ড. মোহাম্মদ আমীন
অফিসে ঢুকে দেখি আলী চাচা। সামনে চা ভর্তি কাপ। তা থেকে আলাদিনের চেরাগের দৈত্যের গ্যাসীয় শরীর বের হওয়ার মতো এঁকেবেঁকে ধোঁয়া ওঠছে। পিরিচে সম্মানজনক সংখ্যক অফিসার বিস্কুট। এই বিস্কুট কেবল অফিসার-অতিথিদের দেওয়া হয় তাই এমন নাম। আলী চাচা পায়ের ওপর পা দিয়ে আরাম করে বসে বিস্কুট ভিজিয়ে নিচ্ছেন চায়ে। চাটগাঁইয়ারা পিঁয়াজু পর্যন্ত চায়ে ভিজিয়ে খান। আমার এক বন্ধু কলা পর্যন্ত চায়ে ভিজিয়ে খেতেন। নিশ্চয় পিয়ন শাহেদ চেনে। তাই বসতে দিয়েছে— চা দিয়েছে অফিসার বিস্কুট সহযোগে।
সালাম দিয়ে বললাম, কেমন আছেন।
ভালা, তুঁই ক্যান আছ?
ভালো। কখন এলেন?
কিছুক্ষণ আগে।
সচিবালয়ে ঢুকলেন কীভাবে?
শাহেদ বলল, টেলিফোন করেছেন। ধরলাম, দেখি— আপনার চাচা। তাই নিজে গিয়ে নিয়ে এসেছি।
আলী আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। গ্রাম থেকে এসেছেন। গ্রাম থেকে ঘনিষ্ঠ কোনো আত্মীয় এলে আনন্দিত হওয়ার কথা। ইদানীং আনন্দ লাগে না, ভয় লাগে বরং। তাদের আসার কারণ প্রায়শ দেখি সর্বনাশা। মাঝে মাঝে এমন সব দাবি নিয়ে হাজির হন— যা নৈতিকতা বিবর্জিত, সামর্থ্যরে বাইরে।বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। তারা মনে করেন— যা চাইছেন তাই আমি করে দিতে পারি, কিন্তু ইচ্ছে করে অবহেলা করি, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সাহায্য করি না। এ যে কত বড়ো কষ্টের এবং কী মারাত্মক বিব্রতকর তা কাউকে বুঝিয়ে বলা যায় না।
বাড়ির সবাই ভালো? বললাম
ভালা। তুঁই গ্রামত হম যাও কিল্লাই?
সময় পাই না।
সময় পও না, না কি ইচ্ছা গরে না?
দুটোই।
লাখ ত্রিশেক ট্যাঁয়া লাইব। দিলে বড়ো উপকার অয়। হয়েক মাসের মধ্যে দিয়া দিব। আবার না করি দিও না।
অবাক বিস্ময়ে আলী চাচার দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি একজন চাকরিজীবী, এত টাকা কোথায় পাব? কী বলেন এসব!
ইনকাম তো হম ন-গরো। সরকারি চইরগা অলর ইনকামের অভাব আছেনি আবার? যিন্দি আত দিবা ইন্দি পয়সা, যিন্দি ঠ্যাঁং দিবা ইন্দি ট্যাঁয়া। ঘুসের ওর ঘুস। মেডির মতো ট্যাঁয়া। হোঁদাল দিয়েরে চাঁছি চাঁছি ওধা লইবাদে বাজি।
আমি বললাম, আপনি পাগল হয়ে গেছেন।
মেয়েটার মতো আঁরেও ওকগা লোন লই দেও না বাজি। পইঞ্চাশ আঁজার ট্যাঁয়া ঘুস দিয়ুম।
কী বললেন?
পরর মায়ারলাই এত গরিত পাইরলে আরাল্লই কইরবা না কিল্লাই? ত্রিশ লাখ তোঁয়ার হাছে ত্রিশ ট্যাঁয়া। দি দেওনা বাজি, লইরে যাইগুই। ঢাহা শঅর জাহান্নামত্তুন হরাপ, এক সেকেন্ড এক বছরর ডইল্ল্যা লাগে।আঁই তো পর নই, তোঁয়ার রক্ত। রক্তত্তুন দামি আর কিছু আছে-না বাজি?
