স্যমন্তক: ঊনপঞ্চাশত্তম পর্ব

ড. মোহাম্মদ আমীন

স্যমন্তক: ঊনপঞ্চাশত্তম পর্ব

মিষ্টি নিয়ে গেলাম হুমায়ুন আজাদ স্যারের অফিস কক্ষে। রুমে তিনি ছাড়াও আরও কয়েকজন শিক্ষক। রচনাকে দেখে হুমায়ুন আজাদ বললেন, “আমার কৃষ্ণহীরক এসেছে।” সবাই তাকালের আমাদের দিকে।
রচনা করজোরে সবাইকে  এবং আমাকে  উবু হয়ে পায়ে ধরে শ্রদ্ধা জানাল। তার প্রণতিটা ছিল অনেকটা পায়ে চুমো খাওয়ার মতো। মনে হলো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে সে এমন করেছে। লজ্জার সঙ্গে কিছু আনন্দ আর কিছু রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে আমি শিউরে উঠি। রচনার কাণ্ড হুমায়ুন আজাদ ছাড়া বাকিদের মুখ বিস্ময়ে ঢেকে দিল। হুমায়ুন আজাদ স্বাভাবিক।তিনি আমাদের জানেন।
আবেগ আমার ভেতর ঝড়ের মতো বইছে। রচনাকে টেনে তুলে জড়িয়ে ধরি, রচনাও। আমার চোখে জল, জলে সাফল্যের ঢেউ। সে ঢেউয়ে ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছে রচনা নামের বায়ু। 
তোমরা পরস্পরকে খুব ভালোবাস তাই না? হুমায়ুন আজাদ বললেন।
আমি কিছু বলার আগে রচনা তাড়াতাড়ি বলে দিল, স্যার।
হুমায়ুন আজাদ হাসতে হাসতে আমাকে বললেন, তুমি উত্তরটা দিতে পারলে না। আবেগ এত গতিহীন হলে মানুষ পাথর হয়ে যায়। পাথরে হৃদয় থাকে না। আবেগের গতি থাকতে হবে আলোর গতির অন্তত কয়েকশ গুণ বেশি। আবেগহীন মানে হৃদয়হীন। হৃদয়হীন মানুষে কোনো ভালোবাসা থাকতে পারে না। যার ভালোবাসা নেই তার কিছু নেই। এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ের উত্তরও দিতে হলো রচনাকে, বিয়ের পর তোমার কপালে খারাবি আছে।
রচনা বলল, স্যার, স্যার তো আমাকে মেয়ে ডাকেন।
হুমায়ুন আজাদ ফের হাসলেন, ভালোবাসায় ছেলেমেয়ে নেই, পত্নী-পেতনি নেই। ভালোবাসা নামের হারামজাদাটা সর্বত্র সর্বভুক, চেনে না হাসি, চেনে না কান্না, চেনে না বুড়ো, চেনে না বুড়ি। যা পায় রাক্ষসের মতো গব গব করে খাবলে খায়, পাগলা নদীর জলের মতো। এটাই যৌবন, যৌবনই ভালোবাসা, ভালোবাসাই যৌবন। এজন্য যাদের ভালোবাসা আছে তারা চিরযুবাই— হোক না বয়স একানব্বই কিংবা উনিশ।
স্যার আমাকে বুঝতে পারেন না, স্যার। শুধু বকেন, রাগেন।
“তোমাকেও একই অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পারি।”, হুমায়ুন আজাদ রচনাকে বললেন, “সে তার সমস্ত তোমাকে দিয়ে দিয়েছে, এজন্যই তুমিও তাকে বুঝতে পারছ না। বেশি কাছে নিয়ে গেলে শুধু চাপ অনুভব করা যায়, দেখা যায় না। বিশালত্বের কাছে

