ড. মোহাম্মদ আমীন
বৃষ্টি পড়ছে। সঙ্গে হালকা ঝড়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম। বিজলির একটা ঝলক এল হঠাৎ। আমি শিশুর উল্লাসে চিৎকার দিয়ে উঠি— দারুণ! দেখলে সবাই এসো। সবাই দৌড়ে এল। তার বহু আগে আমার চিৎকার গিলে ফেলে বিজলির পেছনে ধেয়ে আসা বজ্রধ্বনি। এভাবে সব ছোটো ছোটো জিনিসগুলো বড়োরা ধরে ধরে গিলে ফেলছে। নিচে বস্তির লোকজন বৃষ্টি আর ঝড় হতে বাঁচার জন্য ছোটাছুটি করছে। বস্তিবাসীর কষ্ট আমার মনে সহানুভূতির কোনো রেশ আনতে পারল না। তাদের কষ্ট আমাদের জন্য খুব স্বাভাবিক বিষয়। প্রতিনিয়ত দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।এখন অন্যের কষ্টটা খুব স্বাভাবিক বিষয় মনে হয়। আমি গুনগুন করে গাইতে শুরু করি—
টাপুর টুপর বৃষ্টি ঝরে, কোন সে আকাশ থেকে
ও আমার কমলিনী শিহরিয়া যায়।
যেন লজ্জাবতীর চরণ হইতে আলতা ধুইয়া যায়।
রচনা বৃষ্টির মতো ভেজা ভেজা গলায় বলল, স্যার, ঢাকার বৃষ্টি কাব্যিক নয়, পাথুরে— মানুষের মতো শহুরে, কারও মনে নরম দাগ কাটে না, বরং রাস্তার কাদা-গর্তে কামড় দিয়ে যায় ধর্ষকের মতো হরদম। ফ্ল্যাটবাড়ির মানুষের মনপ্রাণ পাথরের দেওয়ালে বন্দি, আকাশের বৃষ্টি তাদের কাছে পৌঁছতে পারে না। নুড়ি, হাজার বছর জলে ডুবে থাকলেও জলার্দ্র হতে পারে না।
আর একটা ঝাপটা এলো বৃষ্টির। সঙ্গে বিকট বজ্রনিনাদ। রচনা জাপটাকে উপেক্ষা করে বলল, এমন বৃষ্টিতে আমাদের বস্তির মেঝে হাঁটু পানিতে ডুবে যেত। ছোটো টুটুলকে কোলে নিয়ে সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকতাম। চুল দিয়ে ঢেকে রাখতাম যাতে বৃষ্টি গড়িয়ে মেঝে যায়, টুটুলের গায়ে না পড়ে। আল্পন-কল্পনা আমার দুদিকে দাঁড়িয়ে মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। জলে ভাসমান ময়লাগুলো মনে হতো আমাদের চেয়েও ছন্নছাড়া, আমাদের চেয়েও অসহায়— থাকার স্থান নেই বলেই আমাদের কষ্ট দিয়ে বেড়াচ্ছে।
এত কষ্টের মাঝেও তোমরা লেখাপড়ায় খুব ভালো করেছ।
ঘুমাতে পারতাম না গরমে, মশার কামড়ে, জায়গার অভাবে। তাই পড়তাম, দুই বোনকে পড়াতাম, সারা রাত পড়তাম। ঘুম এলে মশারা জাগিয়ে দিত। মশারা কানে কানে গুনগুন করে বলত— ওঠ রচনা, ওঠ; ছুটতে হবে ছুট।
বৃষ্টির দাপট বেড়ে গেছে, সঙ্গে বাতাস। রচনা আমাকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসিয়ে ডাক দিল, আল্পনা-কল্পনা, টুটুল সবাই ড্রয়িং রুমে চলে আসো।
সবাই চলে এল।
রচনা বলল, তোমাদের ভাইয়া, মানে আমার স্যার এই বাসা ছেড়ে দিয়ে ঢাকা শহরে অন্য কোনো বাসায় থাকতে চাইছেন।
আল্পনা, কল্পনা ও টুটুল সমস্বরে বলল, আমরাও ভাইয়ার সঙ্গে যাব।
রচনা কঠিন গলায় বলল, আমি কোথাও যাব না।
কী করবে? কল্পনা বলল।
আত্মহত্যা করব অথবা আবার বস্তিতে চলে যাব।
লোকে যে নানা কথা বলে? আমি বললাম।
পৃথিবীর যে যাই বলুক, আমি জানি আপনি কী। অন্যরা আমাদের নিয়ে কী ভাবছেন সেটা তো স্যার আমাদের বিষয় নয়। আমরা কী কারও ক্ষতি করছি? কাউকে বিরক্তি করছি কোনোভাবে? কেউ কি আমাদের দ্বারা সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? কাউকে আমাদের জন্য লজ্জিত হতে হচ্ছে? কারও কাছে কিছু চাইছি?
