স্বভাবকবি গোবিন্দচন্দ্র দাস: জীবন ও কর্ম: কবিতা

ড. মোহাম্মদ আমীন
ড. মোহাম্মদ আমীন
বাংলা সাহিত্যে স্বভাব কবি নামে পরিচিত কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস  ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই জানুয়ারি তৎকালীন ঢাকা বর্তমান গাজীপুর গাজীপুর জেলার ভাওয়ালের ধীরাশ্রমে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবার নাম রামনাথ দাস,  মায়ের নাম আনন্দময়ী দেবী । গোবিন্দচন্দ্র দাসের শৈশবে পিতৃহারা হন।  ভাওয়ালরাজ প্রতিষ্ঠিত জয়দেবপুর মাইনর স্কুল থেকে ছাত্রবৃত্তি পাশ করে ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা নর্মাল স্কুলে ভর্তি হন। নবম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়নের পর স্কুল ত্যাগ করে ভাওয়ালের ব্রাহ্মণগ্রাম বঙ্গ বিদ্যালয়ে হেডপন্ডিত হিসেবে যোগদান করেন। পরে তিনি পর্যায়ক্রমে ভাওয়াল এস্টেটের রাজকুমারের প্রাইভেট সেক্রেটারি (১৮৭৭), সুসঙ্গ দুর্গাপুরের জমিদারির খাজাঞ্চি (১৮৮০), মুক্তাগাছার জমিদারির সেরেস্তাদার (১৮৮০-৮২), ময়মনসিংহ এন্ট্রান্স স্কুলের পন্ডিত, ময়মনসিংহ সাহিত্য-সমিতির অধ্যক্ষ (১৮৮২-৮৪) এবং শেরপুরের জমিদার প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক চারুবার্তার কর্মাধ্যক্ষরূপে (১৮৮৪-৯৪) দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৮৭-৮৮ সালে কলকাতায় অবস্থানকালে তিনি মাসিক পত্রিকা বিভা প্রকাশ করেন।
গোবিন্দচন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত প্রতিবাদী চরিত্রের মানুষ।  তিনি যখন ভাওয়াল স্টেটে চাকরি করতেন তখন রাজাদের অত্যাচার ও দিউয়ান কালীপ্রসন্ন ঘোষের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ এবং  ভাওয়াল রাজার বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষাবলম্বন করায়  রাজরোষে পড়ে সেখান থেকে  বিতাড়িত হন। পরবর্তীকালে তিনি যখন কলকাতায় অবস্থান করছিলেন তখন নব্যভারত পত্রিকার সম্পাদক দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়।  তাঁর আশ্রয়ে থাকাকালীন তিনি মগের মুলুক নামক সুপ্রসিদ্ধ কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন।  ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের গোবিন্দচন্দ্র দাসের লেখা  মগের মুলুক নামের ব্যঙ্গাত্মক কবিতাটি প্রকৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এটি প্রকাশিত হলে ভাওয়াল রাজ পরিবার কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস এবং প্রকৃতি পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধের ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মানহানির অভিযোগ করে ভাওয়াল রাজপরিবার । গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত করা হয়।  এর আগে কবি ভাওয়াল রাজার বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষাবলম্বন করলে রাজার রাজরোষে পড়েন । তখন থেকে ভাওয়াল রাজ কবিরকে শায়েস্তা করার সুযোগ খুঁজছিলেন। ১২৯৮ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় কবি গোবিন্দচন্দ্র দাসকে নির্বাসন দণ্ড প্রদান করে দণ্ড ঘোষণার মুহূর্তে জয়দেবপুর ত্যাগের আদেশ দেন । কবি মনের দুঃখে ভাওয়াল পরগনা ত্যাগ করেন । মূলত ভাওয়াল রাজপরিবারের আশ্রয়ে থাকাকালীন রাজপরিবারের প্রধান কর্মচারী কালীপ্রসন্ন ঘোষের সঙ্গে বিরাধিতার ফলে তিনি ভাওয়াল থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন। ভাওয়ালকে নিয়ে একটি কবিতাও লিখে ফেলেন তিনি: 
‘‘ভাওয়াল আমার অস্থি মজ্জা, ভাওয়াল আমার প্রাণ,
