ড. মোহাম্মদ আমীন
১০
চট্টগ্রামে রাকুর কাজ আপাতত শেষ। ড্রাইভার মাসুম তাকে বাস স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। সে একদিন বাসায় থাকবে। পরদিন তার বাবাকে নিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসবে। সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হলো রাকুকে।
স্যর, আমার জন্য এত করছেন কেন? রাকু জানতে চাইল আবার।
: মেয়ে, তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।
: স্বার্থ ছাড়া কেউ কিছু করে না, তাই জানতে চাইছিলাম।

: কে বলেছে স্বার্থ ছাড়া করছি? শোনো মেয়ে, মানুষের মতো স্বার্থপর কেউ নেই। আমি ঈশ্বরের চেয়েও বেশি স্বার্থপর। স্বার্থের জন্য নেকড়ের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারি। দেখতে চাও? অপেক্ষা করো, দাঁতগুলো শানিয়ে নিই।
রাকু ভয়ে ভয়ে বলল, স্বার্থটা কী স্যার? আই মিন, ধরনটা জানতে চাইছি।
: ধরন যেন করবে কী? স্বার্থের মর্যাদা তুমি দিতে পারবে?
: পারব।
: চেয়ে নিতে হবে না তো ঋণের মতো?
: আমার কৃতজ্ঞতাবোধ শ্রদ্ধার মতো পবিত্র। ভালোবাসার মতো উদার। আপনার সম্মান রাখতে পারব।
: কীভাবে রাখবে?
রাকু বলল, আমার সকল গর্ব নিঃসঙ্কোচে ধুলোয় মিশিয়ে দেব, কৃতজ্ঞ হওয়ার গর্ব এক চুলও ছাড়ব না, কখনো না, কোনোদিনও না। লক্ষ্যকে সখ্য করে এগিয়ে যাব। কেউ বিচ্যুত করতে পারবে না।আমি বস্তির মেয়ে, ফুটপাতে যার জন্ম রাজভবন তার না হলেও চলে।
: গাড়ির সময় হয়ে এসেছে। এখন তোমাকে যেতে হবে।
: স্যার, আপনার ঋণ শোধ করতে পারব না।
: তোমার শোধ করতে হবে না। তোমার কাজই তোমার ঋণ অন্যভাবে অনেকগুণ বাড়িয়ে শোধ করে দেবে। বরং তোমার কাছেই অনেকে ঋণী হয়ে থাকবে। সভ্যতা এভাবে ঋণে ঋণে নির্মিত। তুমি তো এতক্ষণ তাই বললে, তাই না? গাড়িভাড়া আছে?
: নেই।
গাড়িভাড়ার জন্য কিছু টাকা রাকুর হাতে দিয়ে বললাম, এসো।
রাকু আবার পা ছুঁয়ে শ্রদ্ধা জানাল। সবার সামনে বারবার পায়ে-ধরা, লজ্জা করছিল। মেয়েটা তো খুকি না, বয়সে কম হলেও মাংসে আমার চেয়ে বেশি।
বললাম, পায়ে কেন?
: শ্রদ্ধাবোধই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের খাঁটি মাধ্যম। আপনি আমার ঈশ্বর, নতুন জীবন দিতে যাচ্ছেন। প্রণতির শেষ থাকতে নেই। এর চেয়ে বেশি জানি না। মা-বাবার কাছে এমন শিক্ষাই পেয়েছি।
: মেয়ে, তুমি একটু বেশি কথা বলো।
: স্যার, শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কৈফিয়ত দিতে হয় না।
: মেনে নিলাম। এখন যাও, দেরি হয়ে যাচ্ছে। সাবধানে যেও।
: স্যার, আপনি আমার ভগবান।
রাকুর আবেগ এখন শ্রদ্ধায়। এমন শ্রদ্ধাবেগ আমার শরীরে উৎসাহের পরশ বুলিয়ে দিল। অজিতের চোখে জল, পিয়ন কাশেম জল ঢাকার জন্য বাইরে চলে গেছে।
মাসুম সবার সামনেই কেঁদে দিল, স্যার, আপুকে আমি নিয়ে যাই ঢাকায়?
: কেন?
: এমনিই আমাকে গাড়ি নিয়ে ঢাকায় যেতে হবে।
: কারণ?
