স্যমন্তক: তৃতীয় পর্ব

ড. মোহাম্মদ আমীন

স্যমন্তক: তৃতীয় পর্ব

যথাসময়ে সাক্ষাৎকার শুরু হলো।
খান স্যারের নির্দেশমতে সবার শেষে রাকখসনাকে ডাকা হলো। যদিও লিখিত পরীক্ষায় প্রথম হওয়ায় রেওয়াজমতে তাকেই সবার আগে ডাকা উচিত ছিল। খান স্যারের উদ্দেশ্য সাক্ষাৎকারের আগেই তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দেওয়া। সারাদিন খেতেও পারেনি।
ড. মোহাম্মদ আমীন

রুমে ঢুকে মেয়েটি ভাইভা বোর্ডের সবাইকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিনম্র ভঙ্গিতে নির্ধারিত চেয়ারে বসে পড়ল।

খান স্যার গম্ভীর গলায় কিছুটা শ্লেষ ঢেলে বললেন, অনুমতি না-নিয়ে বেয়াদবের মতো বসে পড়লে যে?
এমন প্রশ্নে আমি হলে ভীষণ মুষড়ে যেতাম। রাকখসনা মুষড়ে পড়ল না। বরং এমনভাবে উৎফুল্ল হয়ে উঠল যেন, খান স্যার বোকার মতো প্রশ্ন করে ফেলেছেন। ঢোকার সময় তার মুখ ছিল কিছুটা আড়ষ্ট। ক্ষুধার যাতনাও ছিল। স্যারের ধমক-ভরা প্রশ্ন তার মুখে অচিরাৎ আলো ছিটিয়ে দিল যেন।
বিনীত গলায় বলল, স্যার, আমি জানি কখন অনুমতি গ্রহণ বুদ্ধিমত্তা আর কখন তা বোকামি।
: কী বলতে চাইছ?
: সাক্ষাৎপ্রার্থীর বসার জন্য নির্ধারিত চেয়ারে আমি বসেছি। এখানে কেবল একটা চেয়ারই। দাঁড়িয়ে সাক্ষাৎকার নেওয়ার ব্যবস্থা করা হলে চেয়ার রাখা হতো না। পূর্ব-নির্ধারিত বিষয় নিয়েও যদি আপনার নির্দেশনার অপেক্ষায় সময়ক্ষেপণ করি তাহলে এত কষ্ট করে যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন কী? যেকোনো একজনকে নিয়োগ দিয়ে দিলেই হয়!
খান স্যারের মুখ দেখে বুঝলাম তিনি রাকখসনার জবাবে খুশি হয়েছেন। যদিও এমন অকপট জবাব আশা করেননি। তাঁর মুখে একটা মলিন আভা এসে আবার মিলিয়ে গেল। আমি শঙ্কায় ভুগছি, মেয়েটাকে না বের করে দেন।
সিগারেটে জোরে একটা টান দিয়ে চায়ের কাপে ঠোঁট লাগিয়ে খান স্যার বললেন, চাকরিতে নিয়োগ পেলেও কি তুমি অনুমতি ছাড়া কাজ করবে?
: অনুমতি দরকার কি না, ভালোভাবে জেনে কাজ শুরু করব। সংশয় হলে পরামর্শ নেব। আগেই জেনে নেব আমার কর্মপরিধি—বিধিবদ্ধ ক্ষমতা। তার সঙ্গে বিবেচনা যুক্ত করে কাজ করব। প্রতিকাজে আপনার অনুমতি নিতে গেলে— আমার কী প্রয়োজন?
: তুমি কে?
: আমি একজন মানুষ, একজন মেয়ে, একজন বাংলাদেশি, একজন ছাত্রী, একজন নিয়োগপ্রার্থী, একজন বোন, একজন …।
: রাইট আনসার। অনেক হয়েছে, এবার থামো। অসংখ্য উত্তর হতে পারে। আমি জানতে চাইছি তোমর নাম কী?
: আমার নাম রাকখসনা, ডাক নাম রাকু।
: তোমার প্রিয় ব্যক্তি?
: আমি।
: তুমি ছাড়া?
: আপনি।
: কী!
