ড. মোহাম্মদ আমীন

আমার দাপ্তরিক ব্যস্ততা ও সংবর্ধনার কারণে কয়েকদিন রচনাকে দিনের বেলা দেখতেও পাইনি। রাতে বাসায় এলেই শুরু করে কান্না-মিনতি, “আমি কিছুতেই অক্সফোর্ড যাব না। আপনি আমাকে ভালোবাসেন না তাই তাড়িয়ে দিচ্ছেন।” নাওয়া-খাওয়া একপ্রকার ছেড়ে দিয়েছে। জোর করে কাউকে খাওয়ানো যায় না। পেটানো যায়।
বললাম, মেয়ে, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
বিশ্বাস করি না। আপনার কাছে আমি কেবল পর্যটক, স্রেফ ভ্রামণিকের প্রকৃতি দেখার ক্ষণিক মোহ। আমাকে কেন ভালোবাসবেন, আমি আপনার কে?
তুমি আমার মা, বোন, মেয়ে, প্রেমিকা, সেবিকা আর আমার অনিন্দ্য আবিষ্কার, নির্জন বন; সীমাহীন সবুজের রহস্যময় অহংকার। চারদিকের শতশত মানুষের দেওয়া শৈল্পিক কলঙ্কের কালো হীরে।
আমি এত কিছু হতে চাই না। এত কিছু একসঙ্গে নিলে কোনোটাই রাখতে পারব না। আমি একটা হতে চাই।
আর্থিক সচ্ছলতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, চেয়ে দেখো পেছনে। দারিদ্র্যের প্রতিশোধ নিতে হবে। তোমাকে

পড়ানোর জন্য তোমার বাবা ভিক্ষা করেছেন। আর্থিকভাবে সচ্ছল না-হলে মা-বাবার ঋণ কীভাবে শোধ করবে?
আমার মন অর্থ চায় না, শান্তি চায়।
ঋণ পরিশোধ শান্তির দরজা।
আপনিই আমার শান্তি।
আর্থিক দীনতা গভীর সম্পর্ক পর্যন্ত ভেঙে দেয়। আর্থিক লালিত্যে আত্মিক হৃদ্যতা মনোরম ও সর্বজনীন হয়ে ওঠে। অর্থ মানে টাকা, অর্থ মানে মহিমা। তোমাকে বিশ্বজনীন হতে হবে সর্বজনীন মমতায়।
আমি সর্বজনীন হতে চাই না। একজনীন হতে চাই।
ভেবেছিলাম তুমি আমাকে বুঝতে পার, ভুল ভেবেছি।
রচনা বলল, আমি স্যার সব বুঝেছি। সৃজনশীল মানুষগুলো সাংঘাতিক বিপজ্জনক হয়। অথবা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের তাদের বিপজ্জনক মনে না করার কোনো উপায় থাকে না। এজন্য কোনো সৃজনশীল মানুষ দাম্পত্য জীবনে সুখী হতে পারেনি। আপনার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
কী বলতে চাইছ তুমি?
চলার পথে সহপথিকের মতো আকস্মিক আমাদের দেখা, চলতে চলতে ওভাবেই পথের মাঝে ভুলে যাবেন আমাকে। কত পথিক পথে, কে কয়জনকে মনে রাখে। কেউ কি রেখেছ কখনো?
এটা তোমার অভিমানের কথা। তুমি না-থাকলে আমারও কষ্ট হবে, বরং তোমার চেয়ে বেশি। তবে তুমি যাচ্ছ, এটি আমার নির্দেশ।
রচনা বলল, ঈশ্বরের নির্দেশ কোনো আদর্শ মানুষ অমান্য করতে পারে না,। আমি নির্দেশ মানব তবে হেসে নয়,