আলী চাচার কথার ঢঙ দেখে মেজাজ বিগড়ে গেল হঠাৎ। বললাম, রক্ত মহামূল্যবান, জীবনের জন্য অনিবার্য, কিন্তু যে রক্ত শরীর থেকে বের হয়ে যায় সেই রক্ত সম্পদ থাকে না, আপদ হয়ে যায়। যে রক্ত শরীরের ক্ষতি করে সেটি পুঁজ। ওটাকে যত তাড়াতাড় সম্ভব বের করে দেওয়া যায় তত ভালো।
তুঁই ঘর পুড়ানি, পর ভুলানি মানুষ। নইলে বস্তির ওকগা মাইরলাই এতিন নগইরতা। আঁরাল্লাই তো কিছু ন-গঁরো।
আলীর কথায় আমার রাগ বুক হতে এবার মাথায় চড়ে বসে। রাগের এ অবস্থান ভালো না, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে মানুষ। তবু যতটুকু সম্ভব নিজেকে সংযত রেখে বললাম, গত তিন বছরে আমার কাছে কয়বার এসেছেন?
বউত বার আস্সি।
প্রত্যেক বার এসেছেন ধার নিতে নতুবা তদবির করতে। দেখার জন্য কখনো এসেছেন? হাতে করে একটা লেবু এনেছেন কোনোদিন? যে বস্তির মেয়েটির কথা বললেন সে কোনোদিন আমার কাছে টাকার জন্য আসেনি। তার যোগ্যতাই আমাকে তার কাছে টেনে নিয়ে গেছে টাকা দেওয়ার জন্য। তাকে নিয়ে কোনো বাজে মন্তব্য করবেন না। সে আমার মেয়ে, আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, আমার মঙ্গলই তার কামনা। সে আমার জন্য জীবন দিতে পারবে, আপনি একটা কাঁচা আমও দিতে পারবেন না।
এট্টা ট্যাঁয়া দিলে আঁই ইতিত্তুন বেশি গইজ্জুম। দিয়েরে পরীক্ষা গরি চও। হইজ্জার বডু হাডি হাবাই দিয়ুমদে। পুরা পরিবার একলগে জান দি দিয়ুম।
আমি আরও রেগে যাই, রাগলে সবার মতো আমিও হিতাহিত বোধ হারিয়ে ফেলি। বললাম, আপনার ছেলেকে বিদেশে নিয়েছি, মেয়ের জামাইকেও। একটা ফোন করেছে কখনো? কয়বার দেশে এসেছে? একবার দেখতেও তো আসেনি।
আলী চাচা বললেন, ইতারা নিমক হারাম, আঁরে দিলে আঁই পত্তিদিন আইস্সুম। টেঙ্গত ধরি বই থাইক্কুম। দেও-না বাজি তিরিশ লাখ ট্যাঁয়া।
আমাকে মাফ করেন। অনেক বেশি কথা বলে ফেলেছি। অফিসে অনেক কাজ। এখন যান।
আলী চাচা চেয়ার থেকে উঠতে যাবেন এমন সময় রুমে ঢুকে রচনা। পেছনে ড্রাইভার, ড্রাইভারের হাতে টিফিন ক্যারিয়ার। রচনার হাতে একটা ফুল। দুপুরের খাবার সাধারণত ড্রাইভার একই বাসা থেকে নিয়ে আসে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস না থাকলে ড্রাইভারের সঙ্গে রচনাও চলে আসে খাবার নিয়ে। আমার সঙ্গে খাবে তাই। প্রতিবার হাতে থাকে ফুল। আমি অবাক হয়ে যাই বস্তি থেকে ওঠে আসা মেয়েটির এমন শ্রাবস্তীয় অনুভূতি দেখে। তুলনা করি আমার অনেক আত্মীয়ের সঙ্গে—যাদের জন্য আমি কিছু না কিছু করেছি এবং করছি। রচনার সমুদ্রসম উদার অনুভুতির কাছে তাদের অনুভূতিকে মনে হয় শুকিযে যাওয়া গোষ্পদের অতীত জল।
ইবা হন ওবা ? আলী চাচা বললেন।
এই সে, যাকে আপনি বস্তির মেয়ের বলে উপহাস করেছেন।
কিল্লাই আইস্সে দে?
