ড. মোহাম্মদ আমীন
খান স্যার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। আমাকে দেখে আলোচনা বন্ধ করে শিশুর উল্লাসে ফেটে পড়লেন। তাঁর চোখ আমার পেছনে, কাউকে যেন খুঁজছেন। সবাই স্যারের কাণ্ড অবিশ্বাসের চোখে দেখছিলেন। আমিও অবাক। আমার প্রতি তাঁর এমন উচ্ছ্বসিত ভালোবাসার শিশুসুলভ প্রকাশ সত্যি অবিশ্বাস্য।
চেয়ার হতে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কেমন আছ তুমি?
ভালো, আপনি কেমন আছেন, স্যার?
রচনা কোথায়?
ইউনিভার্সিটিতে।
খান স্যারের মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। তবু স্বাভাবিকভাবে অন্য অফিসারদের দিকে তাকিয়ে পূর্বাপর কথায় আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, একটা ছেলের কথা বলতাম না, অসম্ভব সাহসী আর দুর্দান্ত পরোপকারী, এই সেই ছেলে, বুঝলে? তোমাদের কারও যদি সাহস লাগে তার কাছে যেতে পার।
অনেকদিন পর আপনাকে দেখলাম, স্যার।
না এলে দেখবে কীভাবে? একদিন এমন দিন আসবে, আর কখনো দেখা হবে না। সময় দেখার মানুষকেও অদৃশ্য করে দেয়। এখন যাও।
অপেক্ষা করি?
না। আমি খুব ব্যস্ত আছি। অনেক কাজ। রচনা ছাড়া কোনো অপেক্ষা নেই। আগামী সোমবার তাকে নিয়ে সকাল সকাল চলে এসো। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কিছু জরুরি কথাও আছে।
এতক্ষণে বুঝতে পারলাম স্যারের ব্যস্ততার কারণ। রচনা এলে ব্যস্ততা রচনাতে এসে জমা হতো। খান স্যার আসলেই রচনাকে ভালোবাসেন। আমি একা তার জন্য কিছুই করতে পারতাম না।
খান স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাজারে গেলাম। কিছু বাজার করে সোজা বাসায়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে ততক্ষণে। বাসার বাসিন্দারা ড্রয়িং রুমে বিছানো কার্পেটে গোল হয়ে বসে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করছে-
“বলল রাজা, বাতাস তুমি বস্তিতে যাও কেন?
বলল বাতাস, ওহে রাজা, বস্তি তুমি চেন?
বলল রাজা, বস্তি দিয়ে করব আমি কী?
আমি তো শুই রাজ প্রাসাদে-
খাই-
কী?
মন্ডা-মিঠাই ঘি।”
আমাকে দেখে আবৃত্তির ইতি ঘটল। ড্রাইভারের বাজার রেখে চলে গেল। এরপর আমার পোশাক পাল্টানোর রেওয়াজি সহায়তা। তা যথারীতি শেষ করে ওয়াশ রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে নাশতা রেডি করতে চলে গেল।
নাশতা শেষ হওয়ার পর খান স্যারের দাওয়াতের কথা বললাম। রচনা মহাখুশি। তৃপ্তির মায়া ছড়িয়ে আমার কপালে কয়েকটা চুমো সাজিয়ে মেঘের চেয়েও এলোমেলো হয়ে তার রুমে চলে গেল। মনে হলো, রচনা আগের চেয়ে ছোটো হয়ে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর পান নিয়ে হাজির। তার চুলে চিরুনির নতুন টান। খুশি হলে সে আমাকে পান উপহার দেয়। ইদানীং আমি পান পেলে খুশি হই।
পান দেখে হাত এগিয়ে দিলাম, দাও।
না, হা করেন।
হা করলাম। রচনা মুখে পান দিল। আমি আরাম করে পান থেকে রস খসাতে খসাতে বললাম, মইশ হাইল্যা মিডা পান, ইহজ্জা ধরি দিয়ে টান।
রচনা এখন চাইনিজ-স্প্যানিশের মতো চাটগাঁইয়া ভাষাও বুঝতে পারে। আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য শিখে নিয়েছে। কিছু কিছু বলতেও পারে। কিন্তু ‘হইজ্জা’ এত জটিল যে, অর্থ বুঝতে পারল না।
হইজ্জা মানে কী, স্যার?
