আমি রচনার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। পাহাড়ি মহিলার পোশাক পরেছে আজ। তাঁর এক পাহাড়ি বন্ধু বেড়াতে এসেছে—অনামিকা চাকমা। ড্রয়িংরুমে গোল হয়ে বসে গল্প করছি। আমার ডান পাশে রচনা, তার পাশে অনামিকা। বাম পাশে আল্পু আর কল্পু। টুটুল আর নিনি অন্য রুমে- খেলছে বা পড়ছে। নিনি এখন আর আশ্রয়হীন নয়। তার চামড়া আর হাড়ের মাঝখানে মমতার ঢেউ। কথাও শিখে ফেলছে দ্রুত। লিখতে পারে এখন, বানান করে পড়তেও পারে।
স্যার, কী দেখছেন?
মেয়েরা ঐশ্বর্যের ভান্ডার নিয়ে পৃথিবীতে আসে।
“এজন্যই এত লোভ আমাদের প্রতি দীন পুরুষদের,” বলল অনামিকা চাকমা, “আমার কথা নয়, আমাদের এক ম্যাডামের কথা।”
দীন হবে কেন? আমি প্রশ্ন করলাম।
অনামিকা বলল, পৃথিবীতে অনেক পুরুষ মেয়ে হওয়ার জন্য কতকিছু করেছে, অনেকে জীবন পর্যন্ত দিয়েছে। কিন্তু কোনো মেয়ে পুরুষ হওয়ার আগ্রহ পর্যন্ত দেখায়নি। ক্লীবলিঙ্গের কাউকে স্যার আপনি পুরুষ সাজতে দেখেছেন? সবাই মেয়ে সাজে।
আমি বললাম, পুরাকালে এক যুবক ভগবানের প্রার্থনায় এত মশগুল হয়ে পড়লেন যে, স্বয়ং ভগবান তার সঙ্গে দেখা করার জন্য মর্ত্যে চলে এলেন। যুবককে বললেন, তুমি যেকোনো দুটো বর চাইতে পার। প্রথমটি বলো। যুবক বলল, প্রভু, আমি তিন বছরের জন্য নারী হয়ে থাকতে চাই। তথাস্তু, দ্বিতীয় বর? যুবক বলল, তিন বছর পর চেয়ে নেব প্রভু। তিন বছর পর সে আবার পুরুষ হয়ে গেল। ভগবান এসে বললেন, এবার দ্বিতীয় বর চাও বৎস, আমি দিতে প্রস্তুত। যুবক বলল, প্রভু আমাকে চির জীবনের জন্য মেয়ে করে দিন।
রচনা বলল, পুরুষের ওপর নারী জাতির লোভ সেই অ্যাডামের যুগ হতে। ইভটিজিং শব্দটির সঙ্গে অনেকে ইভকে টিজ করার সূত্র খোঁজে।
আমিও তো শুনি।
অনামিকা বলল, পুরুষগুলো প্রায়শ ব্যক্তিত্বহীন। ক্ষুধার্ত পশুর মতো ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে থাকে। লোভের লালায় ভেসে যেতে থাকে ব্যক্তিত্ব। চারদিক হতে ঘিরে ধরে কাপুরষতা। আমি বুঝি না মানুষ হয়ে কেন তারা এত নির্লজ্জ হয়।
আমি বললাম, সুন্দরের প্রতি আগ্রহ দেখাতে লজ্জা কিছুটা বিসর্জন দিতেই হয়। ব্যক্তিত্ব আর লজ্জা বেশি হলে তো চোখই খোলা যাবে না। আমিও তো পুরুষ?
কল্পনা বলল, বাবা কীভাবে পুরুষ হয়?
বাবা কী হয়? আমি বললাম।
টুটুল বলল, বাবা, আপনি হন।
কল্পনা বলল, বাবা কেবল বাবা হয়, আর কিছু নয়।
আল্পনা বলল, বাবা যদি পুরুষ হয়, বাবা হবে কে?
কলিং বেল বেজে উঠল হঠাৎ। নিনি গিয়ে দরজা খুলে দিল।
“ভাই আমাকে বাঁচান”, বলতে বলতে রুমে ঢুকলেন ছয় তলার ভাড়াটে নোটারি পাবলিক মঞ্জুর সাহেবের স্ত্রী মালিহা ভাবি। তিনি এমনভাবে কথাটা বললেন— আমি ভয় পেয়ে গেলাম।
কী হয়েছে?