খান স্যারের ভারিক্কি গলার মধ্যেও চিড় ধরার আভাস পাওয়া গেল। তিনি মনে মনে হয়তো ঘাবড়ে গেছেন। মেয়েটির ভয়হীন অবয়ব তাকে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে।
:আমি কীভাবে তোমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব হলাম? তোষামোদ করার জায়গা পাও-না!
রাকু বলল, প্রথম উত্তরটাই আমাকে বের করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। আপনি তেমন করেননি, দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরও আমি প্যাঁচিয়ে ফেলেছি, অবশ্য সুনির্দিষ্ট উত্তর দেওয়ারও কোনো সুযোগ ছিল না। তারপরও আপনি রাগ করেননি। এত ক্ষমতাশীল চেয়ারে থেকেও আপনার বিবেচনাবোধ আমাকে মুগ্ধ করেছে।
: আর একজন প্রিয় ব্যক্তির নাম বলো।
: রঞ্জন দেবনাথ। তিনি আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। আমাকে কন্যার মতো স্নেহ করতেন। তাঁর বাসায় থেকেই আমি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি।
ঠিক আছে, খান স্যার বললেন, “এবারের প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার বলা শেষ হওয়ার দুই সেকেন্ডের মধ্যে দিতে হবে। নইলে নিজে নিজে উঠে চলে যাবে।
:স্যার।
: একটা প্রাণী শুধু পিছন দিকে সাঁতার কাটতে পারে, নাম কী?
: চিংড়ি।
: চার আর চার যোগ করার পর উত্তর এলো ষোলো, কেন?
: ভুল হয়েছে, তাই।
: প্রিয়জন হওয়ার প্রধান শর্ত কী?
: প্রয়োজন। যত বেশি প্রয়োজন তত বেশি প্রিয়জন।
: ওয়াটার লু যুদ্ধ সংঘটিত না হলে কী হতো?
: প্রশ্নটা স্যার আপনি করতেন না। কে-ই বা চিনত ওয়াটার লু?
: তুমি বলতে চাইছ, যুদ্ধ বিখ্যাত হওয়ার একটি শর্ত।
: স্যার।
: যুদ্ধ আর শান্তির মধ্যে তফাত কী? এক বাক্যে বলতে হবে।
: যুদ্ধের সময় পিতাকে সন্তানের লাশ বহন করতে হয়, শান্তির সময় সন্তানই পিতার লাশ বহন করে।
: তোমার বয়স কত?
: সতেরো বছর তিন মাস।
: লিখিত পরীক্ষায় তুমি কেমন করেছ বলে মনে হয়?
: এটা স্যার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। একজনকেই নেওয়া হবে। আমি নিরানব্বই পেলেও ভালো করেছি বলতে পারব না।
: কেন?
: কেউ একশও পেয়ে যেতে পারে।
: যদি তোমার চাকরিটা না-হয় কী করবে?
: অন্য কোথাও চেষ্টা করব।
: বাচ্চা মেয়ে, ভালো রেজাল্ট, অল্প বয়স, কেরানির চাকরি কেন?
: সাক্ষাৎকারে যোগ্যতা যাচাই করা হয় স্যার। অভাব-অভিযোগের কথা বলা কি উচিত হবে স্যার? মনে করতে পারেন—সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা।
স্যমন্তক, পুথিনিলয়।

: অভাব-অভিযোগের কথা না-বলেও উত্তর দেওয়া যায়— যায় না?

