ড. মোহাম্মদ আমীন
অক্সফোর্ড রচনাকে বিশাল এক বৃত্তি দিয়েছে। রেজিস্টারের কাছ থেকে এ সংবাদ পেয়ে মনটা তৃপ্তির শান্তিতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
কত দিনের মধ্যে যেতে হবে?
রেজিস্টার বললেন, ঠিক বলতে পারব না। এই মুহূর্তে কাগজটা ভিসি স্যারের টেবিলে। তবে সময় কম, রচনাকে তাড়াতাড়ি বাংলাদেশ ছাড়তে হবে। পাসপোর্ট আছে?
আছে।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খবর হয়ে যায় সবখানে। বিশ্ববিদ্যালয় গিয়ে আমিই কাগজগুলো নিয়ে এলাম। ভিসার আবেদন ফরম পর্যন্ত পাঠিয়েছে। কী নিখুঁত কাজ তাদের।
শিক্ষক-সহপাঠীরা অভিনন্দন আর ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিচ্ছে রচনাকে। সবচেয়ে আগে এসেছে মাজেদ সাহেব ফুলের একটা বিরাট তোড়া নিয়ে। পত্রিকার লোকও এসেছে। আমি আনন্দের বন্যায় ভেসে ভেসে যেন সানন্দে অনেক দূর চলে যাচ্ছি।
দুপুর দুটো থেকে রাত একটা পর্যন্ত মেয়েটাকে সংবর্ধনা আর উপহারে মেতে থাকতে হয়েছে। এমন খবর পেলে যে আনন্দ হওয়ার কথা রচনার তার তিলমাত্র দেখতে পেলাম না। বরং ভীষণ এক বিষণ্নতা তাকে ঘিরে ধরেছে। সবাইকে দেখানোর জন্য মুক্তার মতো দাঁতগুলো দিয়ে হাসির মতো যেটি দিচ্ছে, সেটি হাসি নয়, ফাঁসি। তার এমন বিষণ্ন হাসির কারণ সবাই বুঝতে না-পারলেও আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম। কেউ কেউ বুঝতে পেরে কারণ জানতে চাইছে। রচনা এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গিমায় উত্তর দিচ্ছে- পাওয়াটা প্রত্যাশার বাইরে ছিল। অতিরিক্ত কোনো কিছু ভালো নয়, তাই।
সবাই চলে যাবার পর আর স্থির থাকতে পারল না রচনা। ডুকরে কেঁদে উঠে আমার দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে বলল, স্যার আপনি এমন করতে পারেন না।
আমি কী করেছি?
নিশ্চয় কিছু করেছেন।
তুমি যদি গোপনে রিজেক্ট লেটার পাঠাতে পার, আমি গোপনে সেটি ফেরত আনতে পারব না কেন?
আমি যাব না, যাব না, বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। তার সঙ্গে কাঁদতে থাকে আল্পনা-কল্পনা, টুটুল ও নিনি। আমার চোখও ভরে এল জলে। সবার মনের আবেগ জীবনের বোধশোধ আর চাওয়া-পাওয়া লাঙলের ফলার মতো উলটে দিচ্ছে। আমি ভাবলাম- ফসলের জন্য এমন কর্ষণ প্রয়োজন।
মেয়ে এমন করে না, কান্না লুকিয়ে বললাম।
আমাকে তাড়িয়ে দিতে এত তোড়জোড় কেন স্যার?
আমার দুর্বলতা বুঝতে পারলে সবার কান্না আরও বেড়ে যাবে, রচনা হয়তো যাবেই না অক্সফোর্ড। আমি চোখের পাতা দিয়ে চোখের জল মুছে কঠোর হয়ে উঠার ভান করি। কিন্তু কাজটা আসলেই সহজ ছিল না। জল দিয়ে জল ঢাকতে গিয়ে জল আর প্রবল হয়ে উঠল।
আগুন প্রয়োজন।
আগুন গলায় বললাম, চুপ সবাই।
কিন্তু আগুনটা আগুনের মতো হলো না। বরং আতশবাজির মতো বিনোদনের হয়ে গেল। রচনা বলল, চুপ করব কেন? আপনিই আমার সব। আপনার সেবাই আমার প্রার্থনা। আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।
আমি কারও জন্য কিছু করিনি। তুমি যদি নিয়োগ পরীক্ষায় আটানব্বই না-পেতে অক্সফোর্ড যাওয়ার ঘটনা হয়তো ঘটত না। নম্বর পাওয়ার সময় তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। এত নম্বর পেতে গেলে কেন?
