ড. মোহাম্মদ আমীন
অফিস শেষ করে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিই। যানজট ছিল না বলে অন্যদিনের চেয়ে একটু আগেই পৌঁছে যাই। বাসায় ঢুকে মনটা আনন্দে ভরে গেল।
রচনা গুনগুন করে গাইছে-
বসে আছি পথ চেয়ে ফাগুনের গান গেয়ে,
যত ভাবি ভুলে যাব মন মানে না
মন মানে না …।
গানটি রচনা ছাড়া আর কোনো মহিলার কণ্ঠে শুনেছি বলে মনে পড়ে না। আমার একটা প্রিয় গান। তাই মাঝে মাঝে সে গেয়ে শোনায়। অনেকদিন পর রচনার ফুরফুরে মুখ দেখে ভালো লাগল। আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে বললাম,
And, in the end
The love you take
is equal to the love you make.
রচনা গান থামিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, মেয়ে আর একটু জোরে গাও।
রচনা গানের গলটা বাড়িয়ে দিল-
বেদনার শতদলে স্মৃতির সুরভি জ¦লে
নিশিথের মনোবীণা শুর জানে না – – -।
আমি বললাম, কিছু লোকের জীবন আছে, কিছু লোকের আছে গান। মেয়ে তোমার দুটোই আছে। কী ব্যাপার আজ এত আনন্দ হঠাৎ?
রচনা মুখের হাসিকে আরও উজ্জ্বল করে বলল, আমি অক্সফোর্ডে যাচ্ছি না। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে, পাখি ডাকে …।
কী!
আমার অতর্কিত চিৎকারে কেঁপে ওঠে রচনা, সরি, স্যার।
কীসের সরি? ফাজলামো করার জায়গা পাও না!
অক্সফোর্ডে যাওয়া সম্ভব নয় জানিয়ে রিজেক্ট লেটার পাঠিয়ে দিয়েছি।
কখন পাঠিয়েছ?
সকালে। শান্তিনগর পোস্ট অফিসে দিয়ে এসেছি।
রচনার আচরণে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার কাছে কোনো কিছু লুকাতে পারে না বলে দিয়েছে। কোনো কথা না-বলে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকি। দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি শেষ হওয়ার আগে শুনি আর্তনাদ আর চিৎকার। কলজেটা একটু ছ্যাঁৎ করে উঠলেও নিজেকে শক্ত করে ফেলি। রচনা নয়, অন্য কেউ। যে-ই হোক এই মহূর্তে দেখার সময় নেই। আমি সোজা নাজমুলের পোস্ট অফিসের দিকে রওনা দিই। কাছেই অফিসে। বেশিক্ষণ লাগল না যেতে।
আমাকে দেখে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল নাজমুল। অফিসের স্বাভাবিক-সময় অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে। অফিসে যে কয়জন ছিল তাদের সবাইকে আমার সেবায় ব্যস্ত রাখার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে।
আমি বললাম, এত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই।
নাজমুল বিনয়ের সঙ্গে বলল, স্যার আপনার ঋণ শোধ করতে পারব না। আপনি সাহায্য না-করলে আমার মেয়েটার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যেত।
আমি বললাম, তোমার আপা কি কোনো চিঠি পোস্ট করেছে?
কোথায় পাঠাতে পারে স্যার?
অক্সফোর্ড, মানে লন্ডনে।
জি স্যার।
চিঠিটা খুঁজে নিতে কি দেরি হবে?
এয়ার মেইল, মাত্র কয়েক মিনিট। দেরি হবে না স্যার।
নাজমুল পাঁচ মিনিটের মধ্যে চিঠি নিয়ে হাজির। চিঠিটা হাতে নিয়ে নাজমুলকে পুরো ঘটনা খুলে বলি। ঘটনার গুরত্ব বুঝতে পেরে নাজমুল বলল, স্যার আপনি চিঠিখানা খুলে দেখুন। অন্য কেউ হলে দিতাম না। এটি বিধিসম্মত নয়।
আমি নাজমুলকেই খামটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, তুমি খোলো।

নাজমুল খাম ছিঁড়ে চিঠিটা বের করে একবার চোখ বুলিয়ে আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল, নিন স্যার। আপনি যা বলেছেন তাই।
আমিও দেখলাম, রচনার রিজেক্ট লেটার। চিঠিটা উদ্ধার করতে পেরে মনটা আনন্দে একদম ওজনহীন হয়ে গেল। রচনার রিজেক্ট লেটার অক্সফোর্ডের বদলে আমার পকেটে।
থ্যাংক ইউ নাজমুল।
এটি আমার কর্তব্য স্যার। এমন একটা বিধিবহির্ভূত ভালো কাজ করতে পেরে আমার চাকুরি জীবনটা চিরজীবনের জন্য ধন্য হয়ে গেল।
বললাম, মঙ্গলের নিমিত্তে কৃত কোনো কাজই অপরাধ নয়।
পাশে বেইলি রোড।
পোস্ট অফিস থেকে বের হয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকি। বাসার সবার জন্য কিছু খাবার কিনে রিকশায় চড়ে বসি। হেঁটে যাওয়া যেত, কিন্তু হাতে অত প্যাকেট বহন কষ্টকর মনে হচ্ছিল।
আজ আমার জয়ের দিন। জয়ের দিন উৎসবহীন রাখা মোটেও উচিত হবে না।
জয়কে জয়হীন রাখলে জয় আর আসে না।
শুবাচ গ্রুপের লিংক: www.draminbd.com