ফল প্রকাশের দিন ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে। আগের তিন বর্ষে গড় নম্বর সাতাশির ওপর। অতএব, প্রথম শ্রেণি পাচ্ছে এটি নিশ্চিত। এত নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণি পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পাবে— এটাও অনেকটা নিশ্চিত। অধিকন্তু, মহিলা হিসেবে অগ্রাধিকার তো আছেই। শিক্ষক পদে নিয়োগপ্রাপ্তির অনুকূলে তার আর একটি বাড়তি সুবিধে আছে— বাংলাদেশের প্রায় সব বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ তাকে চেনেন, ভালোবাসেন।স্যমন্তক, পুথিনিলয়।
খান স্যার আর আমি রচনাকে প্রথম থেকে ওভাবে গড়ে তুলেছি। কবীর চৌধুরী তো প্রচণ্ড প্রভাবশালী।
পরীক্ষা শেষ হলেও রচনার পরিশ্রমের শেষ হতে কখনো দেখিনি। বরং আরও বেড়ে যায়। আমি যতক্ষণ বাসায় থাকি ততক্ষণ আমাকে সঙ্গ দেয়— কেবল এটাই তার বিশ্রাম এবং মনোরঞ্জন।আমি কতক্ষণই বা বাসায় থাকি। আমি থাকলে সে থাকে না, অথবা সে থাকলে আমি। শুক্রবার তার প্রায় পুরোদিন চলে যায় ব্রিটিশ কাউন্সিলে। রাতে আমার লেখালেখি, তার অধ্যয়ন, রান্নাবান্না, ছোটোদের পড়ানো- আরও কত কী!
ঢাকা শহরে প্রথম দিকে সময় বিবেচনায় অত্যাধুনিক যে কয়টা আইবিএম কম্পিউটার ছিল তন্মধ্যে একটি ছিল রচনার। যদিও বাংলা লেখা যেত না। তার অবশ্য বাংলা প্রয়োজনও ছিল না। ডস পদ্ধতিতে তথ্য সংরক্ষণ ও স্থানান্তর করা হতো। সৈয়দ আবুল হোসেন আমাকে এটি উপহার দিয়েছিলেন। তিনি আমেরিকা যাবার সময় বলেছিলেন, তোমার জন্য কী আনব?
একটি কম্পিউটার, আমি বলেছিলাম।
সত্যি সত্যি নিয়ে এসেছিলেন। আমার প্রতি কেন জানি খুব উদার ছিলেন তিনি। দেওয়ার সময় সেরাটাই দিতেন একদম নিজের সন্তানের মতো স্বতস্ফূর্ততায়।
রচনার শখ বিদেশি ভাষা শেখা, ইদানীং তা হয়ে গেছে নেশা। ইতোমধ্যে কয়েকটা ভাষা আয়ত্তে নিয়ে এসেছে। বিদেশি ভাষা শেখা কঠিন, কিন্তু রচনার কাছে সহজ। রুশ-কোরিয়ান ভাষাও রপ্ত করে ফেলেছে। এখন সোয়াহিলি ও চায়নিজের প্রতি ঝুঁকেছে।
ভাষা শেখা খুব কঠিন, পারো কীভাবে? প্রশ্ন করলাম রচনাকে।
“স্যার”, রচনা বলল, শেখার মধ্যে সবচেয়ে সহজ হচ্ছে ভাষা। নইলে শিশুরা কি ভাষা শিখতে পারত? মায়ের পেট থেকে পৃথিবীতে এসে শিশুরা প্রথম যা শেখে তা হচ্ছে ভাষা। ভাষা শেখার পর জ্ঞানের অন্যান্য শাস্ত্র। তাই বলা হয়— ভাষা জ্ঞানের জননী এবং মাতৃভাষা জ্ঞানের প্রাণ। যে মাতৃভাষা জানে না, মাতৃভাষা অবহেলা করে কিংবা মাতৃভাষাকে অন্য ভাষার তুলনায় হেয় ভাবে সে আমরণ অজ্ঞ থেকে যায়। মীর মশাররফ হোসেন বলেছেন, মাতৃভাষায় যাহার আস্থা নেই, সে মানুষ নহে।
এমন করে তো কখনো ভাবিনি?