: স্থান, সময় ও কার্য বিবেচনায় এই মুহূর্তে একটা চাকরি অতি জরুরি।
খান স্যার অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছেন। সে এমনভাবে উত্তর দিচ্ছিল যেন, প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর বছর বছর ধরে মুখস্থ করে আসছে। দুই সেকেন্ডের আগেই উত্তর দিয়ে দিচ্ছে। তার সাবলীল ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছিল খান স্যার নিজেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।
আর একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বললেন, তোমার প্রিয় কবি কে?
: রবীন্দ্রনাথ।
: তোমার প্রিয় একটি কবিতার চারটি চরণ বলো? দুই সেকেন্ডের মধ্যে কিন্তু।
: বিপদে মোরে রক্ষা কর, এ নহে মোর প্রার্থনা—
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাই বা দিলে সান্ত্বনা
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।
: তোমাকে কত নম্বর দেওয়া উচিত?
: এ বিবেচনা স্যার সম্পূর্ণ আপনার।
: আমার জায়গায় তুমি হলে কত দিতে?
: দশে দশ।
: আর একটা প্রশ্ন করব বলতে পারলে দশে দশই দেব। করব?
: না স্যার।
: কেন?
: এত নম্বর দিলে অহংকার এসে যাবে।
: তাতে কী?
: পরীক্ষার খাতায় একশ ভাগ খাঁটি হওয়া হয়তো সম্ভব, কিন্তু পরে ওই স্থানে টিকে থাকা সম্ভব না-ও হতে পারে।
: দশে দশ দিয়ে আমি তোমাকে অহংকারীই করে দেব। অহংকার পতনের মূল।পতন হওয়ার শর্ত কী?
: পতন হতে হলে স্যার উঠতে হয়। না-উঠলে পতন হওয়ার সুযোগ কই।
: তুমি আসলেই মেধাবী, তোমাকে আমি তুলেই দেব। চা চলবে?
: না, স্যার।
: কেন?
: আমি কালো, চা পান করলে আরও কালো হয়ে যাব। বিশ্বাস না-করলেও চায়ের টাকা বাঁচানোর জন্য মা এমন বলতেন। প্রতিবাদ করতাম না।
: কেন প্রতিবাদ করতে না?
: প্রতিষ্ঠা করতে না-পারলে প্রতিবাদ করা অর্থহীন।
: তুমি তো অভাবের কথা বলেই দিলে!
: এসেই গেল, কথায় কথায়।
: গান করতে পার?
: পারি।
: একটা গান কর।
: একদিন চিনে নেবে তারে,
তারে চিনে নেবে
অনাদরে যে রয়েছে কুণ্ঠিতা।
স্যার বললেন, চমৎকার। আমরা তোমাকে চিনে নিলাম।
: ধন্যবাদ।
পুথিনিলয়

: হারমোনিয়াম বাজাতে জানো?

: কিছু কিছু, স্কুলে শিখেছিলাম।
: বাসায় হারমোনিয়াম আছে?
: না।
রাকু বের হয়ে যাওয়ার পর খান স্যার কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থেকে আর একটা সিগারেটে আগুন দিলেন। রাকুর উত্তরপত্রে চোখ বুলিয়ে ইফাদ-প্রতিনিধির দিকে তাকিয়ে সবাই শোনার মতো শব্দে ফিসফিসিয়ে বললেন, এমন মেধাবী মেয়ে দেখিনি। সনদ ইন্টারের কিন্তু মেধা? ওহ মাই গড, তার পুরো শরীরটা যেন মাথা।
আমি বললাম, হাতের লেখা কী সুন্দর!
খান স্যার বললেন, তুমি লেখা দেখলে, কথাগুলো শুনলে না?
: শুনেছি স্যার।
: কথা নয় যেন বৃষ্টির আওয়াজ, কী অঝোরে ঝরিয়ে গেল। যাও মেয়েটাকেই নিয়োগ দিয়ে দাও। সম্ভব হলে কালই জয়েন করতে বলো। আমার এমন সাহসী প্রতিভার প্রয়োজন। রাস্তায় ভূরিভূরি মেধাবী ঘুরছে, এমন দ্রৌতিক প্রতিভা দেখিনি।
——————-
ওয়েব লিংক
Language
error: Content is protected !!