কলিজা।
সবুজের উপর ধূসর রোদ-ঢাকা উষ্ণতার মতো একটা কাব্যিক হাসি দিয়ে শেফালী ঘোষের মতো চাটগাঁইয়া গলায় গাইল—
“যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম
যদি নতুন একখান মুখ পাইতাম,
মইশহাইল্যা পানের খিলি তারে
বানাই হাবাইতাম … ।”
আমি হাততালি দিয়ে বললাম, দারুণ গাইলে তো, একদম শেফালী ঘোষ।
স্যার, দিনের মধ্যে আমার কথা আপনার কয়বার মনে পড়ে?
দুইবার।
রচনা মুখটা মলিন করে বলল, শুধু দুইবার!
হ্যাঁ, দুইবার।
কখন কখন?
যখন একা থাকি তখন আর যখন কেউ আমার সঙ্গে থাকে তখন। অন্য কোনো সময় তোমার কথা আমার মনে পড়ে না।
আমার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রচনা খুশিতে জড়িয়ে ধরে বলল, আল্পনার মা বলতেন আমি না কি স্যার দয়ার সাগর। সাগরে কেউ ঠাঁই পায় না, বড়োজোর বালুচরে বালির উপর বসে ঢেউয়ের উদ্দামতা দেখতে পারে।
আল্পনার মা মানে?
না, মুখে এসে গেল; আমার মা—। মুখ ফসকে কথাটা চলে আসায় চেহারাটা মলিন হয়ে গেল।
আল্পনার মা আর তোমার মা একজন নয়?
আমরা ভাইবোন তিন মায়ের, আল্পনা বলল।
কী!
রচনা বলল, আমার বয়স যখন সাত, তখন আমার মা হঠাৎ মারা গেলেন। মা ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। ওই সময় বাবা ইংরেজি প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ করেছেন। লাইব্রেরিতে দুজনের পরিচয় তারপর প্রেম; অতঃপর বিয়ে।
গল্পের মতোই মনে হচ্ছে?
তাদের বিয়ে দুই পরিবারের কেউ মেনে নিতে পারেনি। মাস্তান লেলিয়ে দিয়েছিল। দুজনেই তাদের পরিবার থেকে বহিষ্কৃত হয়ে জীবন রক্ষার তাগিদে লেখাপড়ার ইতি টেনে গোপনে ঢাকা চলে এলেন। সে এক অন্য ইতিহাস।
তারপর কী হলো?
ঢাকায় এসে বাবা-মা একটা বেসরকারি অফিসে চাকরি নিলেন। ইন্টার পাশ, কী আর ভালো চাকরি পাবে! তবে যে চাকরি করছিল তাতে আয় তেমন খারাপ ছিল না। দুজনেই ছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মী এবং অতিরিক্ত বেহিসাবি। আয় করতেন যত খরচ করতেন তার বেশি। তাই কোনো সঞ্চয় ছিল না। একদিন হঠাৎ মা মারা গেলেন। আমার বয়স তখন তিন। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা উদভ্রান্ত হয়ে পড়লেন। চাকরি-বাকরি ছেড়ে দিয়ে সারাদিন বাসায় পড়ে থাকতেন আর আমার মায়ের নাম ধরে কাঁদতেন। টাকার অভাবে পাকা বাসা হতে বস্তিতে নেমে আসতে হলো। কর্জ শোধ করতে গিয়ে বাড়ির সব জিনিসপত্র বিক্রি করে দিলেন। কয়েক মাসের মধ্যে বাবা প্রায় অর্ধ পাগল। এ অবস্থায় বিয়ে করেন আল্পনা-কল্পনার মাকে। আমি তাকে মা ডাকতাম। বাঁচার জন্য বাবা জুটমিলে বদলি শ্রমিকের কাজ শুরু করলেন। প্রতিদিন কাজ পেতেন না, কাজ পেতে হলে সর্দারকে বকশিশ দিতে হতো। সেই সামর্থ্য তার ছিল না।
তারপর?
