ড. মোহাম্মদ আমীন
স্বর্ণকুমারী দেবী: বাংলার স্বর্ণময় রমণী
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম গীতিনাট্য রচয়িতা, প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক, সংগীতকার, কবি ও সমাজ সংস্কারক স্বর্ণকুমারী দেবী ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে আগস্ট কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। র্ণকুমারী দেবী ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্রী এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা। তিনি তাঁর অনুজ ভ্রাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাঁচ বছরের বড়ো ছিলেন। তাঁর তিন দিদির নাম সৌদামিনী, সুকুমারী ও শরৎকুমারী এবং ছোটো বোনের নাম ছিল বর্ণকুমারী। সৌদামিনী ছিলেন বেথুন স্কুলের প্রথম যুগের ছাত্রী। তবে স্বর্ণকুমারী দেবী বাড়িতে লেখাপড়া করেন।
পারিবারিক জীবন: ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে স্বর্ণকুমারী দেবীর বিবাহ হয়। জানকীনাথ ছিলেন নদিয়া জেলার এক জমিদার পরিবারের সন্তান। ঠাকুর পরিবার ছিল পিরালি ব্রাহ্মণ। বর্ণ হিন্দুর তাঁদের ঘৃণা করত এবং রবীন্দ্রনাথের পরিবারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক করত না। পিরালি ব্রাহ্মণ বংশের মেয়ে বিয়ে করায় জানকীনাথকে পরিবারচ্যুত করা হয়। ফলে তিনি সহায়সম্বলহীন হয়ে পড়েন। তবে দৃঢ়চেতা জানকীনাথ ব্যবসা করে নিজে নিজে বিশাল জমিদারি গড়ে তুলতে সক্ষম হন এবং “রাজা” উপাধি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন থিওজফিস্ট (দিব্যজ্ঞানবাদী) এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। জানকীনাথ ও স্বর্ণকুমারী দেবীর তিন সন্তান যথাক্রমে হিরন্ময়ী দেবী (১৮৭০–১৯২৫), জ্যোৎস্নানাথ ঘোষাল (১৮৭১–১৯৬২) এবং সরলা দেবী চৌধুরাণী (১৮৭২–১৯৪৫)। জ্যোৎস্নানাথ ঘোষাল আইসিএস পাশ করে প্রশাসনে যোগদান করেছিলেন।
প্রথম উপন্যাস: ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম উপন্যাস দীপনির্বাণ প্রকাশিত হয়। এর আগে ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে হানা ক্যাথরিন মুলেনসে এর ফুলমণি ও করুণার বিবরণ প্রকাশিত হয়। যা বাংলা ভাষার প্রথম ঔপন্যাসিকের মর্যাদা লাভ করে। কিন্তু স্বর্ণকুমারী দেবীই ছিলেন প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক। দীপনির্বাণ ছিল জাতীয়তাবাদী ধারায় অনুপ্রাণিত উপন্যাস। উপন্যাস ছাড়াও তিনি গান, নাটক, কবিতা ও বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেন। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে স্বর্ণকুমারী দেবী প্রথম বাংলা গীতিনাট্য (অপেরা) বসন্ত উৎসব রচনা করেন।
ভারতী পত্রিকা: ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর পারিবারিক পত্রিকা ভারতী চালু করেন। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল ষোলো। এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দ্বিজেন্দ্রনাথ সাত বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। এরপর এগারো বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেন স্বর্ণকুমারী দেবী। স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যারা বারো বছর ও রবীন্দ্রনাথ এক বছর এই
পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। এরপর আট বছর স্বর্ণকুমারী দেবী আবার এই পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তারপর নয় বছরের ব্যবধানে আবার স্বর্ণকুমারী দেবী এই পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন। এরপর দুই বছর সম্পাদনার পর তিনি পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন। এভাবে ভারতী পত্রিকা প্রায় অর্ধশতাব্দীকালব্যাপী প্রকাশিত হয়।ভারতী পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতে রবীন্দ্রনাথের লেখাও প্রকাশিত হয়।
রাজনীতি: স্বর্ণকুমারী দেবীর স্বামী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারি ছিলেন। ১৮৮৯ ও ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে পণ্ডিতা রামাবাই, রামাবাই রানাড ও কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনিও জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন প্রথম মহিলা যিনি জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রকাশ্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
সখীসমিতি: অনাথ ও বিধবাদের সাহায্যার্থে ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে স্বর্ণকুমারী দেবী “সখীসমিতি” স্থাপন করেন। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সখীসমিতি সক্রিয় ছিল। তারপর হিরন্ময়ী বিধবা আশ্রয় এর দায়িত্বভার গ্রহণ করে। স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা হিরন্ময়ী দেবীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায় বরানগরে একটি

বিধবা আশ্রম চালু করেন। এই আশ্রমের নাম ছিল “মহিলা বিধবা আশ্রম”। হিরন্ময়ী দেবীর মৃত্যুর পর এই আশ্রমটির নতুন নামকরণ হয় “হিরন্ময়ী বিধবা আশ্রম”। “সখীসমিতি” নামটি রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। সরলা রায়ের অনুরোধে সখীসমিতির অর্থসংগ্রহের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ “মায়ার খেলা” নৃত্যনাট্যটি লিখে মঞ্চস্থ করেছিলেন।
সাহিত্যকর্ম: উপন্যাস: দীপনির্বাণ (১৮৭৬), মিবার-রাজ (১৮৭৭), ছিন্নমুকুল (১৮৭৯), মালতী (১৮৭৯), হুগলীর ইমামবাড়ী (১৮৮৭), বিদ্রোহ (১৮৯০), স্নেহলতা (১৮৯২), কাহাকে (১৮৯৮), ফুলের মালা (১৮৯৫),[১] বিচিত্রা (১৯২০), স্বপ্নবাণী (১৯২১), মিলনরাতি (১৯২৫)। সাব্বিরের দিন রাত [১৯১২]। নাটক: বিবাহ-উৎসব (১৮৯২), বসন্ত-উৎসব, রাজকন্যা, দিব্যকমল, দেবকৌতুক, কনেবদল, যুগান্ত, নিবেদিতা । কাব্যগ্রন্থ: গাথা এবং গীতিগুচ্ছ।। বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ: পৃথিবী।
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণকুমারী দেবীকে “জগত্তারিণী স্বর্ণপদক” দিয়ে সম্মানিত করে। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা জুলাই তিনি মারা যান।