আমি তার নির্বাসিত অধম সন্তান।
তার সে মধুর প্রীতি
মনে জাগে নিতি নিতি ।”
রবীন্দ্রনাথের সমকালে আধুনিক গীতিকবিতার ধারায় কবিতা রচনা করেই গোবিন্দচন্দ্র খ্যাত হন।  পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, ভাওয়াল রাজপরিবারের আশ্রয়ে থাকাকালীন রাজপরিবারের প্রধান কর্মচারী কালীপ্রসন্ন ঘোষের সঙ্গে বিরাধিতার ফলে তিনি ভাওয়াল থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন। এটি ছিল তার জীবনের চরম কষ্ট অপমান ও বেদনার বিষয়। সেই বেদনা ও অপমান তাঁর কাব্যের প্রধান সুর। কাব্যের বাণীতে আন্তরিকতা ও স্পষ্টতার জন্য তিনি বাংলা সাহিত্যে ‘স্বভাব কবি’ নামে পরিচিত।  পূর্ববঙ্গের প্রকৃতির বর্ণনা, বাঙালির স্বভাবের চারিত্রিক দুর্বলতা, গভীর বাস্তববোধ ও প্রগাঢ পত্নীপ্রেম তাঁর কবিতার বৈশিষ্ট্য, নরনারীর ইন্দ্রিয়জ প্রেম, স্বদেশপ্রেম, পল্লিপ্রকৃতি ও মানবজীবনের কথা গোবিন্দচন্দ্রের কাব্যের মুখ্য বিষয়বস্তু। ‘স্বদেশ’ কবিতায় তিনি শিক্ষিত বিলেতফেরত সমাজকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করেন। তিনি কলকাতায় ‘বিভা’পত্রিকার প্রকাশক এবং শেরপুরে ‘চারুবার্তা’ কাগজের অধ্যক্ষ ছিলেন।  তিনি ১০খানি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। কিছু কবিতা আজও অপ্রকাশিত। গীতার কাব্যানুবাদক হিসেবেও তিনি খ্যাত ছিলেন।  প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে:
  1. প্রসূন (১৮৭০),
  2. প্রেম ও ফুল (১৮৮৮),
  3. কুঙ্কুম (১৮৯২),
  4. মগের মুলুক (ব্যঙ্গকাব্য, ১৮৯৩),
  5. কস্তুরী (১৮৯৫),
  6. চন্দন (১৮৯৬),
  7. ফুলরেণু (সনেট, ১৮৯৬),
  8. বৈজয়ন্তী (১৯০৫),
  9. শোক ও সান্ত্বনা (১৯০৯),
  10. শোকোচ্ছ্বাস (১৯১০) ইত্যাদি।
এ ছাড়াও তিনি অ্যালেন হিউমের অ্যায়োত্রক কবিতা এবং ভগবদ্গীতার কাব্যানুবাদ করেন। তাঁর প্রথমা পত্নী সারদাসুন্দরীর মৃত্যুর প্রায় সাত বছর পর তিনি দ্বিতীয়বার (১৮৯২) দারপরিগ্রহ করেন। কিন্তু কবিতার মাধ্যমে তিনি তাঁর প্রথমা পত্নীকে অমর করে রেখেছেন। গোবিন্দচন্দ্র তাঁর কবিতায় যে আঞ্চলিক রীতি প্রয়োগ করেছেন তার ফলে বাংলা কবিতায় এক নতুন স্বাদের সৃষ্টি হয়েছে। 
কবি ভাওয়াল থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রথমে আশ্রয় নেন মুক্তাগাছা জমিদার বাড়িতে । তিনি  বিভিন্ন স্থানে ও বিভিন্ন ব্যক্তির স্নেহচ্ছায়ায় কাজ করেছেন, আবার ছেড়েও দিয়েছেন। শেষজীবনে মুক্তাগাছার জমিদার জগৎকিশোর আচার্য চৌধুরীর বৃত্তিই ছিল তাঁর জীবনধারনের একমাত্র সম্বল।  ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মোসে  কবি বিষফোঁড়ায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি হন ।  চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁর চিকিৎসার ব্যয়ভার গ্রহণ করেন ।  চরম  অর্থকষ্টে ধুকেধুকে বাংলার স্বভাবকবি  গোবিন্দচন্দ্র দাস ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে সেপ্টেম্বর ( ১৩ই আশ্বিন ১৩২৫ বঙ্গাব্দ ) সোমবার ভোর ৫টা ১৫ মিনিটে ঢাকার নারিন্দার ৪৭ নং শাহ সাহেব লেনে  মারা যান । অনেকের মতো, তারমৃত্যু ১লা অক্টোবর। তাঁকে শ্যামপুর শ্মশানে দাহ করা হয় । মৃত্যুর আগে কবি চিরবিদায়ের লগ্ন টের পেয়েছিলেন নিশ্চিত:
“দিন ফুরায়ে যায়রে আমার
দিন ফুরায়ে যায়
মাঝের রবি ডুবছে সাঁঝে-
দিনটা গেল বৃথা কাজে
একপা কেবল পারে আছে
এক পা দিছি নায় ।”
গোবিন্দচন্দ্র দাসের বিখ্যাত কবিতা বাঙালীর সংযোগ: বাঙালি: বাঙালির স্বভাব: শূয়োরের চর্মের চেয়ে স্থূল চর্মের জাতি
Language
error: Content is protected !!