হুমায়ুন আজাদ

আমাদের ক্ষুদ্র দৃষ্টির ক্ষীণ শক্তি পথহারা নাবিকের মতো বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। ছায়াছবি দেখতে হয় একটু দূর থেকে।” 
আমার একটা কথাও শোনেন না, আবার অভিযোগ রচনার।
বেশি পেলে এমন হয় গো জননী। যা চাইবে বুক ভরে চাইবে, মন ভরে নেওয়ার জন্য। কোনো ফাঁক রাখবি না। ফাঁক মানে কি জানিস?
স্যার।
জোর করে অধিকার আদায়ের ব্যর্থতা। যা প্রত্যাশা করিস, তা দরকার হলে জোর করে নিয়ে নিবি। চল, আজ একসঙ্গে খাব। দেখব, কত রাগ তোর স্যার-বাবার। এই আমলা, বিলটা তোমাকেই দিতে হবে।
আমি খুশি হয়ে বললাম, ঠিক আছে স্যার।
সহকর্মীগণকে বিদায় করে দিলেন হুমায়ুন আজাদ। তারপর কক্ষ হতে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুদূর এসে দুটো রিকশা নিয়ে উঠে পড়লাম— একটায় আমি আর রচনা, আরেকটিতে হুমায়ুন আজাদ। রেস্টুরেন্টে ঢুকে হুমায়ুন আজাদ বললেন, আমি কিন্তু একশ শুয়োরের সঙ্গে একশ বছর থাকতে পারব, কিন্তু একজন আমলার সঙ্গে এক মিনিটও না।
আমি তো আমলা। আমার সঙ্গে এতক্ষণ কীভাবে থাকলেন?
আমলারা লেখে না কি? তুমি তো লেখক।
হ্যাঁ, আমি লেখক। আমি কখনো আমলা ছিলাম না, হবও না কখনো। ওই পরিচয়টা দিতে পুলক অনুভব করি না। লজ্জা লাগে বরং।
বলো তো শাশ্বত প্রেম কী? হুমায়ুন আজাদ বললেন।
আমি আর রচনা অবাক হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম, কিন্তু উত্তর দিতে পারলাম না। হুমায়ুন আজাদ বললেন, বলতে পারবে না, আমি বলছি।
বলুন।
একজনের শরীরে ঢুকে আর একজনের স্বপ্ন দেখা। আমার কথা নয়, রচনার কথা। সে পরীক্ষার খাতায় রোমান্টিক কবিতার বর্ণনায় এই বাক্যটিই ব্যবহার করেছে। কী, রসনা মা, আমি ঠিক বলছি না?
রচনা একটু লজ্জা পেয়ে ঠোঁট-ঢাকা হাসি দিয়ে বলল, নম্বরের জন্য লিখতে হয়।
হুমায়ুন আজাদ বললেন, জীবনের নম্বরের জন্যও একই হিশাব।
একটু থেমে আমার দিকে তাকিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, তোমার কি কোনো গার্ল ফ্রেন্ড আছে?
নেই।
তোমার আর রচনার সম্পর্ক নিয়ে আমার একসময় কৌতূহল ছিল এখন নেই। তোমাদের আমি বিশ্বাস করি, যদিও ঈশ্বরে বিশ্বাস