“আমার জন্য খাওয়ার নিয়ে আসে। দুজনে একসঙ্গে খাই।” বলে আলী চাচার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম, “ মেয়ে, এই আমার চাচা।’
আলী চাচা বললেন, আইচ্ছা, আঁই যাই। তোঁয়ারা পেট ভরি হ।
রচনা শ্রদ্ধা জানিয়ে বলল, খেয়ে যান চাচা।
হাইতাম নয়, একজনর হাবার। ইতা পর ভুলানি, ঘর জ্বালানি। তোঁয়ারা পেট ভরি হ।
রচনা বলল, দুজনের হবে। আমি যেদিন খাবার নিয়ে আসি সেদিন স্যারের সঙ্গে খাই। বাসায় স্যারকে ছাড়া একা খেতে ইচ্ছে করে না। আপনি খান, আমি বাসায় গিয়ে খাব।
তোয়ার ভাইবোন হডে?
বাসায়, রচনা বলল।
বসে পড়লেন আলী চাচা। টিফিন ক্যারিয়ারের ওজন যাচাই করে নিজে নিজে খাওয়া শুরু করলেন। রচনা আমাকে পরিবেশন করে দিতে এগিয়ে আসে।
তুমি খাবে না? আমি প্রশ্ন করলাম।
বাসায় খাব।
আমিও বাসায় খাব।
আলী চাচা বললেন, বাসাত হাঁইও। যেই ভাত আইন্নু আঁর একজনরও অইত ন। আঁরা গ্রামর মানুষ।
আপনি খান, রচনা বলল।
আলী চাচা বললেন, ওবা মাইয়া, তোঁয়ার বিয়াশাদি অঁইয়ে না?
না।
হডে থাগো-দে?
বুঝলাম না।
কন্ডে থাক?
বাসায়।
আর কে কে থাকে?
আমার ভাইবোন, নিনি এবং স্যার।
তোঁয়ার স্যার তোঁয়ার কী?
বাবা।
আমি বললাম, যথেষ্ট হয়েছে, এবার আমার প্রশ্নের জবাব দিন। আম বাগানের খবর কী?

ভাতের শেষ গ্রাসটা মুখে দিয়ে বললেন, ভালা।
আমের মৌসুম। হাতে করে কয়েকটা আম নিয়ে এলে খেতে পারতাম। অনেকদিন নিজেদের গাছের আম খাইনি। সিঁদুরে গাছে কেমন ধরেছে আম?
আলী চাচা হাত পরিষ্কার করতে করতে বললেন, গ্রামর আম বাজি হট্টা, পোগর হারহানা। এতল্লাই ন-আনিদি। তোঁয়ারার মুখত পোক লাগিলে অসুখ অইব।
আমি বললাম, পেয়ারা বাগানটা না কি আরও জমে উঠেছে?
গত বছর দুই লাখ ট্যাঁয়ার গইয়ম বেচছি।
আমার ভাগের টাকাগুলো কোথায়?
তোঁয়ার বাজি ট্যাঁয়ার অভাব আছে-না?
আমি ক্রমশ আবার রেগে যাচ্ছি দেখে রচনা বলল, স্যার, আলী চাচা আমাদের অতিথি।
তাতে কী?
অতিথি নারায়ণ।
সরি।
ওবা মাইয়া – – -।
চুপ করুন, আলী চাচা; সীমা অনেক আগে লঙ্ঘন করে ফেলেছেন। মেহমান হিসেবে কিছু বলিনি। আমার মেয়েটির সঙ্গে আর একটা কথাও বলবেন না। আপনার প্রত্যেকটা কথা অপমানজনক।
ঠিক আছে। আঁই মাইয়াওয়ারে লই বাসাত যাই।
না।
ক্যাঁয়া?
আপনি আমার বাসায় যাওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন। শরীরে কেউ ইচ্ছে করে পচা রক্ত ঢুকাই না।
বস্তির মাইয়া, আঁরাত্তুন বেশি অই গেছে?
শাহেদ? চিৎকার দিলাম স্বাভাবিকের চেয়ে কিছু উচ্চৈঃস্বরে।
জি স্যার, বলে দৌঁড়ে এলেন শাহেদ।
লোকটাকে এক্ষুনি বের করে দাও। ভবিষ্যতে যেন আমার রুমে কখনো ঢুকতে না পারেন। আজ থেকে আমার কোনো মেহমানকে আমার অনুমতি ছাড়া আমার রুমে আনবে না। বেশি দরদ থাকলে তোমার বাসায় নিয়ে যেও।
সরি, স্যার।