ড. মোহাম্মদ আমীন
নিয়োগপত্র দেওয়ার আগে একটা কুবুদ্ধি এসে আমার মাথায় ঢুকে পড়ল। এমন কুবুদ্ধি আসার প্রবণতা নতুন নয়। বালকবেলায় নাকি আরও বেশি ছিল। এজন্য অনেকে আমাকে কুটিল্য (কৌটিল্য) ডাকতেন। কূটকৌশলে প্রতিদিন কোনো কিছু একটা করতে না-পারলে রাতে ঘুম আসত না। এ কারণে কত মার যে

খেয়েছি ইয়ত্তা নেই; ভুগতেও হয়েছে অনেক।
ভবিষ্যতেও হয়তো ভুগতে হবে। তবু ঠিক থাকতে পারি না। কূটবুদ্ধিটা বেশ ভয়ংকর হয়ে উঠছে। নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, মেয়েটাকে নিয়োগ দেব না।
আদিলকে বললাম, রাকুর আসল নামটা কী যেন?
: কঠিন নাম স্যার, মনে থাকে না। দেখতে হবে।
কাগজ দেখে আদিল বলল, রাকখসনা।
: তাকে নিয়োগ না-দিলে কেমন হয়?
: স্যার, মেয়েটা বেশ বুদ্ধিমান। খান স্যারের ভাষায় প্রতিভাধারিণী।
: মেয়েটা আস্ত রাক্ষস। দেখ-না, সব নম্বর কীভাবে একাই রাক্ষসের মতো গিলে নিয়েছে।
আদিল মুচকি হেসে নরম গলায় বলল, স্যার মেয়েটার অপরাধ?
: মৌখিক পরীক্ষায় তার অভিব্যক্তি আর উপস্থাপনা দেখে খান স্যারের মতো সিএসপি পর্যন্ত হতভম্ব হয়ে গেছেন। অফিসে যোগ দিলে আমাদের বলদ বানিয়ে ছাড়বে। ওর মেধার সঙ্গে আমরা কেউ পারব না।
আদিল বলল, এমন একজন সহকারীই স্যার আপনার দরকার। আপনিও প্রতিভাবান।
: শোনো আদিল, মোটা চিন্তা করলে হবে না।
আদিল শুকনো গলায় বলল, স্যার, চিন্তা ঈশ্বরের মতো নিরাকার।
আমি ফিসফিস করে বললাম, এমন একজন মেধাবী মেয়েকে কেরানির চাকরি দিয়ে নষ্ট করে দিতে চাইছি না। চাকরি না-পেলে সে লেখাপড়া চালিয়ে যাবে। একদিন বিখ্যাত হবে। এই চাকরিতে ঢুকলে কেরানিতেই তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে। প্রকল্প শেষ হলে মেয়েটা কী করবে শুনি?
আদিল বলল, আসলেই স্যার, মেয়েটি অসাধারণ মেধাবী। আমি এই পরীক্ষা দিলে তার অর্ধেক নম্বরও পেতাম না।
আমি বললাম, রাকুকে এ কাজে নিয়োগ দেওয়ার অর্থ হলো ছাই ফেলতে সোনার কুলোর ব্যবহার— উভয়ের অপমান। সোনার কুলো লজ্জা পাবে ছাই নিতে, ছাই লজ্জা পাবে কুলোয় উঠতে।
: স্যার, আপনার মতো করে ভাবিনি।
: ভাবতে হবে। অবশ্য তুমি ভালো ছেলে, ভাবতে পার ভালো।
আদিল খুশি হয়ে বলল, ধন্যবাদ স্যার।
: খান স্যার রাজি না-হলে কিছু করা যাবে না।
: বিধি অনুযায়ী প্রথমজনই নিয়োগ পায়। খান স্যার যদি এটি ধরে বসেন? তিনি তো বলেই দিয়েছেন তাকে নিয়োগ দিতে।
খান স্যারের কাছে গিয়ে বিষয়টা খুলে বললাম। ভেবেছিলাম রেগে যাবেন। তাঁর মতো একজন গাণিতিক লোকের সঙ্গে এত স্পর্ধাজনক প্রস্তাব সহজ বিষয় নয়। আশ্চর্য হলাম— তিনি রাগলেন না। আমার কথা শুনে কী যেন ভাবলেন। তারপর কাছে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বললেন— প্রথম তিনজনের উত্তরপত্র এবং জীবনবৃত্তান্ত আর একবার দেখতে চাই।
আমার বগলেই ছিল ওগুলো। জানতাম তিনি চাইতে পারেন। এগিয়ে দিয়ে বললাম, প্লিজ, স্যার নিন।
রাকুর খাতা দেখে তিনি ফের হতবাক।
অ্যাস্ট্রেতে সিগারেটের ছাই ফেলতে ফেলতে বললেন, মেয়েটাকে চাকরি না-দেওয়া কি ঠিক হবে? অনেক মেধাবী একটা মেয়ে। অপরাধ হবে না?
