসলিমগণ দেশটি জয় করেন। শুরু হয় মুসলিম শাসন অবসানের জন্য উত্তরের খ্রিস্টান রাজ্যসমূহের এক এলোমেলো এবং অত্যন্ত দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া। অবশেষে সফল হয় খ্রিস্টানরা। ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে, কলম্বাস যখন

অজানা দ্বীপ আমেরিকায় পৌঁছেন, তখন মুসলিম শাসনের শেষ চিন্হটুকু নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় গ্রানাডা থেকে। নতুন সাম্রাজ্য স্পেনকে ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত করে এবং ষড়বিংশ শতক থেকে সপ্তবিংশ শতকের অর্ধভাগ পর্যন্ত স্পেন ছিল পৃথিবীর অন্যতম প্রধান পরাশক্তি। ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ মে স্পেনের পতাকাটি প্রথম নৌবাহিনীর পতাকা হিসাবে গ্রহণ করা হয়। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর পতাকাটি পুনরায় গ্রহণ করা হয়।
১৪০০ বছর পূর্বে স্পেনিশরা পালক কমল (quill pen) আবিষ্কার করে। ষোড়শ শতকে আমেরিকায় উইরোপীয় ওপনিবেশ প্রসারকালে স্পেনিশরা আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তদের ভাষাও ছড়িয়ে দেয়। বর্তমান পৃথিবীর ২২টি দেশের ৪০০ মিলিয়ন লোক স্পেনিশ ভাষায় কথা বলে। তন্মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে স্পেনিশভাষীরসংখ্যা ৩৫ মিলিয়ন। ইউরোপের দেশ হলেও স্পেনের সঙ্গে আফ্রিকান ইতিহাসের মিল বেশি। স্পেন হতে মরক্কোর সীমান্ত দূরত্ব মাত্র ৯ মাইল।
বরফ যুগে পুরো ইউরোপ হিমবাহে আবৃত ছিল। কিন্তু স্পেনের বিরাট অংশ তখনও হিমাবহ মুক্ত ছিল। ফলে ইউরোপের অন্যান্য স্থান হতে উদ্ভিদ ও নানা গাছাগাছালির ছারা স্পেনে রোপন করে জীবিত রাখা হয়। পুরো ইউরোপে ৯০০০ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া

যায়। তন্মধ্যে এককভাবে স্পেনে পাওয়া যায় ৮০০০ প্রজাতির ছাড়া। এরমধ্যে ২০০০ শুধু স্পেনেই পাওয়া যায়। সেনেকা, হাদ্রিয়ান, অ্যান্তোনিও বান্দেরাস, পেনেলোপ ক্রুজ, সালভাডর ডালি, এল গ্রেসো, পাবলো পিকাশো, ফ্রান্সিসকো ডি গয়া, জোসে কেরেরাস এবং প্লাসিডো ডমিঙ্গো স্পেনের কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তি। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে ৪৮ মিলিয়ন পর্যটক ফ্রান্স ভ্রমণ করে। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনে টুরিস্টরা ব্যয় করে ৫১ বিলিয়ন ইউএস ডলার। ফ্রান্সের পর স্পেন পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্যটক ভ্রমণকারীর দেশ।
স্পেনিশ অভিযাত্রী জুয়ান রডরিগুয়েজ কাবরিলো (Juan Rodriguez Cabrillo,1499-1543) ক্যালিফোর্নিয়র সন্ধান পান। স্পেনিশ নাবিক গ্যাব্রিয়েল ডি ক্যাস্টিলা [Gabriel de Castilla (1577-1620)] পৃথিবীর প্রথম মানুষ। যিনি ১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম অ্যান্টার্কটিকা দেখেন। স্পেনিশ নাবিক জুয়ান সেবাস্তিয়ান এলকানো (Juan Sebastián Elcano,1476-1526) জলপথে প্রথম পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেন। একই দেশের অভিযাত্রী ভাস্কো নিউনেজ ডি বালবোয়া (Vasco Nunez de Balboa, 1475-1519) প্রথম ইউরোপীয়ান, যিনি প্রথম প্রশান্ত মহাসাগর দেখেন।
৫০০ বছর পূর্বে রোমান ক্যাথলিক ছিল স্পেনের দাপ্তরিক ভাষা। ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে এটাকে দাপ্তরিক ধর্ম হতে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ৮৫ স্পেনিশ নিজেদের রোমান ক্যাথলিক দাবি করে তন্মধ্যে কেবল ৪০% নিয়মিত গির্জায় যায়। এখানে ৩,৫০,০০০ প্রটেস্ট্যান্ট, ৪ লাখ মুসলিম এবং ১৫ হাজার ইহুদি রয়েছে। স্পেনে ৫ লাখের বেশি জিপসি রয়েছে। এদের কেউ কেউ শহরে আধুনিক