অজিত বলল, কিছু গোপনীয় ডকুমেন্ট আনতে হবে। অফিসের গাড়ি নিয়েই যেতে বলেছেন— খান স্যার।
বিষয়টা আমার মনেই ছিল না। আমি মনে মনে খুশি হয়ে বললাম, তোমাদের যা ভালো মনে হয় করো।
মাসুম রাকুর ব্যাগ নিয়ে নিচে চলে গেল। অজিত তার রুমে। রাকু এখনও বসে। অফিসের গাড়িতে যাচ্ছে, সময়ের তাড়া নেই। নিজের গাড়ি থাকলে সময়কেও মাঝে মাঝে কিছুক্ষণের জন্য থামিয়ে রাখা যায়। রাকুর দিকে তাকালাম। তার চোখের জলে কৃতজ্ঞতার ঢেউ। মুখের আবহের মায়ামেঘ শ্রদ্ধায় শ্রদ্ধায় পূর্ণ হয়ে কৃতজ্ঞতায় গিয়ে একাকার। সে কিছু বলতে চাইছে।
: মেয়ে, কিছু বলবে?
: স্যার।
: বলো
: আমি স্যার আপনার পায়ে আমার কপালটা ছুঁইয়ে দিই?
: বাড়াবাড়ি ঠিক না।
: ভগবানের পায়ে মাথা রাখলে বাড়াবাড়ি হবে কেন, স্যার?
: এমন পাগলামি করছ কেন?
: স্যার, ঈশ্বরপ্রেম পাগলামিই, ছুঁইয়ে দেই?
আমি চুপ করে থাকলাম। রাকু আমার পায়ের জুতো-মোজা খুলে দুই পায়ে দুটো চুমো খেয়ে উঠে দাঁড়াল। আমি দেখলাম— সে সদ্যস্নাত রমণীর মতো নিটোল প্লাবনে ঝরঝরে হয়ে গেছে বৃষ্টিহীন বৈশাখের টলমল আকাশের মতো ঐশ্বর্যে। তাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে।
: স্যার, আজ আমার পুনর্জন্ম হলো।
আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, প্রত্যয় তোমাকে আরও বিকশিত করুক। অতীতের কষ্টগুলো অন্তরে প্রতিজ্ঞা-প্রতীতির ভোর হয়ে প্রতিশোধের উল্কা হয়ে উঠুক, ফিরুক সবার দ্বারে দ্বারে কোজাগরি রাতের মতো সমৃদ্ধির ভান্ডার হয়ে।

: আমি একসময় নিজেকে বড়ো ভালোবাসতাম, স্যার।
: এটাই জীবনের অভিধান। জীবনের সব অর্থ ভালোবাসা নামের অভিধানে খুঁজে পাওয়া যায়। এত স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনাভিধান আর নেই।
“ভালোবাসা খুব বেশি ভালোবাসা চায়।”, রাকু বলল, “কষ্ট সহ্য করতে না-পেরে একদিন আমার সব ভালোবাসা আমাকে ছেড়ে চলে গেল। ভালোবাসার জায়গায় ঠাঁই নিল ঘৃণা। ভগবানের পায়ে চুমো খাওয়ার পর আবার নিজের প্রতি ভালোবাসা ফিরে ফেলাম। বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠছে।
: বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাই ভালোবাসা।
: আপনি আমার হারানো ভালোবাসা ফিরিয়ে দিয়েছেন। আপনি আমার ঈশ্বর।
ঈশ্বর কয় জন?
সমাজ বিজ্ঞান বলে এখন সাড়ে ছয় হাজার। থিওলজি বলে, তিনি সর্বত্র বিদ্যমান। তা যদি হয় তো অগণিত, যত ধুলো তত ঈশ্বর, যত বাতাস তত ঈশ্বর; যত জল তত ঈশ্বর। জীবন মাত্রই ঈশ্বর, অনুভব মাত্রই ইশ্বর। একেক জনের কাজে একেক জন ঈশ্বর। একজনের ঈশ্বর অন্য জনের কাছে হতে পারে হাস্যকর। এই যেমন আপনি আমার ঈশ্বর, অনেকে তা শুনে হাসবে। আবার তার ঈশ্বরের কথা শুনেই অনেকে হাসবে।
: ঈশ্বর কী?