আমি খুশি হয়ে বললাম, এমন মেধা— কল্পনাই করা যায় না, স্যার।
: তুমি যা ভালো মনে কর তা-ই করো। তবে কারও প্রয়োজন যদি অধিকারের চেয়েও প্রবল হয়ে উঠে সেক্ষত্রে তোমার এই দুঃসাহসী পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে। আমি কী বলেছি বুঝতে পেরেছ?
: জি, স্যার।
: কী বলতে চাইছি?
: আপনি বাঁচলে বাপের নাম।
: ভেরি গুড। শোনো, বর্তমান পার করতে পারলে ভবিষ্যৎ। আগামী কাল কাউকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বর্তমানের কাউকে মেরে ফেলা পাগলামি, অপরাধ তো বটেই। ভবিষ্যতের স্বপ্নে বর্তমানকে নষ্ট করবে না। বাই দা বাই, মেয়েটি প্রচণ্ড অভাবে পড়ে চাকরি নিতে এসেছে, এটি ভুলে গেলে চলবে না।

ভাইভাতে আমি কিছুটা টের পেয়েছি। ভবিষ্যৎ ঈশ্বরের হাতে, বর্তমান আমার হাতে। ঈশ্বরে আস্থা রাখতে পারি, কিন্তু সিদ্ধান্ত তার হাতে।
: আমি স্যার আপনার কথা বুঝতে পেরেছি। রাকুর বর্তমান আর ভবিষ্যৎ দুটোই যাতে রক্ষা পায় সেটাই করব।
: মানুষ আর ঈশ্বরের মিলন ঘটাবে কীভাবে?
: মানুষই তো স্যার মানুষের ঈশ্বর।
: মেয়েটার ফ্যামিলি ব্র্যাকগ্রাউন্ড জানো?
: না, স্যার।
: সে কি তোমার পরিচিত?
: না, স্যার।
: তার বাড়ি কি তোমার জেলায়?
: না, স্যার।
: সে কি তোমার কোনো আত্মীয়?
: না, স্যার।
: কোনো বন্ধুর পরিচিত কেউ?
: না, স্যার।
খান স্যার নিস্পৃহ গলায় বললেন, দেখো তাহলে, কীভাবে সাহায্য করা যায়। নিজে নিজে বিপদ ডেকে এনো না। তোমার চোখ দুটি, চারদিকে হাজার হাজার। সব তোমার দিকে। তুমি যত বড়ো হবে ছোটোদের চোখ তোমাকে তত বেশি বিদ্ধ করার জন্য ওত পেতে থাকবে, চারদিকে মানুষ নয়, প্রায় সবাই অসূয়াপর বৃশ্চিক।
: স্যার, আলোর কিরণ বাড়ানোর জন্য অন্ধকার অনিবার্য। ঝুঁকি ছাড়া কি সুখী হওয়া যায়?
: দুখী হওয়ার আশঙ্কা তো থেকেই যায়।
: ঝুঁকি নিয়ে দুখী হতে আপত্তি নেই।
খান স্যার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, এমন পরার্থপরতাই মানুষের ঈশ্বরত্ব। আমি তোমার এমন যেকোনো কাজের সঙ্গে আছি। মুখে যা বলছ, তা যদি অন্তর ধারণ না কর, তাহলে তা ঈশ্বরত্ব নয়, নষ্টত্ব। এমন কোনো কাজে আমি নেই।
খান স্যারের কথায় আমার মনের ইচ্ছাটা ফুর্তিতে উদ্বেল হয়ে দুলতে থাকে কাশফুলের মতো নিবিড় আনন্দে। বুঝতে পারলাম— তাঁকে কেন সবাই এত সমীহ করে, ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। মন নয় যেন আকাশ, পলিমাটির শ্রাবণ। এমন আকাশ মন যদি সবার থাকত!
————————————————————–