কেঁদে কেঁদে কষ্টে। যেমন মানুষ মেনে নেয় ঈশ্বর হতে আগত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আমি অভিশাপ দেব ঈশ্বরকে, তিনিও যেন আমার মতো অনুভবে দগ্ধ হন মমতার বন্যায়। তিনিও যেন এমন কোনো সন্ধ্যায় নীড়ের লক্ষ্যে ছুটেচলা পাখির মতো আমার জন্য আহত হন।
তুমি আসলেই আমাকে চিনতে পারনি।
আপনার পুরো অবয়ব ঢাকা ছিল আলোর উল্লাস আর শ্রদ্ধার নিকষ মহানুভবতার অধরা মায়ায়। যত বার ধরতে গেছি তত বার মনে হয়েছে ঈশ্বরকে এভাবে ধরা যায় না, ঝলসে যাব। আহ্বানের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। অপেক্ষা করতে করতে সময়টাই শেষ হয়ে গেল।
তার কথা শুনে আমি বলার সব ভাষা হারিয়ে, সব অনুভূতি পরম নিষ্ঠার সঙ্গে নির্জীব হয়ে গেল। আমি চুপ মেরে গেলাম।
কিছু বলছেন-না যে? রচনা একটু থেমে প্রশ্ন করল।
ঘুমাতে যাও। কাল তোমার ফ্লাইট।
ঘুমাব না— যতই বকেন, যতই বলেন।
আমারও রচনাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না।
গান হোক তাহলে?
খুশিতে কাশবনের হালকা ফুলের মতো ফুরফুর করে দৌড়ে হারমোনিয়াম নামিয়ে গাইতে শরু করে—
“তবু মনে রেখ
যদি পুরাতন প্রেম
ঢাকা পড়ে যায় নব প্রেম জালে
তুব মনে রেখ।”
গানটা আমার মনে বিমুগ্ধ অনুভূতির সৃষ্টি করল। এতদিন রচনাকে মেয়ের মতো দেখে আসছি। যদিও আমাদের বয়স কন্যা-পিতার মতো নয়। আমি জানি সম্পর্ক শুধু বয়সের ওপর নির্ভর করে না। পারস্পরিক নৈবেদ্যের ওপর নির্ভর করে। আমি এও জানি আমাদের সম্পর্ক আমাদের মধ্যে আমাদের জন্য যেমন হোক না, খুব কমজনই তাকে অশারীরিক মনে করে। কিন্তু সমালোচকদের শারীরিক-অশারীরিক বোধ আমার কাছে অভিন্ন। কত রাত একসঙ্গে ঘুমিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। শরীর তো মনেরই আধার।
এই মেয়ে, আমি ডাক দিলাম।
স্যার।
তুমি ঘুমাতে যাও। মানুষের মন বড়ো দুর্বল।
ভগবানের মন কখনো দুর্বল হয় না। আমি আরও গাইব।
আমি এখন কারও গান শুনব না।
না-শুনলেও গাইব। পাখি মনের আনন্দে গান করে। স্যার, কিছু কিছু মানুষ আছে, তারা পাখির আনন্দ সহ্য করতে পারে না। গান বন্ধ করার জন্য তীর দিয়ে পাখিটা মেরে ফেলে। কিছু কিছু মানুষ গানের পাখিটাকে ধরে

এনে নিজের ইচ্ছেমতো গাইতে শেখায়। আপনি আজ তাদের একজন হয়ে গেছেন।
রচনার কথা আমার আবেগকে সবেগে নাড়া দিল। আমি আবেশিত হয়ে পড়ি বোধহীন মাতালের মতো। রাগ আমার অনুভূতির কাছে ভীষণভাবে থুবড়ে পড়ল।
তাহলে আমাকে গাইতে দিচ্ছেন না কেন?
কিচ্ছু শুনব না। ইচ্ছে হয় বাইরে গিয়ে গাও।
রচনা হারমোনিয়াম রেখে বাইরে গিয়ে সত্যি সত্যি গাইতে থাকে। তার গানের সুরে আমার কষ্ট আরও তীব্র হয়ে উঠল। যতক্ষণ পারি কাছে রাখি না কেন? সীমিত জীবনের একটা সেকেন্ডও কেন কষ্টের মাঝে নষ্ট করে দেব?
ডাক দিলাম, মেয়ে ভিতের এসো। ডাক দিয়ে নিজে গিয়ে নিয়ে এলাম সাদরে। রচনা খুশিমনে গাইতে লাগল—
“Look into my eyes- you will see
ব্রায়ান এডামস (Bryan Adams)-এর গানটা কী সুন্দরভাবে গাইল। মাঝে মাঝে সে ব্রিটিশ কাউন্সিলে গানটি করে। আমি শুধু শুনে গেলাম, শুনতে শুনতে স্মৃতি আমার বিস্মৃতির অতলে নির্বাক হয়ে যায়।
স্যার, কেমন হয়েছে?
মন ভালো থাকলে মানুষ গান শোনে। আমার মন ভালো নেই। আমি তোমার গান শুনিনি, কেবল গানের লিরিকসগুলো মনের গভীরে শব্দে শব্দে সুরের সুঁই দিয়ে বুকের ভেতর গেঁথে নিয়েছি।

বুকে মাথা রেখে গুটিশুটি হয়ে পড়ে আছে। মনে হলো কোনো যুবতি নয়, মানুষ নয়; পৃথিবীর সকল সারল্যের অন্তর থেকে তিল তিল করে তুলে আনা মাধুর্য দিয়ে গড়া একটা অনাবিল পুতুল।
ডাক দিলাম। রচনা চকিত কষ্টে উঠে বসল ত্বরিত।
বেদনায় চোখ ফুলে লাল।
এ লাল গোলাপের নয়,
নীলিমারও নয়—
এ লাল বিদায়ি কষ্টের নির্দয় আঘাতে
ছুঁইয়ে পড়া রক্ত।
আমি হতবাক কষ্টে চোখ দুটো
ঢেকে ফেলি কান্নায়।