জীবনযাত্রায় অভ্যস্থ হয়ে ওঠলেও এখনও অনেকে জিপসিদের প্রাচীন জীবনযাত্রা ধারণ করে আছে। জিপসিরা পঞ্চদশ শতকে ভারত হতে ইউরোপে গমন করে। মুসলিমরা ১২০৯ খ্রিষ্টাব্দে ভেলেসিয়ায় স্পেনের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে।
স্পেনে বিবাহ বিচ্ছেদ ও বিয়ের পূর্বে সন্তানধারণের হার খুব কম। বিবাহপূর্ব যুগলের সন্তান জন্মগ্রহণের হার মাত্র ১৫%। আইসল্যান্ড, নরওয়ে ও সুইডেনে এ হার ৫০%। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের ভর্তির হার ছিল ১.৭%। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে তা ৪০% ছাড়িয়ে যায়। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ হতে স্পেনে সমলিঙ্গের বিয়ে আইনগত স্বীকৃতি লাভ করে। এখানে প্রকাশ্যে নগ্নতার বিরুদ্ধে কোনো আইন নেই। সম্মতিক্রমে যৌনসঙ্গমের বৈধ বয়স স্পেনে ১৩, এটি ইউরোপে সর্বনিম্বন। মাল্টা ও তুরস্কে ১৮,এটি সর্বোচ্চ। ইউএস ডিপার্টমেন্টের ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে, স্পেনে ২ হতে ৪ লাখ নারী যৌনকর্মীর কাজে নিয়োজিত। তন্মধ্যে ৯০% পাচার করে আনা। বেশ্যাবৃত্তি স্পেনে অপরাধ নয়, তবে বেশ্যার দালালগিরি অবৈধ।
স্পেনের রিউ টিন্টু নদী ৫০০০ বছর পূর্ব হতে খনি খননজনিত প্রতিক্রিয়ায় এত দুষিত হয়ে পড়েছে যে,এখানে কোনো জলীয় জীব

নেই বললেই চলে। ইউরোপে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ মওজুদ আছে স্পেনে। গ্র্যানাইট উৎপাদনে স্পেন পৃথিবীর বৃহত্তম কয়েকটি দেশের অন্যতম। স্পেন পৃথিবীর বৃহত্তম অলিভ অয়েল উৎপাদনকারী দেশ। পৃথিবীর মোট অলিভ অয়েলের ৪৫% স্পেনে উৎপাদিত হয়। স্পেন ও পর্তুগাল একত্রে পৃথিবীর বৃহত্তম কর্ক উৎপাদনকারী দেশ।
১৫৮৮ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনের রাজা ইংল্যান্ডে ১৩৩টি জাহাজ প্রেরণ করে। তন্মধ্যে অর্ধেকের বেশি জাহাজ বিরূপ আবহাওয়ার কারণে ডুবে যায় বা ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায়। এ যুদ্ধে পরাজয় স্পেনের ইতিহাসের একটি মাইলফলক এবং স্পেনের বৈশ্বিক বিস্তৃতি একচ্ছত্র শক্তিতে ধ্বস নামে।
সান ম্যারিনো (San Marino) : ইতিহাস ও নামকরণ
সার্বিয়া (Serbia) : ইতিহাস ও নামকরণ
স্লোভাকিয়া (Slovakia) : ইতিহাস ও নামকরণ
স্লোভেনিয়া (Slovenia) : ইতিহাস ও নামকরণ
সূত্র: কীভাবে হলো দেশের নাম, ড. মোহাম্মদ আমীন, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয়ক সকল গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক