আসিফ হাসান
স্যমন্তক নামের উপন্যাসটির শিরোনাম দেখলে অনেকের ধারণা হতে পারে স্যমন্তক সম্ভবত হিন্দু পুরাণের কোন এক দেবতার নাম। কিন্তু তা নয়। স্যমন্তক একটি মণির নাম। যেটি শোভা পেতো সূর্যদেবের কণ্ঠহারে। বিষ্ণু পুরাণ এবং মহাভারত অনুযায়ী এই রত্ন

নাকি সোনার থেকেও ৮ গুণ বেশি জ্বলজ্বল করে। স্যমন্তক মণির স্পর্শে স্বর্ণে পরিণত করা যেত সাধারণ কিছু বস্তুকে। তবে শর্ত ছিলো কোনো বস্তুকে স্যমন্তকের স্পর্শে স্বর্ণে পরিণত করতে হলে ওই বস্তুটিরও কিছু যোগ্যতা থাকতে হবে। এই মণি উদ্ধার করতে গিয়ে একসঙ্গে ৪ জন স্ত্রী প্রাপ্তি ঘটে শ্রীকৃষ্ণের। স্যমন্তককে কেন্দ্র করে কৃষ্ণ ও অন্যদের সাথে অনেক দ্ব›দ্ব এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে। পুরানে উদ্ধৃত সেই কাহিনির শেষে কৃষ্ণের প্রয়াণ বা দ্বারকার পতনের পরে এই মণির কী হয়েছিল তা বলা হয়নি। অনেকে মনে করেন, কোহিনূর হিরেই হল পুরাণের স্যমন্তক। যদিও এই মত অগ্রাহ্য করেন বেশিরভাগ পণ্ডিত এবং রত্ন বিশেষজ্ঞ। তাঁরা মনে করেন এই রত্ন ছিল আসলে একটি দুর্লভ চুনী।
ড. মোহাম্মদ আমীন এমন একটি জটিল ও দুর্ভেদ্য শিরোনামে যে উপন্যাস লিখেছেন সেটি পড়া শুরু করলে এক গভীর তন্ময়তার মধ্যে গল্পের গভীরে প্রবেশ করতে হবে। উত্তম পুরুষে লেখা গল্পটির প্রধান চরিত্র রচনা। গল্পের শুরুতে রচনার নাম কখনো রাকখসনা কখনো রোখসানা বা রাকু হলেও পরবর্তীতে কাহিনির প্রয়োজনে সে হয়ে যায় রচনা। মানবিক মূল্যবোধ, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য, চটুল প্রেমকথা এসব গতানুগতিক কিছু কাহিনি সাধারণত উপন্যাসের প্রেক্ষাপট হলেও এই উপন্যাসের চরিত্র আখ্যান অন্যরকমের।
দৈবক্রমে বস্তিবাসি হলেও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা রচনা মেধার জোরে একটি প্রকল্পে চাকরি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে প্রথম হয়। তার মেধা দেখে কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি না দিয়ে অন্য কিভাবে কাজে লাগানো যায় সে চিন্তা করে। আর তখনি শুরু হয় গল্পের আসল নাটকীয়তা। বন্যাদুর্গত দেখিয়ে রচনার বাবাকে ঐ প্রকল্প থেকে একটি বিশাল অঙ্ক ঋণ মঞ্জুর করার মুহূর্তে রচনার বাবা মারা যায়। পরে এই ঋণ গ্রহণ করে রচনা। যার নেপথ্য কুশীলব ছিলেন লেখক স্বয়ং। তার পেশাগত সম্পৃক্ততা ছিলো ঐ প্রকল্পে।
নাটকীয়তা আর রোমাঞ্চে ভরপুর মানবিক আবেগের এক অপূর্ব সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে গল্পের গাঁথুনি। লেখকের বর্ণনায় ‘যে কাহিনি সত্য কিন্তু চরিত্রগুলো কাল্পনিক সেটি উপন্যাস। যে কাহিনি কাল্পনিক কিন্তু চরিত্রগুলো বাস্তব-সেটি ইতিহাস’। এখানে লেখকের

সাথে রচনার সম্পর্কটি এক জটিল জটাজালে আকীর্ণ। ঘটনার গভীরে যতই যাওয়া যাবে ততই এর কাহিনি পাঠককে ঘোরের মধ্যে নিয়ে যাবে। বাস্তবতা আর জীবনের জটিল বিষয় থেকে তিল তিল করে নেয়া ঘটনা দিয়ে এর কাহিনি রচিত। ভালোবাসা মানুষকে স্যমন্তকে পরিণত করতে পারে। কীভাবে একজন সাধারণ মানুষ স্যমন্তকের মতো মহামূল্যবান হয়ে উঠতে পারে এবং কীভাবে অন্যকেও অমন মূল্যবান করে তুলতে পারে- তা উপন্যাসটি পড়ার পরে বোঝা যায়।
বস্তি থেকে রচনা ও তার ছোট ছোট ভাই-বোনকে তুলে এনে শহরের অভিজাত বাড়িতে রেখে মানুষ করা এবং একপর্যায়ে লেখকেরও তাদের সাথে একত্রে বসবাস ঘটনাকে এমনই জটিল করে তোলে যে, পাঠকও বিভ্রান্তিতে পড়ে এ কারণে যে- রচনার সাথে লেখকের সম্পর্ক আসলে কী? লেখক এই সম্পর্কের বিষয়ে বলেছেন, রচনা কখনো তার মেয়ে, কখনো তার মা, আবার কখনো তার প্রেমিকা। বিষয়টি ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব অনুযায়ী একধরনের ইডিপাস কমপ্লেক্স।
মেধার জোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে বাংলায় পড়তে চায় রচনা। লেখকের ইচ্ছে ইংরেজিতে পড়ুক ও। কিন্তু রচনার জেদ সে বাংলায় পড়বে। একটি অনুবাদের কাজ দেখে কবীর চৌধুরী বলেছেন, রচনা বাংলাতেই পড়ুক। কারণ ও আমার চেয়েও ভালো ইংরেজি জানে। মেধার জোরে রচনা তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করার জন্য বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি পায়। পরে সেখানে প্রভাষক পদে নিয়োগপ্রাপ্তও হয়। রচনার এই চলে যাওয়া নিয়ে লেখকের মনে হয়েছে সত্যি রচনা দূরে চলে গেছে। নিজের সাথে রচনার সম্পর্কের অভিধা নিয়ে এক মনোজাগতিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে রচনার প্রতি তার ভালোবাসার রূপ কী? কোন অভিধায় সম্পৃক্ত এই সম্পর্কের ভিত্তি? ঠিক যেন গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিসের লেখা নাটক ইডিপাস কাহিনির মতো। যেখানে দৈববশে ইডিপাস না জেনে বিয়ে করতে বাধ্য হয় তার মা জোকাস্টাকে। মনোচিকিৎসক ফ্রয়েড সম্পর্কের এই জটিলতাভিত্তিক উদ্ভূত অসুস্থতার নাম দিয়েছিলেন ইডিপাস কমপ্লেক্স।
মানবজীবনের অনেক জটিল বিষয়ই থাকে যার কোন জবাব বা সমাধান একজনমেও পাওয়া যায় না। কেনই বা মানুষ সম্পর্কে জড়ায়, কেন ভেঙ্গে যায় তার কার্যকর কোন জবাবও নেই। সম্ভবত এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় নাটকীয়তা। লেখকের সাথে

রচনার সম্পর্কের বিষয়টিও তেমনি। দুজনের প্রতি দুজনের দুর্বলতা একরৈখিক না বহুরৈখিক- এই ধাধা পাঠককে একটি জটিল অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। আর এখানেই লেখকের বর্ণনায় মুনশিয়ানা ফুটে উঠেছে। তিনি পাঠককে এক প্রবল ঔৎসুক্যের মধ্যে রেখেছেন কাহিনির শেষ পরিণতি জানার। এই কাহিনি পাঠককে ভাবতে শেখায়, চিন্তা করতে শেখায়। মানব-মানবীর সম্পর্কের জটিলতা, প্রেমের রকম-ফেরসহ যাপিত জীবনের অনেক সূক্ষ্ম অনুভূতি।