ব্যাখ্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল রাকু, ঈশ্বর তিনি, যিনি তাঁর সৃষ্টির কল্যাণ-পুজোয় আনত থাকেন সারাক্ষণ।
: কী বললে?
: ঈশ্বর তিনিই, যিনি তাঁর সৃষ্টির মঙ্গলের জন্য সৃষ্ট। এসব আমি আপনাতেই পেয়েছি। হৃদয়ের শুদ্ধতা, সহিষ্ণুতা, করুণা ও দয়ার মাধ্যমে জীবনকে দেখতে হবে। রবি ঠাকুরের ভাষা ছাড়া এই মুহূর্তে কিছুই মনে পড়ছে না আমার— আপনি ছাড়া। রবি ঠাকুর বলেছেন:
মিলনেরে করুক প্রখর
বিচ্ছেদেরে করে দিক সুন্দর।
আমি রাকুর কথা শুনছিলাম। এত অল্প বয়সে তার দর্শন, বলা আর ভাবনা মোহিত করে দেওয়ার মতো। সত্যি, অসম্ভব প্রতিভা তার, খান স্যারের ভাষায়, পুরো শরীরটাই যেন মাথা।
: মেয়ে, রবীন্দ্রনাথের কয়টা কবিতা তুমি জান?
: স্যার, প্রায় সবকটি। ধরে নিন সবগুলো; বলুন কোনটি বলব?
কী! আমি বিস্ময়ে আঁতকে ওঠি অবিশ্বাসের তোড়ে।
১১
রাকুর বাবা বাবুলের অনুকূলে পয়ঁত্রিশ লাখ টাকা ঋণ প্রদানের প্রস্তাব খান স্যার অনুমোদন করেছেন। আদেশটা পেয়ে মাথা থেকে বিরাট এক বোঝা নেমে গেল। যদি অনুমোদন না-হতো তাহলে রাকুর কী হতো! কোনোদিন ক্ষমা করতে পারতাম না নিজেকে। এবার রাকুর বাবার হাতে চেক তুলে দেওয়ার পালা।
সকালেই চলে আসার কথা রাকুর। সকাল গড়িয়ে বিকেল, রাকুর দেখ নেই। একটা খবর পর্যন্ত দিল না মেয়েটা। ড্রাইভারের খবরও পাচ্ছি না।
হলো কী?
ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। নানা রকম বিদঘুটে ভাবনায় অস্থির হয়ে পড়লাম। রাকু বস্তিতে থাকে, আশেপাশে কারও বাসায় ফোন নেই। থাকলেও আমার জানা নেই। আবেদনপত্রে যে নম্বরটা দিয়েছে সেটি ঢাকার; বুড়ির বাসার নম্বর।
পরদিন দুপুরে হঠাৎ ঢাকা থেকে ফোন এলো।
রিসিভার তুলে বুঝলাম রাকু, স্যার? আমার …।
তাকে কিছু বলার সুযোগ না-দিয়ে বললাম, এই মেয়ে, কাল আসার কথা ছিল, এলে না। একটা ফোন করলেও তো পারতে, না কি?
: স্যার …
: রাখো তোমার স্যার, তোমার কাছ থেকে এমন দায়িত্বহীন আচরণ আশা করিনি। আমি কী তাহলে ভুল করছি তোমাকে নিয়ে?
: স্যার, আমার বাবা মারা গেছেন।
বুকটা ব্যথায় ভরে উঠল। অযথাই গালি দিয়েছি মেয়েটাকে। কাউকে শাস্তি দেওয়ার আগে তার কথা শোনা উচিত। আমি মাঝে মাঝে কেন যে এমন করিÑ অনেকবার নিজেকে দমন করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু রাগের গতি এত প্রবল থাকে যে, নিজের মর্জি মতো থামানো যায় না। অঘটন ঘটিয়েই থামে। ধম্মপাদে পড়েছিলাম, “ধাবমান রথের গতিবেগ সংবরণের ন্যায় যিনি উৎপন্ন ক্রোধ দমন করিতে সমর্থ, তাঁহাকেই প্রকৃত সারথি বলে, অপর ব্যক্তিরা বল্গাধারী মাত্র।” আমি বল্গাধারী, নইলে ক্রোধ দমন করতে পারি না কেন?
