স্যমন্তক: ঊনচত্বারিংশ পর্ব

ড. মোহাম্মদ আমীন

স্যমন্তক: ঊনচত্বারিংশ পর্ব (৩৯)

টেবিলে একটা চিঠি।
খামের উপর আমার নাম, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা শাখা থেকে এসেছে। বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। শৃঙ্খলা শাখা থেকে কেবল বিশৃঙ্খল করার চিঠিই আসে। তাড়াতাড়ি খুলে ফেললাম।
চিঠি পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমাকে শোকজ করা হয়েছে। অনেকে শোকজ লেটারকে ব্যঙ্গ করে পাতলা কাগজ বলে। টাইপ-রাইটারের যুগে পাতলা কাগজে এসব চিঠি লেখা হতো। তাই পাতলা কাগজ।
শোকজের কারণ বেশ জটিল— অবিবাহিত পুরুষ হয়েও অনাত্মীয় ও অবিবাহিতা এক যুবতি মেয়ের সঙ্গে একই ঘরে বসবাস করছি। আমার কর্মকাণ্ড প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। তাই কেন আমার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি, ১৯৭৯ অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, আগামী দশ দিনের মধ্যে সন্তোষজনক জবাব দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
সংস্থাপন সচিবের কাছে গেলাম। কয়েক বছর আগে তাঁকে আমার ভোটাতো মন্ত্রীর মাধ্যমে একটা ভালো পোস্টিং পাইয়ে দিয়েছিলাম। সচিব হওয়ার পর তিনি সে কথা নিশ্চয় ভুলে গিয়েছেন। উপকারীর উপকার ভুলে যাওয়া মানুষের খুব সাধারণ স্বভাব। না-ভোলাটাই অস্বাভাবিক। অসাধারণ হওয়া এত সহজ নয়।
নইলে পাতলা কাগজ কেন?
সচিব আমাকে দেখে এমন একটা দৃষ্টি ফেললেন যেন, তিনি জানতেন আমি আসব না। তবু এসে গেছি। তার মানে আমার অধঃপতন ঘটেছে। পাতলা কাজ দিয়ে তিনি আমার পাতলা পায়খানা শুরু করে দিতে পেরেছেন। মনে মনে এটাই তার আনন্দ, এটাই তার অহংকার। উপকারীর অপকার না-দেখলে উপকৃতের সফলতার স্বাদ অনেকাংশে অপূর্ণ থেকে যায়। তাই উপকারীকে সর্বদা হেনস্তায় পড়তে হয়।
কেমন আছ?
Don’t tell your friends about your indigestion. ‘How are you’ is a greeting, not a question. সচিব মহোদয়ের প্রশ্নটা আসলে কোনো প্রশ্ন নয়। এমন শোকজ নোটিশ পাওয়ার পর মন কারো ভালো থাকার কথা নয়।
তবু বললাম, ভালো আছি।
ভালো থাকলে কেউ আমার কাছে আসে না। তুমিও আসতে না। পাতলা কাগজ পেয়েছ না?
পেয়েছি।
এবার পাতলা পায়খানা শুরু হয়ে যাবে। মনে হয়ে অলরেডি শুরু হয়ে গেছে। নইলে তো তুমি আমার কাছে ছুটে আসার বান্দা নও। কত বানরকে মানুষ করেছি, তুমি কী ছাড়! খুব বেশি তাফালিং  শুরু করে দিয়েছিলে। 
আমি বললাম, আল্লাহ কোনো বানরকে মানুষ করেননি, ডারউইন করেছেন। আল্লাহই মানুষকে মানুষের কৃতকর্মের জন্য শাস্তিস্বরূপ বানর করে দিয়েছিলেন— পবিত্র কোরআনে তেমনই লেখা আছে।
সচিব সাহেব বললেন, তোমার কপালে দুঃখ আছে। তুমি মুসলিম হয়ে ডারউইনের তত্ত্ব বিশ্বাস কর।
আমি কই করলাম? আপনিই তো বললেন— 
তুমি সবসময় ওভার স্মার্ট, এটি ভালো না।
আমি তাহলে আসি?
শোকজের জবাবটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দিও। তোমার হাত আবার অনেক লম্বা। ওই হাতগুলো এখানে লাগাতে পারবে না। তোমার হাতে যা ময়লা জমেছে তা ধরে কেউ নিজেদের গায়ে দুর্গন্ধ মাখাতে চাইবে না। এবার ফাঁদে পড়ে গেছ তুমি।
কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না।
এক ঝাঁক যুবতি মেয়ের সঙ্গে একই বাসায় থাকছ, কাজটা কি ভালো হচ্ছে? এজন্য শোকজ, কাউকে বলতে পারবে লজ্জায়?
তাঁর সঙ্গে আলাপ করে লাভ নেই। ভয়ঙ্কর স্যাডিস্ট তিনি। বের হয়ে সোজা চলে যাই খান স্যারের কক্ষে। তিনি দুজন অবসরপ্রাপ্ত সিএসপির সঙ্গে গল্প করছিলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন খান স্যার—ফজলুর রহমান ও নুর আহমেদ। 