প্রেমের মূল রহস্য আবিষ্কার করা না গেলেও প্রেমকে নানা ধরনের ব্যবচ্ছেদ তথা শিরা-উপশিরায় বিন্যস্ত করেছেন অনেকে। এর মধ্যে বয়সভিত্তিক (বাল্য ও কিশোর প্রেম, পরিণত বয়সের প্রেম, মধ্য ও প্রৌঢ় বয়সের প্রেম) প্রেম যেমন আছে, অন্যদিকে আছে প্লেটোনিক লাভ বা দেহাতীত প্রেম, একাধিক ও পরকীয়া প্রেম ইত্যাদি। প্লেটোনিক লাভ বা দেহাতীত প্রেম, অন্যদিকে প্রেমে শরীরের ভূমিকা কতটুকু কিংবা আদৌ আছে কি না- এ বিতর্ক অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। মতের সমর্থনে দুই পক্ষেরই যুক্তি রয়েছে। প্লেটোনিক লাভের সমর্থকরা তাদের যুক্তির সমর্থনে চেনা-পরিচিত এক বা একাধিক উদাহরণ টেনে আনার পাশাপাশি চণ্ডীদাস-রজকিনী ও দান্তে-বিয়েত্রিচের প্রেমের উল্লেখ করেন।
ফ্লোরেন্সের মহাকবি দান্তে যখন প্রেমে পড়েন তখন বিয়েত্রিচের বয়স মাত্র ৯। এরও ৯ বছর পর বিয়েত্রিচের কাছ থেকে প্রথম সম্ভাষণ লাভ করে আত্মহারা হয়ে পড়েন তিনি। তাকে নিয়ে রচনা করেন কাব্যগ্রন্থ ‘ভিটা নোভা’ (নতুন জীবন)। এদিকে বিয়েত্রিচের সঙ্গে দান্তের দেখা হয়েছিল মাত্র দু’-চারবার। ধারণা করা হয়, কবির আবেগের বিষয়ে সচেতন হওয়ার অবকাশ বিয়েত্রিচ আদৌ পাননি। সুতরাং বলা যেতে পারে, তাদের এ সম্পর্কটি স্বাভাবিক পরিণতি পায়নি। পরবর্তীকালে সাইমন নামে এক লোকের সঙ্গে বিয়েত্রিচের বিয়ে হয় এবং মাত্র ২৪ বছর বয়সে মারা যান কবির এই প্রেমিকা। বিয়েত্রিচের মৃত্যুর কয়েক বছর পর দান্তেও বিয়ে করেন গেমা নামে এক অভিজাত পরিবারের নারীকে।
প্লেটোনিক প্রেমের মতো দূরত্বটাকে বজায় রেখেও ভালোবেসে যাওয়ার একটা প্রচেষ্টা একরকম আবার শারীরিক দূরত্বে কার্পণ্য না থাকলেও মানসিক দূরত্ব হতে পারে অসীম। ভালোবাসার সম্পর্কের এই বহুমাত্রিক জটিল জালের মধ্যে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা অনেক সময়ই বেশ অসম্ভব হয়ে পড়ে। কোনো কোনো দম্পতির জীবনে ভালোবাসা এমন এক বিশেষ অনুভূতি, যে তারা শরীর ও মনের উর্ধ্বে গিয়ে, পরস্পকে আপন করে নিতে জানেন, শুধুই সম্পর্কের খাতিরে।
যদিও মনসমীক্ষণে অনেক সময় হারিয়ে যায়, ভালোবাসার মূল অর্থ বা ব্যাখ্যা। ডেল কার্নেগি এক সময় বলেছিলেন ভালোবাসার একমাত্র অবস্থান হতে পারে স্বার্থহীনভাবে ভালোবাসা। কোনো ভালোবাসার সম্পর্ককে হয়তো মোটা দাগে কোনো নামের খাঁচায় আবদ্ধ করে রাখা সম্ভব নয়। সেটা এমন এক আকার ধারণ করে যে, দিনের শেষে সেটা শুধু সম্পর্কই থাকে না হয়ে যায় ইতিহাস। প্রজন্মের প্রেমিক-প্রেমিকারা অনুপ্রেরণা পেতে পারে সেই ইতিহাস থেকে। তারা স্বপ্ন দেখতে শেখে ভালোবাসার মানুষের সাথে জীবন কাটানোর। যদি পুরুষের ভালোবাসা নিখাদ হয় নারীর প্রতি তবে হয়তো তাজমহলের মতো কোনো সৃষ্টি দাঁড়িয়ে থাকে। এই ব্যাখ্যার কোনো মাপকাঠি নেই, তবে আছে ইতিহাস।
রচনা আর লেখকের সাথে সম্পর্কটি কি প্লেটোনিক? না অন্যকিছু? পাঠককেই খুঁজে নিতে হবে এর জবাব!