ড. মোহাম্মদ আমীন

নেই। তোমাদের আনন্দ আমাকে নতুন অনুভাবনায় মুগ্ধ করে দিয়েছে।
রচনা বলল, আনন্দ কী স্যার?
আনন্দকে ভাগ করলে দুটো জিনিস পাওয়া যায়— একটি জ্ঞান আর একটি প্রেম। জ্ঞানকে ভাগ করলে তিনটি জিনিস পাওয়া যায় প্রথমত জানা, দ্বিতীয়ত জানার বাইরের কোনো জিনিস জানার আগ্রহ এবং তৃতীয়ত এই দুটোর পরিপ্রেক্ষিতে অবাস্তব কোনো বিষয় বিশ্বাস করার আগে ভালোভাবে পূর্বাপর আনুপূর্বিক বিচার-বিশ্লেষণ। এটাও আমার কথা নয়, রচনার খাতার কথা। এত নম্বর তো আর এমনি এমনি পায়নি।
আমি বললাম, প্রেম?
“ঠিক বলতে পারব না।”, হুমায়ুন আজাদ বললেন, “তোদের হৃদমিতালি দেখে আমার মনে নির্বোধের মতো যে রোমাঞ্চ সৃষ্টি হয়েছে সেটিই হয়তো প্রেম। রসনা তুমি প্রেম করেছ?”
এমন পরিকল্পনা তো করিনি, স্যার।
যুদ্ধ ও প্রেম কোনো পরিকল্পনা বা হিশাব মেনে চলে না। মৃত্যুর মতো হঠাৎ চলে আসে।
কথা শেষ করে একটা টিস্যু পেপার নিয়ে হুমায়ুন আজাদ চোখ মুছতে মুছতে বাথরুমের দিকে চলে গেলেন।
আমি রচনাকে বললাম, স্যার আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন।
ভালোবাসা যাকে স্পর্শ করে সে পাথর হলেও নির্ঝর বৃষ্টির মতো সরব হয়ে ওঠে। 
নাস্তার প্লেটে মুরগির হাড় রাখতে রাখতে হুমায়ুন আজাদ স্যার বললেন, তোমরা গল্প করো আমি যাই। আমি ডুবে যাচ্ছি তোমাদের আনন্দের বন্যায়, বেশিক্ষণ থাকলে নাক অবধি ডুবে যাব; নিশ্বাস নিতে পারব না ঈর্ষায়। আমার সব ঈর্ষা জুনিয়রদের প্রতি।
হুমায়ুন আজাদ  চলে যাওয়ার পর রচনা বলল, আমার এক বন্ধু সেদিন বলল, আমি না কি আপনার রক্ষিতা।
একথা বহুবার শুনেছি। কিন্তু তার বন্ধুর মুখে— লজ্জায় আমার মাথা নত হয়ে গেল। ডিপি, মায়ের অভিযোগ, সহকর্মীদের টিটকারি—সব মনে পড়ে গেল। তিনটা সোমত্ত মেয়ের সঙ্গে একই বাসায় থাকি। লোকে এমন বলতেই পারে। শহর বলে কথা, গ্রামে হলে এতদিন অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যেত।
 “দেখ মেয়ে”, রচনাকে বললাম, “আমি তোমাদের সঙ্গে থাকি বলে এসব কথা উঠছে। সবার ভালোর জন্য বলছি, আমি অন্য বাসায় চলে যাই। তোমার বন্ধুদের কাছে তুমি ছোটো হও—এ আমি চাই না। ”
আপনাকে রান্না করে খাওয়াবে কে? কে নখ কেটে দেবে, চুল টেনে দেবে, কে অসুখে সেবা করবে, কে ডেকে দেবে ঠিক সময়ে, কে জড়িয়ে ধরবে জ্বর হলে একশ চার?
ম্লান হেসে বললাম, তুমি আসার আগে যেভাবে ছিলাম, সেভাবে থাকতে শুরু করব আবার। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। পরিবেশ মানুষের আচার-ব্যবহারের নির্মাতা। মানুষ ভয়ংকর রকমের অভিযোজনক্ষম জীব।
আমি তা হতে দেব না, স্যার। আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়াও সম্ভব নয়। আপনিই তো বলেন— যে সময় যায় তা লাশের মতো যায়, পচে যায়; আর ফিরে আসে না। নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় অতীতের মতো।
কিন্তু সমাজকে তো এড়াতে পার না, পারবে কি?
আপনি কি মনে করেন, স্যার?
আমার বিষয় আমার। অন্যের মন্তব্য দিয়ে আমি কিছু বিচার করি না। পাত্তাও দিই না।
স্যার, আপনি থাকলে পুরো পৃথিবীর মন্তব্যও আমি কেয়ার করি না।
এত নেতিবাচক লোকের ভেতর ইতিবাচক থাকবে কীভাবে?
চার বছরে অনেক শক্তি সঞ্চয় করেছি। বস্তিতেও এর চেয়ে অনেক ভালো পরিবেশে ছিলাম। যত সমস্য সব মধ্যবিত্ত। তাদের বোধ-বিবেচনা অনেকটা মানুষ আর পশুর মাঝামাঝি। আমি মধ্যবিত্তে থাকব না। প্রয়োজনে আবার বস্তিতে চলে যাব। যারা এমন নেতিবাচক ভাবনায় মত্ত, তারা আবার কীসের মানুষ? কোনো মানুষ যদি কুকুরের মতো অহেতুক সারাক্ষণ  ঘেউ ঘেউ করে তাকে কী বলা যায়?
অন্তত কুকুর বলা যায় না, এর চেয়ে নিকৃষ্ট কিছু আছে কি?


√ শুবাচ গ্রুপের লিংক: www.draminbd.com
তিনে দুয়ে দশ: শেষ পর্ব ও সমগ্র শুবাচ লিংক

 

Language
error: Content is protected !!