স্যমন্তক: চতুঃপঞ্চাশত্তম পর্ব

 ড. মোহাম্মদ আমীন
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। রচনা এক আঁজলা জল নিয়ে আকাশের দিকে ছুড়ে দিল। তারপর একটু নিচু হয়ে ঢেউকে আমার দিকে ঠেলে দেওয়ার মতো অভিনয়ে গেয়ে উঠল—
“আমার স্মরণ-শুভ-সিন্দূরে
একটি বিন্দু এঁকো— তোমার
ললাটচন্দনে।”
সমুদ্রের ঢেউ আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে, কিন্তু একটু ছুঁয়ে দিয়ে পরক্ষণে ফিরে যাচ্ছে গভীরে। মনে হচ্ছিল, রচনাদের খুশির ঢেউয়ে সমুদ্রের ঢেউ উল্লাস পেয়ে উল্লসিত লুকোচুরি খেলছে। ঢেউয়ের আসা-যাওয়ায় ভালোবাসার সবগুলো বোকামি ফেনিল শুভ্রতায় গমগম করে ডাক দিচ্ছে আমাদের।
আনন্দমগ্ন রচনা চিৎকার দিয়ে বলল, ওই দেখুন স্যার সূর্য কীভাবে বিদায়ের সাজ পরছে। সকালে একরকম, দুপুরে একরকম, বিকেল একরকম আর সন্ধ্যায় অন্যরকম। মানুষের জীবনও ঠিক এমন। তাই না স্যার?
একদম রমণীয়, মেয়েদের মতো। 
রচনা আবার গেয়ে ওঠে আপন মনে,
‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে …। আজ স্যার হারিয়ে যাওয়ার দিন, মনে মনে …। আসুন, স্যার; হারিয়ে যাই।
হারিয়ে যেতে গিয়ে পড়ে গেল বালিতে। আমি টেনে তুলে বসে পড়লাম। আল্পনা, কল্পনা, টটুল আর নিনি নিজেদের মতো জলকেলিতে। আমাদের দিকে তাদের খেয়াল নেই। আনন্দে বড়োদের পাত্তা দিলে আনন্দ ব্যহত হয়।
স্যার, বাম পায়ে ব্যথা করছে?
টেনে নিয়ে বললাম, সিঁড়ি পাড়ের ব্যথা জেগে ওঠল নাকি?
তা তো ডান পায়ে।
থ্যাংকস গড।
রচনা শুয়ে পড়ে বালিতে, আমার হাঁটুতে মাথা। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকল। তারপর ভ্যনিটি ব্যাগ খুলে একটি বই হাতে নিল। বই দেখে মেজাজ আমার তিরিক্ষি, “এই মেয়ে, এখানেও পড়বে?” আমার কণ্ঠে সুস্পষ্ট বিরক্তি।
এ তো স্যার আপনিই আমার ব্যাগে ভরে দিয়েছেন পড়ার জন্য; জোসেফ কনরাডের (Joseph Conrad) দি মিরর অব দ্যা সি (The Mirror of the Sea);  নিজে বলেন পড়তে, পড়লে বলেন পড়ো কেন, ছিঁড়ে ফেলব। লেখাপড়াই করব না আর। বাসায় এত বই আনেন কেন?
সরি, তুমি প্রতিদিন কতক্ষণ পড়ো?
বইটি ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে বলল, আপনি না-থাকলে সারাক্ষণ।
আমি থাকলে লেখাপড়ার ক্ষতি হয়, তাই না?
আপনি যতক্ষণ থাকেন ততক্ষণ আপনার কাছে শিখি প্রকৃতি, জীবন, সাহিত্য, মূল্যবোধ; একদিনে যা শিখতে পারি অন্য কারও কাছ থেকে সারা বছরও তেমন শিখতে পারি না। আপনি বাবা-বন্ধু-প্রেমিক-ভাই নন শুধু, আমার চিরন্তন শিক্ষক।
এটা তোমার বাড়িয়ে বলা।
স্যার, এভাবে বাড়িয়ে বলাই সাহিত্যকর্ম।
জীবন কী সাহিত্যকর্ম?
না। তবে জীবনকে উপভোগ করতে হলে তাকে সাহিত্য বানিয়ে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। সাজিয়ে নিতে পারলে মৃত্যুও উৎসবমুখর এবং কষ্টও উপভোগ্য হয়ে উঠে। এভাবে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এভাবে আনন্দমুখর করে তোলা যায় ।
মেয়েদের সঙ্গে কথায় কেউ পারে না।

শেফালী ঘোষ

শুধু কথায় নয়, কিছু দিয়ে পারে না। শুধু পশুর মতো শক্তি দেখাতে পারে। ছেলেমেয়ে সম্পর্ক অনেকটা হরিণ-বাঘ সম্পর্কের মতো।
আমি আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য নরম গলায় বললাম, পরস্পর বোঝাপড়ার অভাব এর অন্যতম কারণ। মূল্যবোধের অবক্ষয়ও বলতে পারি। 
মূল্যবোধের অবক্ষয়টা কখন হলো? অতি প্রাচীনকালে নারী-পুরুষের সম্পর্কটা আরও ভয়ানক ছিল। তাহলে বলতে হয়, এদের কখনো মূল্যবোধ ছিল না। তবে আপনার মতো ভালো বন্ধু হয় না।
কীভাবে ভালো বন্ধু হলাম?
আপনি আমার সব দুর্বলতা সারিয়ে তুলেছেন, আমাকে ঘষেমেজে ধারালো আর শক্তিশালী করে দিয়েছেন এটাই তো স্যার বন্ধুর কাজ। আপনি আমাকে অহংকার দিয়ে প্রবল বিনয়ে উচ্ছ্বল করে দিয়েছেন। ভালোবাসা দিয়ে করেছেন উর্বর। আমি বিনয়ী  না কি অহংকারী তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আচরণের ওপর।
রচনার কথা ঢেউয়ের মুখরতায় হারিয়ে গেল। ঢেউ ছিঁড়ে অস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে এল রচনার, আসুন স্যার, আমি আর আপনি সমুদ্রে সাঁতার কেটে সূর্যের ওই লাল দেশে চলে যাই। আসুন-না স্যার?

শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব (১৯২৭-২০০)

প্লিজ।
রচনা আর কল্পনা একটা ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, সমুদ্র এত সুন্দর কেন?
তোমরা আছ তাই। সম্পর্কই সুন্দর, সম্পর্কই অসুন্দর। যা মন দিয়ে অনুভূত হয়।
আপনি না-থাকলে এত সুন্দর আমরা দেখতে পারতাম না, বলেই আল্পনা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ভাইয়া, আই লাভ ইউ।
কে জানি ক্লিক করে একটা ছবি তুলল। চেয়ে দেখি, অরুনাভ সরকার।
কী ব্যাপার দাদা, এখানে?
পত্রিকার কাজে আসতে হয়েছে। আসতে চাইনি, এখন বুঝতে পারলাম, না এলে আনন্দ আর সুখ কী জানা যেত না। গলা ভেজানোর জন্য কিছু টাকা লাগবে যে।
দেব। আপনি ছবি তুলতে থাকুন আমাদের।
পত্রিকায় ছাপিয়ে দেব, কিন্তু।
আরে দাদা, যেখানেই দিন, আগে তুলুন।
কথার মাঝে কল্পনা এসে আমাকে ঢেউয়ের বুদ্‌বুদে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। সঙ্গে রচনা, টটুল আর আল্পনা এসে চড়ে বসে আমার উপর। আমি ঢেউয়ের নিচে তলিয়ে যাই। ঢেউয়ের উপর থেকে ভেসে আসছে রচনার গান-
“আমার মনের মোহের মাধুরী
মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো-তোমার
অঙ্গসৌরভে।
আমার আকুল জীবনমরণ
টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো-তোমার
অতুল গৌরবে।”
বিকেলে হোটেলে এসে দেখি আবদুল গফুর হালী, শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব। তাঁরা রিশেপসন রুমে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। হালীর বাড়ি পটিয়ার শোভনদণ্ডী। তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সূর্য নামে খ্যাত। তিনিই সবাইকে নিয়ে এসেছেন। শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব হালীর লেখা গান গেয়ে বিখ্যাত হয়েছেন। আধুনিক মাইজভান্ডারি গানের পুরোধাও হালী। এমন

আবদুল গফুর হালী (৬ আগস্ট, ১৯২৯- ২১ ডিসেম্বর, ২০১৬)

একদল গুণী মানুষ পেয়ে রুমে যাওয়ার কথা ভুলে যাই। রিশেপসন রুমের সোফায় ভেজা কাপড়ে সমুদ্রের খচখচে বালি নিয়ে বসে পড়ি। রচনা বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে হাতে ঠ্যালা দিল। কানে কানে বলল, রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। না-করবেন না কিন্তু।
আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। মায়ের শাসন মেয়ের মুখে। অবহেলার সাধ্য কার।
শ্যামসুন্দর বললেন, আমরা সংস্কৃত মন্ত্রণালয়ে একটা আবেদন করেছিলাম। তদবির করতে পারছি না বলে কিছুই হচ্ছে না।
আমি  আবেদনের একটা ফটোকপি নিয়ে বললাম, “আপনাদের অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। কাজটা হয়ে যাবে। এ বিষয়গুলো যে অফিসার দেখে সে আমার ব্যাচম্যাট এবং ক্লোজ ফ্রেন্ড।”

আমার কথা শুনে তাঁরা খুব খুশি হলো। এত সহজে আমি তদবিরে রাজি হয়ে যাব  ভাবতে পারেননি। আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে আমি কিন্তু তদবির করতে ছাড়ি না, তা সে যার জন্যই হোক, আমার কাছে এলেই হলো। এজন্য আমাকে অনেকে বোকা ডাকে। বলে মালপানি ছাড়া কীসের তদবির!
হালী বললেন, অনে  ফ্রেশ অই আঁইয়ুন। অনরে লই এক কাপ চা হাইয়ুম। না-গইর্লে হষ্ট পাইয়ুম।
শেফালী ঘোষকে বললাম, আমার মেয়ে তো আপনার গান করে?
তেই ওবা চিটাইঙ্গা হথা বুঝে না ?
বুঝে না, কিন্তু আপনার গান ঠিকই বুঝে। একটা প্রায় সময় আমাকে গেয়ে শোনায়।
হউন্যা গায়-দে?
রচনা বলল, যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম, যদি নতুন একখান মুখ পাইতাম; মইশহাইল্যা পানর খিলি তারে বানাই হাবাইতাম।
শুবাচ গ্রুপের লিংক: www.draminbd.com
তিনে দুয়ে দশ: শেষ পর্ব ও সমগ্র শুবাচ লিংক
Language
error: Content is protected !!