এর মধ্যে আল্পনা আসে, তারপর কল্পনা। কল্পনা সাত কি নয় মাস বয়সে তার মাকে হারায়।
কী হয়েছিল?
জাকাতের কাপড় আনতে গিয়ে পদদলিত হয়ে মারা গিয়েছেন। জাকাতপ্রার্থী গরিবগুলোর পায়ের চাপে আমার গরিব মায়ের শরীর থ্যাতলে গিয়েছিল। উনি মারা যাবার পর আল্পনা-কল্পনার ভার এসে পড়ে আমার ওপর। আমার বয়স তখন সাত কি আট।
টুটুলের মা?
আল্পনা-কল্পনার মা মারা যাবার চার মাস পর বাবা টুটুলের মাকে বিয়ে করেন।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি আমাকে মহৎ বলো, আমি তো তোমার কাছে কিছুই না! একদিনের জন্যও বুঝতে পারিনি এবং বুঝতে দাওনি ওরা তোমার আপন ভাইবোন নয়। অনেক কষ্টের মাঝে মানুষ হয়েছে এবং তোমার স্নেহে।
স্যার, ওই কষ্টই আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। সহজ জীবন মূল্যবান সময়ের একপ্রকার অপচয়। সময় জমা রাখা যায় না, কিন্তু স্যার, সদ্ব্যবহার করা যায়। সময়ের সদ্ব্যবহার মানে সময়কে জমা করে রাখা। সময়কে সদ্্ব্যবহার করতে হলে জীবনে কষ্ট থাকা আবশ্যক।
মেয়ে, তোমার প্রতি আমার শ্রদ্ধা।
স্যার, শ্রদ্ধায় ভালোবাসার মতো নৈকট্য নেই। আমি আপনার শ্রদ্ধা চাই না, ভালোবাসা চাই।
আমি বললাম, Respect is what we owe; love, what we give. শ্রদ্ধা পাওয়ার আর ভালোবাসা দেওয়ার। দুটো একসঙ্গে থাকলে ভালোবাসা প্রতিদিন নতুন সূর্যের মতো নতুনভাবে উদিত হয়। জাম্পত্য জীবনে কত ভালোবাসা, তবু এত দুর্বিষহ অবস্থা কেন জানো? পরস্পরের শ্রদ্ধাবোধের অভাব। স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার গলাজলে হাঁটুশ্রদ্ধা থাকে না। তাই গলাপরিমাণ ভালোবাসা গলাগলির পরিবর্তে গালাগালি হয়ে গলা টিপে ধরে।
স্যার, আপনি কি কাউকে ভালোবাসেন? আমি একজনকে ভালোবাসি।
সে কে? আমি প্রশ্ন করলাম।
আপনি। আপনি আমাকে দেন, আমি নিই, বলেই লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিল রচনা।
মেয়ে, তুমি ছাড়া আর কে আছে আমার, দেওয়ার বা নেওয়ার?
হুমায়ুন আজাদ স্যার কী বলেছিলেন মনে নেই, স্যার?
কী বলেছিলেন?
ভালোবাসা অনেক মূল্যবান জিনিস। এটাকে প্রয়োজনে জোর করে আদায় করে নিতে হয়।
আমি বললাম, জীবনে পাওয়ার শেষ নেই, শেষ নেই চাওয়ার আর অভাবের। চাওয়া-পাওয়ার মাঝে দেওয়ার যে অধীরতা সেটাই ভালোবাসা, সেটাই সংসারের প্রাণ, জীবনের অর্থ। এখানেই আনন্দদল সমূদ্রের ফেনারাশি হতে সৃষ্ট বুদ্বুদের মতো সূর্য থেকে আলো নিয়ে আনন্দবলয় হয়ে ওঠে। তোমার আনন্দ কী?
