বাইরে বৃষ্টি।
সচিবালয়ের মতো এত বিশাল বিশাল ভবনে বৃষ্টি দৃষ্টি টানতে পারে না কারও, মন দূরের কথা। রাকু বারান্দায় হাঁটছে আনমনে, ফোঁটা ফোঁটা বিষণ্ন মায়া জড়িয়ে তার অনিমিখ চেহারায়।
খাঁটি আমলার মতো আমি তাকে দেখেও না-দেখার ভান করে নিজের রুমে ঢুকে পড়লাম। চাকরিপ্রার্থী, পরন্তু যুবতি মাখামাখি ঠিক হবে না। আমার চোখ দুটি, বাইরের হাজার হাজার চোখ আমাকে দেখছে। একটু সুযোগ পেলে কথার পিঠে কথা ছড়িয়ে হেনস্তা করতে ছাড়বে না। তাছাড়া মেয়েটাই বা কী মনে করবে!

হাজিরা খাতাটা দেখে পিয়নকে বললাম, মেয়েটাকে আমার রুমে বসতে বলো। তারপর সোজা খান স্যারের রুমে চলে গেলাম। তিনি সম্ভবত আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মুখে সিগারেট, সামনে সিগারেটের প্যাকেট, তার ওপর একটি নতুন লাইটার। গতকাল অন্য লাইটার ছিল। সিগারেট বেশি টানলে লাইটারও বেশি বদলাতে হয়।
: নিয়োগটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দাও। ইফাদ তাগিদ দিচ্ছে, জানতে চাইছে নিয়োগের খবর। প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে শেষ করতে হবে। নইলে বিপদে পড়ে যাব। অনেক টাকার প্রকল্প, অনেক গরিবের ভাগ্য। এমনিতেই আমাদের দক্ষতা নিয়ে দাতাগোষ্ঠীর যথেষ্ট সংশয় আছে।
: যথাসময়ে শেষ হবে স্যার। স্যার আমার … একটা …
খান স্যার স্নেহমাখা ধমকে বললেন, যা বলার সরাসরি বলো?
: মেয়েটার কথা বলতে এসেছিলাম।
: কোন মেয়ে?
: রাকু।
: কী হয়েছে?
: স্যার, আপনার মনটা কী ভালো?
খান স্যার সিগারেটের কিছু ধোঁয়া মুক্তা-দাঁতের চিকন হাসির ফাঁক দিয়ে ছুড়ে দিয়ে জানালায় ঝাপটে পড়া বৃষ্টির কণার দিকে তাকিয়ে বললেন, “মন মোর মেঘের সঙ্গী, উড়ে চলে দিক-দিগন্তের পানে নিঃসীম শূন্যে, শ্রাবণ বর্ষণ সংগীতে- রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম …।” কী বুঝলে?
আমি বললাম, মন ঘামিয়ে দেওয়ার মতো কথা হলে বলা যাবে, নইলে চুপ করে বের হয়ে যেতে হবে। বর্ষায় গ্রীষ্ম অনাকাক্সিক্ষত।
: রাইট। নাউ ইউ ক্যান সে অর গেট লস্ট, লেট মি সি দা রেইন।It’s a rainy day. It’s the myth of a rainy mind.
আমি বললাম, স্যার, I always like walking in the rain, so no one can see me crying.
: মন ঘেমে গেছে বাবা, বলো কী বলতে চাও।
: মেয়েটাকে নিয়োগ দিতে চাইছি না। আপনি অনুমতি দিলে প্রকল্প থেকে ঋণ দিতে পারি।
: বাছা, তুমি বিপদে ফেলতে চাও আমাকে?
: আমাদের প্রকল্পের কাজ দুর্গতদের সাহায্য করা। মেয়েটা দুর্গত, তাই না স্যার?
খান স্যার আর একটা সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে বললেন, দুর্গতদের নয়, কেবল চারটি উপজেলার বাসিন্দাদের মধ্যে যারা ঘূর্ণিদুর্গত কেবল তারাই এই প্রকল্পের সুবিধাভোগী। মেয়েটি দুর্গত, কিন্তু ঘূর্ণি-উপদ্রুত নয়। তার বাড়ি প্রকল্প-এলাকায়ও নয়।
: কিন্তু …।
খান স্যার বললেন, আমাদের প্রকল্পের কাজ কী?
: ঘূর্ণি-উপদ্রুত চার উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষদের সার-বীজ, গোরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি প্রদান। যারা নৌকা হারিয়েছে তাদের নৌকা এবং যারা ফিশিং-ট্রলার হারিয়েছে তাদের ট্রলার কেনার জন্য নামমাত্র শর্তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান।
: তুমি মেয়েটাকে কী দেবে?
: ফিশিং ট্রলারের জন্য সর্বোচ্চ পঁয়ত্রিশ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া যাবে। সুদের হার এক শতাংশ, বিশ বছরের মধ্যে পরিশোধ করলে হবে।
স্যার বললেন, কী বলতে চাইছ সোজাসুজি বলো।
: যদি আশ্বস্ত করেন, তাহলে একটা প্রস্তাব দিই স্যার?
: বলো?
আমি সাহস করে বললাম, মেয়েটার বাবাকে প্রকল্প এলাকার ঘূর্ণি-উপদ্রুত দেখিয়ে পঁয়ত্রিশ লাখ টাকা ঋণ দিলে কেমন হয় স্যার?
