ড. মোহাম্মদ আমীন
জিপিওতে একটা সভা ছিল। দাতাগোষ্ঠীর পক্ষে কয়েকজন বিদেশি বিশেষজ্ঞ এসেছেন। ডাক বিভাগকে কীভাবে আধুনিক করা যায় তা নির্ধারণই ছিল সভার আলোচ্য বিষয়। মন্ত্রণালয় আমাকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছে। সভাশেষে ফেরার পথে বারান্দায় ফয়জুলের সঙ্গে দেখা। সে আর আমি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে একই শিক্ষাবর্ষের অধীতী ছিলাম। চাকরিতে আমার ব্যাচম্যাট, তবে সে পোস্টাল আর আমি অ্যাডমিন ক্যাডারে। বহুদিন পর দেখা। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলাম।
কেমন আছ ফয়জুল? আমি জানতে চাইলাম।
ভালো, মিটিঙে এসেছিলে বুঝি?
হ্যাঁ।
তুমি কেমন আছ? ফয়জুলের সৌজন্য বাদ।
ভালো।
চাকরি কেমন চলছে?
“আরে ভাই”, ফয়জুল বলল, “আমাদের চাকরি! তোমরা হচ্ছ গিয়ে কিং-ক্যাডার। এমনি ভালো আছি, তবে তোমাদের দেখলে আর ভালো থাকতে পারি না। মনটা আল্টিমেটলি খারাপ হয়ে যায়।
আমরা কী করলাম?
পোস্টাল একটা ক্যাডার! কেউ পাত্তা দেয় না। বউ বলে— বলে পচার টাল ক্যাডার।পচার টাল থেকে নাকি পোস্টাল।
“সরকার একটা শরীর”, আমি বললাম “প্রতিটি দপ্তর সরকার নামের শরীরের অত্যাবশ্যক প্রত্যঙ্গের মতো সুনির্দিষ্ট কাজে নিয়োজিত। বড়োছোটো ভাবা অবান্তর। প্রতিটি অঙ্গের নির্দিষ্ট কাজ আছে এবং একটি অঙ্গও পরিহার্য নয়। যদি কোনো প্রত্যঙ্গ না থাকে বা অকেজো হয়ে যায় তাহলে ওই শরীরধারীকে বলা হয় প্রতিবন্ধী। সরকারও অমন।”
এটি কথার কথা, ঠ্যাং কি আর মাথার মর্যাদা পায়? তোমরা হলে গিয়ে মাথা, আমরা ঠ্যাং।
এমন করে বলছ কেন ভাই?
“চলো আমার রুমে” বলে ফয়জুল একপ্রকার জোর করে তার রুমে নিয়ে গেল। বিশাল রুম, চারিদিকে তাকালাম। আমার সচিবের রুমের সমান। অনেকগুলো চেয়ার।
বললাম, তোমার যে বিশাল রুম, সে তুলনায় আমারটা তো ভাই ওয়াশরুমের চেয়ে ছোটো। চেয়ার নাড়তে গেলে দেওয়ালে লেগে যায়। তিন জন বসতে কষ্ট হয়। তোমার রুমে তো জনসভা ডাকতে পারবে। এমন রুমে আমরা দশ জন বসি।
হোক ওয়াশরুম, তোমার রুম ভর্তি সোনা আর আমর রুম ভর্তি খড়। মন্ত্রণালয়ে তোমার ক্যাডারের জুনিয়র পোলাপাইনদেরও স্যার স্যার করতে হয়। কী লজ্জা!
করো কেন?
নইলে মাইন্ড করে।
তাতে কী?
আমাদের চিঠিপত্র গেলে ফেলে রাখে।
কয়দিন ফেলে রাখবে?
নেগেটিভ নোট দেয়।
সচিবকে কমপ্লেইন করো।
দোস্ত, এখানেই তো কবি নীরব, তিনিও তাই চান।
কী চান?
তোমাদের সবাইকে অন্যরা স্যার স্যার করুক।
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, প্রকৃচি (প্রকৌশলী কৃষিবিদ ও চিকিৎসক) এমনি এমনি হয়নি দোস্ত।
আচ্ছা তোমাদের ক্যাডারের লোকজনের এত অহংকার কেন?
এটি ইংরেজ প্রভু থেকে পাওয়া। হুমায়ুন আজাদ বলেন- “যারা কম জানে তারা একটু অহংকারী হয়।”
হুমায়ুন আজাদ সাহেবও অহংকারী। তার মানে সেও কম জানে। শালা একটা বদ্ধ উন্মাদ।
অহংকার দুঃখ আর পতনের মূল। দেখিও, খুব শীঘ্রি এ অহংকারী সদস্যওয়ালা ক্যাডারের পতন ঘটবে। আমরা আসলে “জ্যাক অব অল ট্রেডস বাট মাস্টার অব নন।” বিশেষায়িত যুগে এমন লোকদের প্রয়োজন ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে।
এসময় নাজমুল রুমে ঢোকেন। আমরা কথা থামিয়ে তার দিকে তাকাই। ফয়জুল আমাকে নাজমুলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বলল, নাজমুল, শান্তিনগর পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার।
চিনি।
কীভাবে?
