ড. মোহাম্মদ আমীন
স্যমন্তক: অষ্টচত্বারিংশ পর্ব (৪৮)
বিএ অনার্স পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে রচনা। প্রাপ্ত নম্বর বিবেচনায় তার কাছাকাছিও কেউ নেই। সাধারণভাবে যদিও পাশটা তেমন কোনো বিষয় না, কিন্তু রচনার জন্য এটি অনেক বড়ো একটা বিষয়। আমার জন্য তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। আমাকে এই কটি বছর অসহনীয় উপহাস আর নীরব অপমানের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়েছে। রচনা আসার কয়েক মাস পর থেকে প্রতিটি দিন অনেক প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হয়েছে। নানা অপবাদ শুনতে হয়েছে।
খবর জানার পর সে কারও সঙ্গে কথা বলেনি। সোজা চলে এসেছে আমার অফিসে। শিশুর মতো সবার সামনে বারবার পায়ে ধরে সালম করেছে। চোখের জলে আনন্দকে সাগর বানিয়ে আমার পুরো শরীর সিক্ত করে দিয়েছে অবলীলায়। অফিস থেকে বের হয়ে দুজন খান স্যারের অফিসে গেলাম। একই ভবনে অফিস। খান স্যার অফিসেই ছিলেন।
কেমন লাগছে, রাকু? প্রশ্ন করলেন খান স্যার।
ভালো।
ভালো লাগছে কেন?
আপনাদের সম্মান রাখতে পেরেছি তাই। আপনার স্বপশিশুকে যথাপরিচর্যায় লালন করতে পেরেছি তাই। আমার অতীতকে বর্তমান দিয়ে সম্মানিত করতে পেরেছি তাই।
খান স্যার ফোন দিলেন তাঁর স্ত্রীকে। কিছুক্ষণ কথা বলে রিসিভার দিলেন রচনাকে। খান স্যার আর ভাবি আমাদের নিয়ে দেশের বাড়ি সিলেট ঘুরতে যাবেন। রচনা খুশিতে কবুতর। আমি বিভোর।
নরেন বিশ্বাস নিমন্ত্রণ করেছেন।
মমতাজ উদ্দিন স্যার অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি তাঁর বাসাতে রচনার গান শুনবেন রচনার। শর্ত একটাই- তাঁর অনুমতি ছাড়া গান বন্ধ করা যাবে না। আজ হোক বা কাল হোক যেতেই হবে- কোনো অভিযোগ তিনি রাজি নন।
হুমায়ুন আজাদ স্যার মিষ্টি খাবেন এবং ইচ্ছেমতো আড্ডা দেবেন। আড্ডার সব খরচ তাঁর। গম্ভীর চরিত্রের কবীর চৌধুরী স্যার কিছু খাবেন না, খাওয়াবেন। অরুণাভ সরকার টাকা নিয়ে চলে গেছেন সাকুরায়। তিনি গলা ভেজাবেন আমার টাকায়।
আহমদ শরীফ স্যার শুধু গান শুনবেন। তবে রাতের বেলা না-খেয়ে আসা যাবে না। তিনি আবার আমাদের একই এলাকার মানুষ। তাই একটু আলাদা চোখে দেখেন। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের ভ্রাতষ্পুত্র আহমদ শরীফ আমার দেখা সবচেয়ে সাহসী মানুষ।
আহমদ ছফা খুশিতে টগবগ। ফোন করে বললেন, শুধু মিষ্টি খাওয়ালে হবে না।
আর কী লাগবে?
এক কার্টুন বেনসন।
আর?
তিন কেজি চা।
আর?
চার কেজি চিনি।
আর?
রচনার গান। বাসায় আসার সময় বিস্কুট নিয়ে আসতে হবে।
আর?
একটা খালি বায়ুরোধী বাক্স, কিছু রাখা যায় না, বাতাস ঢুকে নরম করে দেয়।
রিসিভার রাখতে না রাখতে আবার ফোন।
ব্রিটিশ কাউন্সিল রচনাকে সংবর্ধনা দেবে।
আমি রিসিভার রেখে রচনাকে ডাক দিলাম। পড়ার রুম থেকে ছুটে এল রচনা। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সঙ্গে কথা হলো।
“তোমার সাফল্যে সবাই খুশি”, বললাম, “আমি জানতাম না তুমি এত জনপ্রিয়। তোমার কাছে ভক্তদের অনেক দাবি।
চলো, স্যারদের বাসায় ঘুরে আসি। আগে কার বাসায়?
আজ কোথাও যাব না।
কী হয়েছে?
আজ পুরোদিন আপনার সঙ্গে থাকব, বাসার সবাই মজা করব।
আমি রাজি।
আমি একটা গান লিখেছি। এটা সুর করে আপনাকে শোনাব। তারপর গল্প হবে সারা রাত। আমার সব প্রাপ্তি সে তো আপনারই দান। এ দিনের ভাগ কাউকে দেব না। কোনোভাবেই না।
সুর করতে কয়দিন লাগবে?
একটা খসড়া কম্পোজিশন ঠিক করেছি। আর একটু দেখলে হবে। খসড়টা শোনাই?
হ্যাঁ।
আল্পু-কল্পু ধরাধরি করে হারমোনিয়াম নিয়ে এল। রচনা হারমোনিয়াম নিয়ে উত্তরমুখী হয়ে বসে গাইতে শুরু করল:
বৃষ্টি দিল তাল,
তুমি মধুর নতুন জীবন,
স্বপ্ন দেউল ভাল।
ছিলাম আমি তৃষ্ণা কাতর
শুকিয়ে যাওয়া নদী
ফুলেল স্রোতে ভাসিয়ে দিলে
আমায় নিরবধি।
প্রাণ পেয়েছে মন, বিভোর এ জীবন
তোমার ছোঁয়া নিত্য মায়া অনন্ত সকাল।
কাব্য-কবি কেউ ছিল না
শুধুই শূন্য খাতা,
কল্পলোকের গল্প দিয়ে
ভরিয়ে দিলে পাতা।
আর কিছু না চাই, তোমায় যেন পাই।
তুমি আমার ভালোবাসার মুক্ত মহাকাল।
গান শেষ হলো, গানের রেশ শেষ হলো না। আরও বেড়ে গেল বরং। আমি জলভরা চোখে রচনার দিকে চেয়ে রইলাম পূর্ণ কৃতজ্ঞতার নীরব আনন্দে। এভাবে গান আর ভালোবাসা চিরস্থায়ী হয়ে থাকে।
এটি কি শুধু গান?
না। আপনার প্রতি আমার উপহার। কৃতজ্ঞতার নৈবদ্য।
শুবাচ গ্রুপের লিংক: www.draminbd.com
তিনে দুয়ে দশ: শেষ পর্ব ও সমগ্র শুবাচ লিংক