: সরি, মেয়ে, আই এম অ্যাক্সিট্রিমলি সরি।
রাকু বলল, আমি কিছু মনে করিনি, স্যার।

: তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে না? সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললাম।
রাকু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, বাবার বেঁচে থাকাটাই ছিল কষ্টের। মৃত্যু তাকে শান্তি দিয়েছে। তিনি জীবনের কষ্ট থেকে মৃত্যুর শান্তিময় প্রান্তরে স্থানান্তর হয়েছেন। অনেক ভালো লোক ছিলেন। মরার পর আর চিৎকার করেননি। বলেননি—মাগো পারছি না সহ্য করতে, কী ব্যথা! একটু বিষ ঢেলে দাও মুখে, মরে যাই খেয়ে। রাতে আর চিৎকার দিয়ে বলবে না— মা গো, পাতিলে কি কিছুই নেই? আমার যে খুব ক্ষিধে পেয়েছে!
আমি বললাম, তারপরও বাবা, তবুও মৃত্যু।
রাকু বলল, স্যার, আমি জীবন-মরণ কোনোটাকে আর তেমন ভিন্ন চোখে দেখি না:
জীবন যাহারে বলে মরণ তাহারি নাম
মরণ তো নহে তোর পর
আয়, তারে আলিঙ্গন কর
আয়, তার হাতখানি ধর।
: এ বয়সে তোমার এমন মনোবল মুগ্ধকর। পিতামাতা হারিয়ে অসহায় তিন ভাইবোনের এত জল দেখেও ভেসে যাওনি, আমার গর্ব হচ্ছে।
: স্যার, বাবা আমাকে এ শক্তি দিয়ে গেছেন, রবীন্দ্রনাথে তা বিকশিত হয়েছে, আপনি তাকে দিলেন অবয়ব।
: তাড়াতাড়ি চলে এসো।
: কিছুক্ষণের মধ্যে রওয়ানা দিচ্ছি স্যার।
: তোমার বাবার ডেথ সার্টিফিকেট নিয়েছ? চেক পরিবর্তন করার জন্য লাগবে।
: নিয়েছি। এজন্য দেরি হয়ে গেল।
: তোমার ভাইবোন কেমন আছে?
: তারা ভেঙে পড়েছিল। একটা গল্প শুনিয়ে তাদের কষ্ট তাড়িয়ে দিয়েছি।
: কী গল্প?
: মৃত্যু আর জীবনের মধ্যে একদিন আলাপ হচ্ছিল। জীবন মৃত্যুকে বলল, “লোকে আমাকে ভালোবাসে কিন্তু তোমাকে এত ঘৃণা করে কেন? জবাবে মৃত্যু বলল, “কারণ তুমি আকর্ষণীয় মিথ্যুক, কিন্তু আমি নিষ্ঠুর সত্য; তুমি মরীচিকা আমি সূর্যশিখা, তোমার আনন্দ বর্তমান আর আমার আনন্দ অনন্তকাল।”
আমি বললাম, সুন্দর!

: স্যার, জীবন-মৃত্যু সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
: I’m gonna live till I die.
রাকু বলল, মৃত্য জীবনের অনিবার্য পরিণতি, তবু স্যার মানুষের কত দম্ভ।
আমি বললাম, মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান। তোমার বাবার শেষকৃত্যে কত টাকা খরচ হয়েছে? কোথায় পেয়েছ টাকা?
: বাবার শেষকৃত্য সম্পাদন করে পৌরসভা করেছে। স্যার, আমি একটা ভুল করে ফেলেছি?
: কী?
: গাড়ি ভাড়ার টাকা দিয়ে জন বুনাইনের ‘পিলগ্রিমস প্রগ্রেস’ বইটা কিনেছি। বাকি টাকা দিয়ে ছোটো ভাই-বোনদের কিছু চাল-ডাল কিনে দিয়েছি।
রাকুর কথা আমাকে বিস্ময়ে লা-জবাব করে দিল। ঘোর কাটার পর প্রশংসার গলায় বললাম, তোমার বয়সে আমি যদি এত বড়ো ভুল করতে পারতাম, তা কত শুদ্ধই না হতো!