আমি সালাম দিলাম।
খান স্যার বললেন, রচনা কেমন আছে?
আমি শোকজ নোটিশটা খান স্যারের হাতে দিয়ে বললাম, ভালো আছে।
খান স্যার চিঠিখানা পড়ে ফজলুর রহমান স্যারের হাতে দিয়ে হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন, আপনাকে যে ছেলেটার কথা বলেছিলাম এতক্ষণ, এই সেই। দেখুন, আপনাদের হাতে গড়া প্রশাসন কী করছে।
ফজলুর রহমান স্যার চিঠিটা পড়ে বললেন, মাহবুবের স্বাক্ষর। চাকরিতে থেকে ভালো কাজ করার সুযোগ নেই। চাকরের কাজ চাকরি করা, ভালো কাজ করা নয়। বরাবরের মতো আবারও তা প্রমাণ হলো।
খান স্যার বললেন, তাই তো দেখছি, দেখে এসেছি।
মাহবুবের নারী কেলেঙ্কারির জন্য শুধু দেশে নয়, বিদেশেও প্রশাসনকে বিব্রত হতে হয়েছে। প্রেসিডেন্ট আমাকে বলেছিলেন, তাকে চাকরিচ্যুত করতে। প্রেসিডেন্টকে অনেক কষ্টে শান্ত করেছিলাম।
নুর আহমেদ স্যার বললেন, চালুনি বলে সুঁইকে কাছে ডেকে দাদা/তোমার পাছায় দেখি বড়ো একখান ছ্যাঁদা!
খান স্যার বললেন, জাঁদরেল দুই সিএসপির বউ নিয়ে কাড়াকাড়ির ঘটনা এখনও অনেকে রসিয়ে রসিয়ে বলেন। সিএসপি পরিচয় দিতে লজ্জা হয়। ওই দুজনের একজন, সহকর্মীর ভাগিয়ে-আনা বউ নিয়ে ইউরোপে মধুচন্দ্রিমাও উদ্‌যাপন করেছিলেন।
নুর আহমেদ স্যার বললেন, বগুড়ায় জেলাপ্রশাসক থাকাকালীন সিএসপি সাহিদুল আলম এক আইনজীবীর বউ ভাগিয়ে নিয়েছিলেন। প্রশিক্ষণ একাডেমির মহাপরিচালক পদে যোগদান করার সময় মুখভর্তি দাড়ি ছিল। বয়স্ক লোক, দাড়িতে খারাপ দেখাত না। একমাস পর দাড়ি উধাও।
ফজলুর রহমান স্যার বললেন, দাড়ি কাটার কারণ?
নারী।
ফজলুর রহমান স্যার বললেন, শোনো তার একটা কাহিনি। অফিসে কাজ করছিলেন সেই সিএসপি। টেলিফোন বেজে ওঠে। রিসিভার কানে তোলে সিএসপি। স্ত্রীর কণ্ঠ, কাঁদো কাঁদো স্বর—তুমি কোথায়?
অফিসে, কেন, কী হয়েছে?
সর্বনাশ হয়ে গেছে।
হোয়াট ম্যাটার?
স্ত্রী ঝংকার দিয়ে বললেন, রাখো তোমার ম্যাটার-প্যাটার। তোমারটা আর আমারটা মিলে আমাদেরটাকে মেরে শুইয়ে দিয়েছে।
আমি বললাম, স্যার কথাটা বুঝলাম না।
ফজলুর রহমান স্যার বললেন, যে মহিলা ফোন করেছে তিনি সিএসপি সাহেবের দ্বিতীয় বউ, নাম ধরো সাফিনা। ইনিই ভাগিয়ে আনা বউ। সাফিনা সিএসপি সাহেবের ঘরে আসার সময় প্রাক্তন স্বামীর সংসারে জন্ম নেওয়া শিশু সন্তানটাও নিয়ে এসেছিলেন। সেটি ফোনে উচ্চারিত আমারটা। সিএসপি সাহেবের প্রথম স্ত্রীর একটা সন্তান ছিল। প্রথম স্ত্রীকে তাড়িয়ে দেওয়ার সময় সন্তানটা রেখে দিয়েছিল সিএসপি। ওই ছেলেটা ফোনে উচ্চারিত তোমারটা। পরে সিএসপি সাহেবের ঔরসে আর সাফিনার গর্ভে আরেকটা সন্তান জন্মলাভ করে। সেটি ফোনে উচ্চারিত আমাদেরটা।
গল্প শেষ করে আমার হাতে শোকজ নোটিশটা দিতে দিতে ফজলুর রহমান স্যার বললেন, একটা মোক্ষম জবাব দিয়ে দাও, তবে আমাদের গল্পগুলো লিখে দিও না। আমি মাহবুবের সঙ্গে কথা বলব।
খান স্যার ফোনে মাহবুব সাহেবকে লাগিয়ে দিলেন।
যথাসময়ে শোকজের জবাব দিলাম।
আমার জবাব সন্তোষজনক মনে হলো না সচিবের। তিনি তদন্তের জন্য একজন কর্মকর্তা নিয়োগ দিলেন।
শুরু হয়ে গেল ডিপি— ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিংস; বাংলায় বিভাগীয় মামলা।


All Link : শুবাচে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ লেখা

স্যমন্তক: ঊনচত্বারিংশ পর্ব
স্যমন্তক: চত্বারিংশ পর্ব
স্যমন্তক: ঊনচত্বারিংশ (শুবাচ লিংক)
স্যমন্তক: চত্বারিংশ (শুবাচ লিংক)
Language
error: Content is protected !!