আল্পনা বলল, সমাজ সমালোচনা করতে পারে, কিন্তু আমার মতো হাজার হাজার মেয়ে যে রাস্তায় পড়ে আছে, তাদের জন্য কিছু করতে পারে না। আনুক না একটা তুলে আপনার মতো? যোগ্যহীনদের যোগ্যতা কেবল জিহ্বায় নাচে।
রচনা বলল, আমার কাছে পুরো সমাজটা আপনার তুলনায় শিশু মনে হয়। আমরা যেন খেলনা। সমাজ নামের রাক্ষুসে ব্যবস্থাটি আমাদের মতো অসহায়দের নিয়ে খেলছে। সমাজ আসলে একটা লোভের ডোবা। এর নিষ্ঠুর দিকগুলো দেখলে মানুষ জন্ম নিয়ে কষ্ট হয়, লজ্জিত হই। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভাষায় বলতে পারি- “আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি; নিজের ও সমাজের মঙ্গলের নিমিত্তে যাহা উচিত বা আবশ্যক বোধ হইবে তাহাই করিব; লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সংকুচিত হইব না।”
প্রতিদিন যে দুঃখ পেতে হচ্ছে, আমি ক্লান্ত গলায় বললাম।
দুঃখ ছাড়া জীবন নাবিকহীন নৌকার মতো। এটাও ঈশ্বরচন্দ্র বলেছেন। আমি দুঃখকে সুখ বহনের যান মনে করি।
তাদের কথায় সাহস পেলাম। তাই তো, অন্যেরা আমাকে নিয়ে কী ভাবছে সেটা আমার দেখার বিষয় নয়। আমার মনেও জেদ এসে গেল। মনে পড়ে গেল খান স্যারের কথা— Bravery is to stand up for what you believe in. যে যাই বলুক, আমি আমার মতোই থাকব। লোকের কথা মতো চললে হবে না— এটি হবে অন্যের চলা। যারা মুখে মল নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তাদের মল তাদের মুখে ছড়িয়ে পড়বে—যদি আমি পাত্তা না দিই। এটিই হবে তাদের বড়ো শাস্তি।
আমি অনেকটা চেঁচিয়েই বলে উঠলাম, আমার একসঙ্গে থাকব।
আমার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্পনা লাফ দিয়ে উঠে— হুররে। সঙ্গে সঙ্গে বাকিরাও উঠে আসে। তারপর নিনি-সহ পাঁচ জন হাত ধরাধরি করে আমাকে ঘিরে নাচতে নাচতে গাইতে থাকে—
“আয় তবে সহচরী হাতে হাতে ধরি ধরি,
নাচিবে ঘিরি ঘিরি গাহিবি গান।”
গানের পর আড্ডা।
আল্পনাকে বললাম, ওই দিনের কবিতার বাকি অর্ধেক শোনাও?
শর্ত মনে আছে ভাইয়া?
আছে।
বাকি অংশ এনে দিল আল্পনা। অভিনয়সহ আবৃত্তি করতে হলো রচনা আর আমাকে—
“স্যার, আমি না কি কালো?
এই মেয়ে, তাই তুমি, এত বেশি ভালো।
স্যার, আমার ঠোঁট নাকি মোটা?
মেয়ে! ওটাই আমার গোলাপ-প্রিয় বোঁটা
স্যার, আমার নাকটা নাকি থ্যাতলা?
হ্যাঁ মেয়ে, সুর ভাঙা সুর, মন্দ্রিত বেহালা। ”
কবিতাটি পড়ে মুগ্ধ হলাম। আল্পনা অসামান্য দক্ষতায় রচনা আর আমার কথোপকথন তুলে ধরেছে।
আল্পু, তোমার জন্য পুরস্কার আছে।
কী
কী চাও?