: তুমি পাগল হয়ে গেছ।
চিৎকার দিয়ে চেয়ার হতে লাফিয়ে উঠলেন খান স্যার। তার হাত থেকে সিগারেটের পোড়া অংশ মেঝের কার্পেটে পড়ে গেল। স্যার নিচু হয়ে ওটি তুলতে গেলেন। তার আগেই আমি সেটি তুলে নিয়ে অ্যাস্ট্রেতে এমনভাবে রেখে দিই, যাতে স্যার ইচ্ছে করলে আবার টানতে পারেন। স্যারের এমন আকস্মিক রাগ আগে দেখিনি। শরীর কাঁপছে তাঁর। এই প্রথম খান স্যারের সিগারেট-বিহীন হাত দেখলাম।
: শোনো?
: স্যার।
: তুমি যা করতে চাইছ, তার পরিণাম কী হতে পারে জানো?
: চাকরিচ্যুতি।
: জেল-জরিমানা পর্যন্ত হতে পারে। এখনও করবে?
: আপনি যদি অভয় দেন করব।
: ছেলে, তোমার সাহস তো কম নয়। যদি কেউ কমপ্লেইন করে বসে?
: আপনি থাকলে কাউকে ভয় পাই না।
কিছুক্ষণ ঝিম ধরে থাকলেন খান স্যার। তারপর আমাকে কাছে ডেকে মাথাটা নিচু করতে বললেন। আমি মাথা নিচু করতেই স্যার হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, অত সাহস ভালো না।
: এছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না স্যার।
খান স্যার দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, আমি তোমাকে সাহায্য করব। সকল মহৎ কাজে বিপদের আশংকা থাকে। এই বিপদ মায়ের প্রসব বেদনার মতো আনন্দকর।
আবেগ একটু বেশি উথলে উঠেছিল সেদিন। স্যারের পা দুটো শ্রদ্ধায় ছুঁয়ে দিলাম। স্যার আবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ডিয়ার বয়, লিসেন।
: স্যার।
: তুমি চাকরিতে উন্নতি করতে পারবে না বাট পরোন্নয়নে কেউ তোমার ধারে-কাছেও যেতে পারবে না। যাদের এমন মন, তারা প্রতিপদে ঈর্ষার শিকার হয়।
: কেন স্যার?
: উপকারী গাছটা সবার সার্বক্ষণিক নিষ্ঠুরতার শিকার হয়। তবে তুমি সুখী হবে। তোমার দেওয়ার ইচ্ছে প্রবল, পাওয়ার আশা নেই।
মনের খুশিতে নিজের গুনগুন গানে নিজের কানকে তৃপ্ত করতে করতে রুমে এসে ঢুকলাম। রাকু বসে আছে। তার চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল।
আমি বললাম, বসো মেয়ে।
: স্যার, চাকরিটা আমার হবে তো?
: তুমি এখন বাসায় চলে যাও। খবর দিলে চলে এসো।
আমার কথায় কী বুঝেছে জানি না, বড়ো বড়ো চোখে আমার দিকে তাকিয়ে কিছু মায়া ঢেলে দিল। তার মায়া আমার সহানুভূতিকে ঝাঁকি দিল প্রবল।

আবার তাকালাম তার দিকে। চোখ জলে টলমল, মনে হলো চোখের জলে তার স্বপ্নের নৌকাটা ভীষণ ঝড়ে দুলছে। এ ঝড় ঘূর্ণিঝড় নয়, আশঙ্কার দীর্ঘশ্বাস। বাইরে বৃষ্টি আরও প্রবল: God is a cloud from which rain fell.
: কিছু বলবে?
: স্যার, চাকরিটা পাচ্ছি তাহলে।
: সময় হলে জানতে পারবে।
: স্যার, বেঁচে থাকার জন্য চাকরিটা খুব প্রয়োজন। টাকা ছাড়া জীবন অর্থহীন। অর্থই নির্ধারণ করে মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। অতীতও নিয়ন্ত্রণ করে অর্থ ।
: মন্দ বলোনি।
আদিল বলল, টাকা সুখ কিনতে পারে না, দিতেও পারে না।
রাকু বলল, বস্তিতে গরম ভ্যাপসার মারাত্মক দুর্গন্ধে হাহাকার করার চেয়ে ফ্ল্যাট বাড়িতে মরে যাওয়া অনেক ভালো। অন্তত আমার লাশ দেখার জন্য যারা আসবেন তারা শান্তিতে আসতে পারবেন, বসতে পারবেন, কাঁদতে পারবেন। স্যার, আমার চাকরিটা হবে তো?
আমি বললাম, চিন্তা করো না, চাকরির চেয়ে ভালো কিছু হবে।
: স্যার ক্ষুধার্ত পেট খাদ্য চায়, ফুল তার কাছে উপহাস। আমি ক্ষুধার্ত। আমার ভাত চাই এক গ্রাস। ফুলের রঙে আমি রক্ত দেখি।
: খাদ্য আর ফুল দুটোই যদি দেওয়া হয়?
: স্যার, এমন ভাগ্য কি আমার হবে?
: সহমর্মিতার হাত এগিয়ে এলে কি না করা যায়! হাতই সৃষ্টি, হাতই নাশ, হাতই সুন্দর, হাতই অভিলাষ। এই হাত দিয়েই পৃথিবীর মহৎ কাজগুলো হয়েছে, অবশ্য খারাপ কাজগুলোও হয়ছে হাতে। এজন্য হাত দায়ী নয, দায়ী মানুষের ইচ্ছে আর মন।
আমার কথায় রাকুর মুখে আশার কিরণ দেখা গেল। একটু হেসে আমাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে অনেকটা আশা নিয়ে বের হয়ে যেতে যেতে বলল, স্যার, আমি কখন আসব?
বললাম, দুদিন পর।
ইদানীং ও ইদানীং-এর বিপরীতার্থক শব্দ