থানায় গিয়েছিলাম মামলা করতে, থানা মামলা নিল না। আপনি সাহায্য না করলে আমি ভাই আত্মহত্যা করে মরব। ওসি সাহেবকে একটু বলে দিন।
বিষয়টা খুলে বলুন।
ভাই আমার ছেলেটা কী ফরসা আপনি দেখেছেন, লাখে এমন সুন্দর ছেলে মেলে না। একদম বাপের মতো ধবধবে সাদা। সূর্যের আলোর মতো। সে গতকাল একটা কুচকুচে কালো মেয়ে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে।
রচনা বলল, ফরসা এক ধরনের রোগ। শরীরে মেলানিনের পরিমাণ কমতে থাকলে মানুষ ফরসা হতে শুরু করে। এ বয়সে আপনার ত্বকের চমক দেখেছেন? আপনার ফরসা ছেলের চামড়ার সঙ্গে মিলিয়ে নেবেন আজ, দেখবেন- কেমন খসখসে। বেশি ফরসা হলে ডাক্তারেরা বলে শ্বেতরোগ।
আমি বললাম, ভাবী, রং নয়, গুণই আসল।
মালিহা ভাবি বললেন, এগুলো ভাই কথার কথা। আমার গায়ের রং একটু কালো ছিল। তাই পাত্রপক্ষ আমাকে দেখে কালো বলে চলে যেত। শেষমেষ জমিজমা সব বিক্রি করে মোটা অঙ্কের যৌতুক দিয়ে আমাকে বিয়ে দিতে হয়েছে। তারপরও শ্বশুরবাড়িতে আমাকে কালো বলে নানা গালি শুনতে হয়েছে। মা-বাবা আমার চিন্তায় ঘুমাতে পর্যন্ত পারত না। আমার সুখের জন্য মা-বাবা শেষ পর্যন্ত ফতুর হয়ে গিয়েছিল।
এখন কী করতে চাইছেন? আমি প্রশ্ন করলাম।
আপনি ভাই থানায় বলে দেন। আমি ওই কালো পেতনি মেয়ে আর তার মা-বাবার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করব।
আবার কলিং বেল।
আমি বললাম, আল্পু, কে এসেছে দেখো।
কল্পনাকে যেতে হলো না, নিনি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল।
রুমে ঢুকলেন আফজল হক চৌধুরী ও তার স্ত্রী ফিরোজা বেগম চৌধুরানি। ওরা ঢুকার পর মালিহাভাবি তার মুখটা বোরকার জিহ্বা দিয়ে ঢেকে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। আমি অবাক হয়ে তার চলে যাওয়ার মধ্যে লজ্জা আর ভয়ের মিশ্রণ দেখলাম।
অনামিকা বলল, শরীরের রং কৃষ্ণ বলে, যে মেয়েটির বিয়ে দিতে তার সচ্ছল পিতা অসচ্ছল হয়ে পড়েছিল, মেয়ের শ্বশুরবাড়ির কালি-গালিতে যে কৃষ্ণ মেয়ের পিতা-মাতা বছরের পর বছর ঘুমাতে পারেননি শান্তিতে, সে কৃষ্ণবর্ণের মেয়েটি তার শ্বেতরোগে আক্রান্ত ফরসা ছেলেটির জন্য ধবধবে সাদা আর একজন শ্বেতরোগী খুঁজছেন। মানুষের এমন সাংঘর্ষিক ব্যবহার সত্যি বিস্ময়কর। আসলে স্যার, মানুষের চেয়ে অমানুষ কেউ নেই।
মিসেস আফজল বললেন, আস্তে বলো, শুনবেন। তিনি এখনো দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে।
আল্পনা বলল , শুনুক, এমন বর্ণবাদীদের আমার সহ্য হয় না একদম।
মিসেস আফজল অনুরোধের গলায় রচনাকে বললেন, নাতিন, অনেক দিন না-করেছেন। এবার না-করতে পারবেন না।
বলুন।
আমার মেয়েটাকে পড়াতেই হবে। আপনার একটা রচনায় আমার মেয়ের জীবন বদলে গেছে। আগে লেখাপড়ায় খুব ফাঁকি দিত, এখন পড়ার জন্য সারাক্ষণ উন্মুখ হয়ে থাকে। পুরস্কার তার জীবনকে পুরস্কৃত করে দিল।
দাদি, আমার যে একেবারেই সময় নেই।
তাহলে মেয়েটা এবারও ফেল করবে।
আমি বললাম, আগে না একজন পড়াত, সে কোথায়?