আপনি, আপনার পথ চেয়ে অপেক্ষা—
“আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ।
খেলে যায় রৌদ্র-ছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত।
আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ।”
গান শেষ করে রচনা বলল, স্যার চুপ করে আছেন যে?
আমি হাসলাম।
স্যার, হাসলেন যে?
নীরবতা সব প্রশ্নের সর্বোত্তম উত্তর আর হাসি সব অবস্থানের অত্যুত্তম প্রতিক্রিয়া।
“আসলেই স্যার”, রচনা বলল, “অর্থহীন কথা মানুষকে অর্থহীন করে দেয়। তবে কখনো কখনো অর্থহীন কথা নির্জীবতাকেও করে দেয় সজীব, প্রাণবন্ত। তাই আমি কথা বলব—অর্থহীন হোক আবা অর্থময় হোক, তবে সে শুধু আপনার সঙ্গে। বেশি বললে রাগ করবেন না তো?”
এদিকে এসো, একটু আদর করি।
রচনা এগিয়ে আসার আগে কল্পনা এগিয়ে এল, আগে আমাকে।
চেয়ার হতে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কেমন আছ তুমি?
ভালো, আপনি কেমন আছেন, স্যার?
রচনা কোথায়?
ইউনিভার্সিটিতে।
খান স্যারের মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। তবু স্বাভাবিকভাবে অন্য অফিসারদের দিকে তাকিয়ে পূর্বাপর কথায় আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, একটা ছেলের কথা বলতাম না, অসম্ভব সাহসী আর দুর্দান্ত পরোপকারী, এই সেই ছেলে, বুঝলে? তোমাদের কারও যদি সাহস লাগে তার কাছে যেতে পার।
অনেকদিন পর আপনাকে দেখলাম, স্যার।
না এলে দেখবে কীভাবে? একদিন এমন দিন আসবে, আর কখনো দেখা হবে না। সময় দেখার মানুষকেও অদৃশ্য করে দেয়। এখন যাও।
অপেক্ষা করি?
না। আমি খুব ব্যস্ত আছি। অনেক কাজ। রচনা ছাড়া কোনো অপেক্ষা নেই। আগামী সোমবার তাকে নিয়ে সকাল সকাল চলে এসো। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কিছু জরুরি কথাও আছে।
এতক্ষণে বুঝতে পারলাম স্যারের ব্যস্ততার কারণ। রচনা এলে ব্যস্ততা রচনাতে এসে জমা হতো। খান স্যার আসলেই রচনাকে ভালোবাসেন। আমি একা তার জন্য কিছুই করতে পারতাম না।
খান স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাজারে গেলাম। কিছু বাজার করে সোজা বাসায়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে ততক্ষণে। বাসার বাসিন্দারা ড্রয়িং রুমে বিছানো কার্পেটে গোল হয়ে বসে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করছে-
“বলল রাজা, বাতাস তুমি বস্তিতে যাও কেন?
বলল বাতাস, ওহে রাজা, বস্তি তুমি চেন?
বলল রাজা, বস্তি দিয়ে করব আমি কী?
আমি তো শুই রাজ প্রাসাদে-
খাই-
কী?