আমি এসব মানি না।
কী মান?
আমার একজন শুভাকাক্সক্ষীই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন।
তোমার প্রতিভা, মেধা, অধ্যবসায়, শ্রম, চেষ্টা আর অতীতের অর্জন কিছুই না?
না। আপনিই আমার সবকিছু।
বাজে কথা বলো না।
বস্তিতে যখন আমার বাবা ব্যথার চিৎকারে আকাশ ফাটিয়ে দিত, আমার শরীরের দিকে ধেয়ে আসত কসাই মইজ্জা, সন্ত্রাসী হানিফ-রুবেল-কালু; বাবাও যখন পেটের দায়ে তাদের সঙ্গে মেশার ইশারা দিত তখন কেউ আসেনি আমাকে উদ্ধার করতে। হাজার হাজার লোক তামাশা দেখেছে। আপনিই আমাকে উদ্ধার করেছেন। আমি যাব না।
যেতে হবে।
জোর করে শরীর পাঠাতে পারবেন, মন নয়।
মন জাহান্নমে যাক, শরীরটা গেলে হবে। ফাজলামো করার জায়গা পাও না!
আমার এমন রাগের কথা রচনা আর কখনো শোনেনি। হতবাক হয়ে একবার আমার দিকে চেয়ে দৌড়ে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। ভেতর থেকে তার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।
আমি তার রুমের দরজার কড়া নেড়ে বললাম, খোলো?
দুবার বলতে হলো না। দরজা খুলে দিল, খুলে দিয়ে আবার বিছানায় উপুড় হয়ে আদুরে বালিকার মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, আমার মা-বাবা থাকলে এমন জোর কেউ করতে পারত না। আামর কেউ নেই, আমিও তো আমার না।
তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?
হ্যাঁ, আমি পাগল হয়ে গেছি। যে মেয়েটির কেরানি হওয়ার কথা ছিল সে মেয়ে অক্সফোর্ড যাচ্ছে, যে মেয়ে পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেছে সে প্রফেসর হবে, পাগল না-হয়ে কী হব, স্যার?
দেখো, মেয়ে; আকাশ তোমায় ডাকছে।
আপনিই আমার আকাশ। তাই আকাশেই থাকব।
শোনো মেয়ে, মানসিকভাবে রেডি হয়ে নাও দেশ ত্যাগের। আকাশ সর্বত্র বিদ্যমান। আগামীকাল লন্ডন হাইকমিশন অফিসে যেতে হবে।
স্যার, আপনি আমাকে একটুও ভালোবাসেন না। ভিক্ষুকের মেয়ে, বস্তিতে জীবন, চামড়া কালো, পরের বাড়ির বুয়া তাকে কে ভালোবাসে? তাই তাড়িয়ে দিচ্ছেন।
ভালোবাসার একটা কর্তব্য আছে। আমি কেবল সেটা পালন করছি। বিসর্জন অর্জনের পূর্ব শর্ত।
কর্তব্য যেখানে প্রবল, ভালোবাসা সেখানে রাঁধুনির বঁটির তলায় ধড়ফড় করা পুঁটি মাছের মতো অসহায়। আর কতদূর তুলবেন স্যার? আমি যদি হারিয়ে যাই তো আপনার কষ্ট হবে না?
হারাবে না।
যদি আপনাকে ভুলে যাই?
ভুলে যাওয়া এত সহজ হলে মানুষের কষ্ট আরও কমে যেত।
আপনি আমাকে এক সেকেন্ডের জন্যও ভালোবাসতে পারেননি। কর্তব্যের নিচে চাপা পড়ে গেছে সব ভালোবাসা। আপনি আমার জন্য যা করেছেন তা ভালোবাসা নয়, করুণা। যে কেউ সহজে করুণা করতে পারে। স্যার, ভালোবাসা খুব কঠিন।
রচনা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে। এসময় তাকে থামাতে হলে কিছু লোভনীয় উপহার দিতে হবে। তাকে খুশি করার উপহার আমার জানা আছে।
রচনার কপালে চুমো দিয়ে বললাম, কয়েকদিনের জন্য সিলেট ঘুরে এলে কেমন হয়?
মুহূর্তে প্রফুল্ল হয়ে ওঠে রচনা, কখন যাব স্যার?
আপনি যখন বলেন।
আপনি কখন হয়ে গেলাম স্যার?
এটা আদরের ডাক। কদিন পর প্রফেসর হচ্ছেন।
যাহ।