তার পোস্ট অফিসে আমার মেয়ের ত্রিশ লাখ টাকার একটা সেভিংস আছে।
তুমি এখনো বিয়েই করনি, মেয়ে এল কোত্থেকে?
এখানেই তো কবি নীরব, আমি বললাম।
বল না, দোস্ত, ফয়জুলের অনুরোধ।
বিয়ে করলে যে মেয়ে হবে, সেটা তোমাকে কে বলল? আমার এক চাচা তিন বিয়ে করেছেন। তার মেয়ে দূরে থাক, কোনো ছেলেই নেই।
বসো, নাজমুলের দিকে তাকিয়ে ফয়জুল বলল।
নাজমুল আমাদের সালাম দিয়ে বসতে বসতে বললেন, পোস্ট অফিসেই স্যারের সঙ্গে পরিচয়। স্যার, আপনি কেমন আছেন? কেমন আছেন আপামণি?
ভালো।
স্যার, একটা সমস্যার কথা বলি?
বলুন।
আপনি স্যার আমাকে তুমি করে সম্বোধন করবেন।
ঠিক আছে।
আমার বড়ো মেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে। কিছুদিন থেকে মহল্লার তিন মাস্তান স্কুলে যাবার পথে উত্যক্ত করতে থাকে। এখন সীমার বাইরে চলে গেছে। জীবন অতিষ্ঠ। নিজের বাসা না-হলে অন্য কোথাও চলে যেতাম। বউ বলে— আমি অপদার্থ স্বামী, অথর্ব বাপ। মেয়ের সামনে যেতে পারি না, অপমানে বিধস্ত হয়ে যাই।
গার্ডিয়ানকে জানাওনি?
গার্ডিয়ানের কাছে বিচার দেওয়ার পর উত্যক্ত করার পরিমাণ আরও বেড়ে গেছে। পাগলা কুত্তার মতো হয়ে গেছে ছেলেগুলো। মনে হলো ওগুলো মানুষের জন্ম না।
থানায় জানাও।

ফয়জুল বলল, থানায় জানানোর কয়েকদিন পর স্কুলে যাবার পথে মাস্তান তিনজন তার মেয়ের ওড়না নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। গায়েও হাত দিয়েছিল। আমি থানায় বলেছিলাম। পোস্টাল ক্যাডারের সদস্যের কথা কেউ পাত্তা দেয় না। পাত্তা দেয়নি ওসি। তুমি পারলে একটু সাহায্য করো। বেচারা বড়ো কষ্টে আছে।
কী বলো এসব! আমার চোখে বিস্ময়।
রাজ ক্যাডারে আছ, তাই বুঝতে পারছ না প্রজারা কেমন আছে।
নাজমুল বলল, মেয়ে আর স্কুলে যাচ্ছে না। আমরাও এ অবস্থায় তাকে স্কুলে পাঠানো নিরাপদ মনে করছি না। স্যার, আপনার ক্ষমতা আছে, কিছু একটা করুন। নীরিহদের অবস্থা খুব খারাপ। চব্বিশটা ঘণ্টাই আমার কাছে মৃত্যু যন্ত্রণার মতো অসহনীয়। বাসায় ঢুকতে লজ্জা করে।
ওয়ার্ড কমিশনারকে জানিয়েছিলে?
হ্যাঁ।
কী বলেছেন?
মাস্তানগুলো প্রভাবশালী। এদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবেন না। তাদের ভোটেই নাকি তিনি কমিশনার হন।
তিনটি ভোটে কমিশনার হন! মগের মুল্লুক নাকি?
ফয়জুল বলল, মগের মুল্লুকই তো। ভোট তো আর পাবলিক দেয় না।
কারা দেয়?
“না জানার ভান করো না।”, ফয়জুল বলল, “ভোট মাস্তানেরা কেড়ে নেয়। আর তোমরা তাদের সাহায্য কর। বিনিময় রাজভোগ।”
বিস্তারিত জানিয়ে তখনই পুলিশ কমিশনারকে ফোন করি। কমিশনার সজ্জন ব্যক্তি। মন্ত্রণালয়ে চাকরি করার সুবাদে পরিচয়। তিনি পুরো ঠিকানা এবং উত্যক্তকারীর পরিচয় দিতে বললেন। আমি রিসিভার দিলাম নাজমুলকে। নাজমুল কথা শেষ করে রিসিভার দিলেন আমাকে।
কমিশনার বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং খুব দ্রুত।
থ্যাংক ইউ।