মিসেস আফজল মুখটাকে বিকৃত করে বললেন, মেয়ের জন্য কোনো পুরুষ শিক্ষক আর কখনো রাখব না। দরকার হলে লেখাপড়া বন্ধ করে দেব। যতটা ছেলে শিক্ষক রেখেছি সবটাই মেয়েটার সঙ্গে অসভ্যতা করেছে। টেবিলের নিচে পা দিয়ে সুড়সুড়ি দিয়েছে। বুকে হাত দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কী এক জ্বালা, আসলে ভাই পুরুষ মাত্রই জানোয়ার।
রচনা বলল, সেই সবচেয়ে নিকৃষ্ট পুরুষ যে তার ছাত্রীর দিকে যৌনদৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
মিসেস আফজল বললেন, তাহলে তো সব পুরুষই নিকৃষ্ট।
রচনা বলল, সব না দাদি, বলতে পারেন প্রায় সবাই।
আফজল চৌধুরী বললেন, বড়ো শরমের হথা, পুরা দেশ্যনাত এন্ডিলা অদ্দে। হডে যাইয়ুম বাজি। হারে বিশ্বাস গইজ্জুম। হট্টা অজুর তারা আরো শতান। গুরা গুরা মাইয়া পোয়ালল্লই পর্যন্ত হারাপ হাম গরে। মরদ পোয়ারে ন-ছাড়ে।
আমি বললাম, দাদি কত সুন্দর বাংলা বলেন।
আফজল চৌধুরী বললেন, অনর দাদি চিটাইঙ্গা নয়, বিক্রমপুইজ্জা মাইয়ো পোয়া। এতল্লাই ছাবাইয়া হথা হইদে। আঁই তো ওবা চিটাইঙ্গা। আঁই তো চিটাইঙ্গা গান উনাইয়ের অনর দাদিরে পঅল বানাইদি।
কী গান শোনাতেন? আমি বললাম।
কী জ্বালা দি গেইলা মোরে, নয়নের কাজল পরানের বন্ধুরে ন দেহিলে পরান পুড়ে—। অনরার পইট্যার আশকর আলী পণ্ডিতর গান।
মিসেস আফজল বললেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আমার মেয়ে পড়াতে রাজি না-হবে ততক্ষণ আমি ওঠব না। অবস্থান ধর্মঘট করলাম। দেখি কীভাবে ফেরাও।
রচনা হেসে বলল, আপনারা আমাদের অভিভাবক। কত বিপদে-আপদে সাহায্য করেন। আমি তাকে যতটুকু পারি সময় দেব।
মিসেস আফজল খুশি হয়ে রচনাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, বড়ো বাঁচালে বোন।
আফজল চৌধুরী বললেন, মাসে হ ট্যায়া দিওম ওবা নাতিন? যেট্টা হও এট্টা দিয়ম। আঁই রাজার পোয়া, চৌধুরী বংশ, চাটগাঁইয়া মানুষ। বাঁচিলে লাখ, মরিলে কোটি। হন ওবা, হ ট্যাঁয়া দেওন পড়িব।
মিসেস আফজল ধমক দিয়ে বললেন, চাটগাঁইয়া মানুষ খালি টাকা টাকা করে; শুঁটকি বেপারি, অশিক্ষিত সব, ভালোভাবে কথাটা পর্যন্ত বলতে পারে না; টাকা ছাড়া কিচ্ছু চিনে না। কোথায় কী বলবে তাও বুঝে না। বেহায়ার মতো এসব কী বলছ? আস্ত একটা বলদ।
আফজল চৌধুরী বললেন, ভুল হয়ে গেছে গিন্নি।
তুমি সবসময় এমন ভুল কর। আক্কেল বলতে কিছু নেই।
আফজল চৌধুরী বললেন, তুমি কাছে থাকলে আমি যে সব ভুলে যাই। দোষ তোমার না আমার?
“কইলজার ভিতর গাঁথি রাইক্কুম তোঁয়ারে
সিনার লগে বাঁধি রাইক্কুম তোঁয়ারে, ও ন নাইরে
সিনার লগে বাঁধি রাইক্কুম তোঁয়ারে।”
থামো, বুড়ো বয়সে আর আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না।
গিন্নি, যা ইচ্ছা কও। জোয়ান হালে দিন আছিল বাইট্টা, বছর আছিল লাম্বা। এহন বছর অই গিয়ে বাইট্টা আর দিন অই গিয়ে লাম্বা। এতল্লাই মাঝে মাঝে মাথা হারাপ অই যাইগুই। আই কিরজুম!
রচনা বলল, আমাকে কোনো টাকা দিতে হবে না। তবে একটা জিনিস দিতে পারেন।
থাকলে দেব।
এটি সবার আছে। মন থাকলে যে কেউ দিতে পারে।
বলো, বলো; স্বামী-স্ত্রী দুজন একসঙ্গে বেচয়েন গলায় বলে ওঠলেন, “কী দিতে হবে?”
প্রথম দিন থেকে যা দিয়ে আসছেন, তা।
কী?
রচনা বলল, ভালোবাসা।
মিসেস আফজল চৌধুরী আবার রচনাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তোমার মতো যদি সবাই বস্তির মেয়ে হতো! দুনিয়াটা সুন্দর বসতি হয়ে ওঠত।
ইদানীং ও ইদানীং-এর বিপরীতার্থক শব্দ