খুব দামি একটা পুরস্কার।
কত টাকা দাম? দেখি, কত টাকা আছে মানি ব্যাগে।
আল্পনা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, এই পুরস্কারটা ভাইয়া হৃদয় থেকে আসে, পকেট থেকে নয়। এটা দিতে মন লাগে, টাকা লাগে না।
বলো না, বাবা কী পুরস্কার চাই তোমার ?
চুমো।
আর কী ?
আপনাকে যেন সারাজীবন এভাবেই পাই।
কীভাবে?
হাতের পাঁচ আঙুলের মতো এক বৃন্তে। আজ খুশির দিনে আমি একটা গান করি, ভাইয়া?
করো।
“নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন
তুই সুখী জনের করিস পূজা দুঃখীর অযতন
মূঢ় মন, দুঃখীর অযতন।।
লাগেনি যার পায়ে ধূলি, কী নিবি তার চরণধূলি
নয় রে সোনায় বনের কাঠে হয় রে চন্দন।
মূঢ় মন, হয় রে চন্দন।
প্রেমধন মায়ের মতন, দুঃখী সূতেই অধিক যতন
এই ধনীতে ধনী যে জন সে তো মহাজন
মুঢ় মন, সেই তো মহাজন।।
বৃথাই তোর কৃচ্ছ্রসাধন, সেবাই নরের শ্রেষ্ঠ সাধন
মানবের পরম তীর্থ দীনের শ্রীচরণ
মূঢ় মন, দীনের শ্রীচরণ।।
মতামতের তর্ক মত্ত, আছিস ভুলে পরম সত্য
সকল ঘরে, সকল নরে আছেন নারায়ণমূঢ় মন আছেন নারায়ণ।।
নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন।।”
সবাই তালি দিল। আমি অবাক হয়ে বললাম, এত সুন্দর গাইতে পার তুমি? এত চমৎকার গান?
রচনা আপু শিখিয়েছে, অতুল প্রসাদের গান।
স্যার, রচনা নরম গলায় ডাকল।
বলো।
রাগ করবেন না তো?
না।
ইফাদের টাকাগুলো ফেরত দিয়ে দিলে ভালো হয়। আপনি কী বলেন?
কেন?
ব্যাংকে যথেষ্ট জমা আছে। আমিও কিছু কিছু আয় করছি। প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা আবর্জনার মতো মনে হয়। ওই টাকার ইন্টারেস্ট ছাড়াই ভালোভাবে চলতে পারব। বোঝা রেখে লাভ কী? ঋণ থেকে মুক্ত হয়ে নিই, কী বলেন স্যার?

রচনা আয় করে। অনুবাদ আর ব্রিটিশ কাউন্সিলে ক্লাস করিয়ে যা পায় তা দিয়ে দিব্যি চলে যাবে। এর আগেও সে কয়েক বার টাকাগুলো ফেরত দেওয়ার কথা বলেছিল। আমি ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে। তার নির্লোভ মনোভাব আমাকে মুগ্ধ করেছে। বস্তিতে বেড়ে উঠায় মনটা বস্তির খোলা আকাশের মতো উদার। এখনো আকাশ-দুর্লভ বর্গফুটীয় ফ্লাটবাড়ির বদ্ধ ছাদের মতো সংকীর্ণ হয়ে কুনো ব্যাং হয়ে ওঠেনি।
বললাম, নির্লোভ মানুষের শান্তি কেউ ব্যাহত করতে পারে না।
রচনা ঠোঁটে ঠোঁটে হেসে বলল, আপনিই এটি শিখিয়েছেন, স্যার।
ঋণের বয়স চার বছর আট মাস। কোনো সুদ পাওনা নেই। দশ বছর রাখা যাবে। তবে খান স্যার বলেছিলেন, প্রয়োজন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেরত দিয়ে দিতে।তাঁর একথার নিশ্চয় মাহাত্ম্য আছে। বেশ কিছুদিন খান স্যারের সঙ্গে দেখা নেই। ফোনেও আলাপ হয়নি অনেক দিন।
খান স্যারের সঙ্গে দেখা করে আসি? রচনাকে বললাম।
কখন যাবেন?
আগামীকাল।
আমিও যাব।
আগামীকাল তোমার ক্লাস টেস্ট না? পরের বার যেও।
ঠিক আছে।
————————————————-