উপন্যাসটিতে ’৮০ ও ’৯০ দশকের নাম করা অনেকেই এসেছেন কাহিনির প্রয়োজনে। প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, বাংলা

সাহিত্যের খ্যাতিমান অনেক কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক, প্রশাসক ও বুদ্ধিজীবী স্যমন্তকের চরিত্র। এরমধ্যে আছেন কবীর চৌধুরী, হাসনাত আবদুল হাই, হুমায়ুন আজাদ, জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, ইতিহাসবেত্তা আবদুল হক, মনিরুজ্জামান, আনিসুজ্জামান, হায়াৎ মামুদ, শিল্পী এস এম সুলতান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, আহমদ ছফা প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়।
স্যমন্তক কি ধরনের উপন্যাস এই বিশ্লেষণে গেলেও যে কোন পাঠক খেই হারিয়ে ফেলবেন। অনেক পাঠক বলেন, আত্মজীবনীমূলক স্মৃতিচারণ, কেউবা বলেন মনস্তত্বমূলক উপন্যাস। কারও কাছে এটি চেতনামূলক উপন্যাস। একজন বলেছেন, এটি কাব্যধর্মীমূলক প্রেমকাহিনি, একজন বলেছেন সামাজিক উপন্যাস। কয়েকজন এটাকে আর্থ-সমাজিক প্রেক্ষাপটে বিধৃত ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসাবেও মন্তব্য করেছেন। সমালোচকের ভাষায়, এটি উদ্দেশ্যমূলক কাহিনি উপন্যাস। লেখকের মতে, জৈবন্তিক উপন্যাস। অধ্যাপক হায়াৎ মাহমুদের মতে, ‘এটি এখানে বর্ণিত সব ধরণের উপন্যাসের সমন্বয়ে গঠিত একটি ব্যষ্টিক উপন্যাস। যেখানে সকল প্রকার উপন্যাসের স্বাদ একসঙ্গে পাওয়া যায়। এ যেন একের ভেতর অনন্ত। যেদিক দিয়ে বিবেচনা করা হোক না কেন, সব উপাদান স্যমন্তককে করেছে সমৃদ্ধ। জৈবিক বা সামাজিক বন্ধন

ছাড়াও কীভাবে মানুষ রক্ত সম্পর্কের চেয়েও আপনজন হয়ে যায়, তার একটি চমৎকার দলিল স্যমন্তক। ভালোবাসা থাকলে পৃথিবীতে আর কিছু লাগে না- এটিই স্যমন্তকের মূলকথা।’
পুথিনিলয় থেকে প্রকাশিত উপন্যাসটি যদিও ২০১৭ সালে প্রখম প্রকাশিত হয়। পঞ্চম সংস্করণটির ছাপা সুন্দর হলেও বানানে ভুলের আধিক্য এত বেশি- যা পাঠকের জন্য প্রবল পীড়াদায়ক। পরবর্তী সংস্করণে এই ভুলগুলো সংশোধিত হয়েই প্রকাশিত হবে- সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে এই প্রত্যাশা।
ঢাকা, ১৯ মার্চ ২০২০
সূত্র: স্যমন্তক: জটিল জটাজালের এক মানবিক উপাখ্যান. আসিফ হাসান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)।
অনুসজ্জা: মিনহা সিদ্দিকা
বিসিএস প্রিলি থেকে ভাইভা কৃতকার্য কৌশল
ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা বইয়ের তালিকা
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয়ক সকল গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/১
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/২
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন /৩
ইউরোপ মহাদেশ : ইতিহাস ও নামকরণ লিংক
কি না বনাম কিনা এবং না কি বনাম নাকি
মত বনাম মতো : কোথায় কোনটি এবং কেন লিখবেন
ভূ ভূমি ভূগোল ভূতল ভূলোক কিন্তু ত্রিভুবন : ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ
মত বনাম মতো : কোথায় কোনটি এবং কেন লিখবেন