স্যার?
বলো।
অনুবাদ, শিক্ষকতা আর লেখালেখি করে মোটামুটি ভালোই আয় হচ্ছে। প্রকল্পের লোনের টাকাগুলো ফেরত দিয়ে দিই?
সবকিছু নিয়ে মাতবরি ফলাতে এসো না মেয়ে। কখন কী করতে হবে আমি বুঝব। কৃতিত্ব দেখানোর আর সময় পাও না। তোমার জন্য সবার কাছে আমি অপরাধী, আর তিনি মনের সুখে যা ইচ্ছে তাই বলে বেড়াবেন।
অযথা রাগ। আসলে রচনার কাছে এলে আমার সবগুলো অভিমান আর কষ্ট একসঙ্গে বের হয়ে আসার জন্য লাফালাফি করে। গতি আর জটের চোটে কিছু কষ্ট মাঝে মাঝে ঘর্ষণে ঘর্ষণে রাগ হয়ে ঝরে পড়ে রচনায়। রচনাও কম যায় না, সামান্য বকা দিলেও বেঁকে বসে। মেয়েদের বকা দিয়ে উপযুক্ত প্রতিদান হতে বঞ্চিত হয়েছে— সম্ভবত এমন পুরুষ পৃথিবীতে বিরল। হোক সে মহাবীর আলেকজান্ডার কিংবা সম্রাট আকবর অথবা কৃষক আলি জব্বর।
রচনা কাঁদছে। বলার ভাষা তার অনেক, কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা একটা। সেটি কান্না। আমি বলি জলোভাষা। জল দিয়ে সবকিছু পরিষ্কার করে দিতে পারে এই মেয়ে। আসলেই আমি খুব কষ্টকর কথা বলে ফেলেছি তাকে।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম গলায় বললাম, এই মেয়ে?
স্যার?
চলো, আজ বাইরে খাই।
চোখের জল নিমেষে উধাও।
এক চিলতে মধুর হাসি উপহার দিয়ে বলল, কোথায় যাব, স্যার?
তোমার ইচ্ছে।
কোথায় খাব?
তোমার যেখানে পছন্দ।
আমি রেডি হয়ে আসছি।
সবাইকে রেডি হতে বলো, আমি বললাম।
ওরা গেলে আমি যাব না।
কেন?
এত গাদাগাদি ভালো লাগে না। একটু কথা পর্যন্ত বলতে পারি না। সারাদিনে দুই ঘণ্টাও পাই না আপনাকে। ওরা সারাদিন আপনাকে নিয়েই থাকে। আমি কতক্ষণ পাই? কল্পনা তো একদম একাই দখল করে বসে আছে, যেন সরকারি খাস জমি। আমার প্রতি স্যার আপনার এত অবহেলা কেন? আমি কালো তাই?
দেখো মেয়ে, আমি বললাম, “এসব বাজে কথা একদম বলবে না। ওরা ছোটো, না-নিয়ে গেলে মনে কষ্ট পাবে না?”
গলার স্বর একটু কড়া করে বলল, আমি যেতে না-পারলে কষ্ট পাব না? তাই বলতে চাইছেন বুঝি? সবার জন্য দরদ আছে, আমার জন্য নেই। যান স্যার, আপনি ওদের নিয়ে যান— যান-না।”
একটু থেমে আমাকে আলতোভাবে ধাক্কাতে ধাক্কাতে গলার স্বরকে অভিমানসিক্ত করে বলল, আমি বলছি কী স্যার— আসার সময় ওদের জন্য খাবার নিয়ে এলে হয় না?
ওরা গেলে ক্ষতি কী?
আপনি বুঝবেন না।
আমি বুঝব না?
না। সবাই সবকিছু বুঝে না। আপনি সোহালি বুঝেন? চায়নিজ বুঝেন?
বুঝি না।
ওদের লেখাপড়া আছে। রাস্তাঘাটের যা অবস্থা — ভালো লাগে না। নইলে কী স্যার না-করতাম? কোনোদিন করেছি?
ঠিক আছে, আমরা দুজনই যাব।
থ্যাংক ইউ স্যার বলেই রচনা আমার কপালে একটা চুমো খেয়ে পোশাক পালটাতে চলে গেল। রুম থেকে ভেসে এল রচনার গলা—
“কোন খসে-পড়া তারা
মোর প্রাণে এসে খুলে দিল আজ
সুরের অশ্রুধারা।”
আল্পনা, কল্পনা আর টুটুল গাল ফুলিয়ে বসে আছে। আল্পনা-টুটুল মেনে নিলেও কল্পনা বলে ফেলল ফটাফট— ভাইয়া আমিও যাব।
আরেক দিন নিয়ে যাব, আমি বললাম।
কেবল আপুকে নিয়ে যান আপনি, আমরা কী দোষ করেছি?
তোমার আপুকে আমি নিয়ে যাই, না তোমার আপুই আমাকে নিয়ে যায়?
আল্পনা বলল, বড়োদের সঙ্গে সবসময় কোথাও যেতে নেই। আমরা গত সপ্তায় গিয়েছি-না ভাইয়ার সঙ্গে। আপু কিছু বলেছে?
কল্পনা বলল, ঠিক আছে, আমি বড়ো হয়ে নিই। তারপর দেখি কীভাবে না-নেন এবং কীভাবে আমাদের সঙ্গে তোমরা যাও।
আমি বললাম, তখন তো আমি বুড়ো হয়ে যাব।
কল্পনা হেসে বলল—
আমার বুড়া অনেক গুঁড়া
খায় না মধু, খায় সে সুরা।
আমার বুড়ার সাদা দাড়ি
তবু করে বাড়াবাড়ি।
আমার বুড়ার ভাঙা গাল
মুক্তোঝরা রুপার থাল।
মাড়ি গালে ফোকলা হাসি
তবু অনেক ভালোবাসি।
টুটুল বলল, ভাইয়া আমি একটা বস্তির গান গাই?
টুটুলের কথার উত্তর দেওয়ার আগে ফোন বেজে উঠে, ভাইয়া, আপনার ফোন,” আল্পনার ডাকে টুটুলের কথা হারিয়ে গেল।
টেলিফোনে বাচম্যাট আলী আজহারের গলা, তোমার বদলি হয়েছে।
আবার?
হ্যাঁ।
কোথায়?
ঢাকায়। খুব দাপুটে জায়গা, ক্ষমতা কী এবার তার স্বাদ পাবে। যারা তোমাকে ঢাকার বাইরে পাঠিয়েছে, তোমার বিরুদ্ধে ডিপি করেছে এবার তাদের জাহান্নমে পাঠিয়ে দেবে। আমি আছি তোমার সঙ্গে। শুধ বলবে, কী করতে হবে।
আমি হাসলাম। যে ব্যাচম্যাট এখন আামার সঙ্গে একাত্বের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে সেই আমার বিপদের সময় সবার আগে দূরে সরে গিয়েছিল, দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। দূর থেকে ঢিল ছোড়ার নেতৃত্ব দিয়েছিল।বুঝলাম— দুঃসময়ের শত্রুরাই সুসময়ে সবার আগে বন্ধুতার ভান-হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে। বসন্তের কোকিলের মতো আওয়াজ ছাড়া এদের পুরো মনটাই ঈর্ষায় নিঃস্ব হয়ে থাকে করুণ কাহিনির সমাপ্তির মতো।
To provide the best experiences, we use technologies like cookies to store and/or access device information. Consenting to these technologies will allow us to process data such as browsing behavior or unique IDs on this site. Not consenting or withdrawing consent, may adversely affect certain features and functions.
Functional
Always active
The technical storage or access is strictly necessary for the legitimate purpose of enabling the use of a specific service explicitly requested by the subscriber or user, or for the sole purpose of carrying out the transmission of a communication over an electronic communications network.
Preferences
The technical storage or access is necessary for the legitimate purpose of storing preferences that are not requested by the subscriber or user.
Statistics
The technical storage or access that is used exclusively for statistical purposes.The technical storage or access that is used exclusively for anonymous statistical purposes. Without a subpoena, voluntary compliance on the part of your Internet Service Provider, or additional records from a third party, information stored or retrieved for this purpose alone cannot usually be used to identify you.
Marketing
The technical storage or access is required to create user profiles to send advertising, or to track the user on a website or across several websites for similar marketing purposes.