মন্ডা-মিঠাই ঘি।”
আমাকে দেখে আবৃত্তির ইতি ঘটল। ড্রাইভারের বাজার রেখে চলে গেল। এরপর আমার পোশাক পাল্টানোর রেওয়াজি সহায়তা। তা যথারীতি শেষ করে ওয়াশ রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে নাশতা রেডি করতে চলে গেল।
নাশতা শেষ হওয়ার পর খান স্যারের দাওয়াতের কথা বললাম। রচনা মহাখুশি। তৃপ্তির মায়া ছড়িয়ে আমার কপালে কয়েকটা চুমো সাজিয়ে মেঘের চেয়েও এলোমেলো হয়ে তার রুমে চলে গেল। মনে হলো, রচনা আগের চেয়ে ছোটো হয়ে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর পান নিয়ে হাজির। তার চুলে চিরুনির নতুন টান। খুশি হলে সে আমাকে পান উপহার দেয়। ইদানীং আমি পান পেলে খুশি হই।
পান দেখে হাত এগিয়ে দিলাম, দাও।
না, হা করেন।
হা করলাম। রচনা মুখে পান দিল। আমি আরাম করে পান থেকে রস খসাতে খসাতে বললাম, মইশ হাইল্যা মিডা পান, ইহজ্জা ধরি দিয়ে টান।
রচনা এখন চাইনিজ-স্প্যানিশের মতো চাটগাঁইয়া ভাষাও বুঝতে পারে। আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য শিখে নিয়েছে। কিছু কিছু বলতেও পারে। কিন্তু ‘হইজ্জা’ এত জটিল যে, অর্থ বুঝতে পারল না।
হইজ্জা মানে কী, স্যার?
কলিজা।
সবুজের উপর ধূসর রোদ-ঢাকা উষ্ণতার মতো একটা কাব্যিক হাসি দিয়ে শেফালী ঘোষের মতো চাটগাঁইয়া গলায় গাইল—
“যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম
যদি নতুন একখান মুখ পাইতাম,
মইশহাইল্যা পানের খিলি তারে
বানাই হাবাইতাম … ।”
আমি হাততালি দিয়ে বললাম, দারুণ গাইলে তো, একদম শেফালী ঘোষ।
স্যার, দিনের মধ্যে আমার কথা আপনার কয়বার মনে পড়ে?
দুইবার।
রচনা মুখটা মলিন করে বলল, শুধু দুইবার!
হ্যাঁ, দুইবার।
কখন কখন?
যখন একা থাকি তখন আর যখন কেউ আমার সঙ্গে থাকে তখন। অন্য কোনো সময় তোমার কথা আমার মনে পড়ে না।
আমার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রচনা খুশিতে জড়িয়ে ধরে বলল, আল্পনার মা বলতেন আমি না কি স্যার দয়ার সাগর। সাগরে কেউ ঠাঁই পায় না, বড়োজোর বালুচরে বালির উপর বসে ঢেউয়ের উদ্দামতা দেখতে পারে।
আল্পনার মা মানে?
না, মুখে এসে গেল; আমার মা—। মুখ ফসকে কথাটা চলে আসায় চেহারাটা মলিন হয়ে গেল।
আল্পনার মা আর তোমার মা একজন নয়?
আমরা ভাইবোন তিন মায়ের, আল্পনা বলল।
কী!
রচনা বলল, আমার বয়স যখন সাত, তখন আমার মা হঠাৎ মারা গেলেন। মা ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। ওই সময় বাবা ইংরেজি প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ করেছেন। লাইব্রেরিতে দুজনের পরিচয় তারপর প্রেম; অতঃপর বিয়ে।
গল্পের মতোই মনে হচ্ছে?
তাদের বিয়ে দুই পরিবারের কেউ মেনে নিতে পারেনি। মাস্তান লেলিয়ে দিয়েছিল। দুজনেই তাদের পরিবার থেকে বহিষ্কৃত হয়ে জীবন রক্ষার তাগিদে লেখাপড়ার ইতি টেনে গোপনে ঢাকা চলে এলেন। সে এক অন্য ইতিহাস।
তারপর কী হলো?
ঢাকায় এসে বাবা-মা একটা বেসরকারি অফিসে চাকরি নিলেন। ইন্টার পাশ, কী আর ভালো চাকরি পাবে! তবে যে চাকরি করছিল তাতে আয় তেমন খারাপ ছিল না। দুজনেই ছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মী এবং অতিরিক্ত বেহিসাবি। আয় করতেন যত খরচ করতেন তার বেশি। তাই কোনো সঞ্চয় ছিল না। একদিন হঠাৎ মা মারা গেলেন। আমার বয়স তখন তিন। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা উদভ্রান্ত হয়ে পড়লেন। চাকরি-বাকরি ছেড়ে দিয়ে সারাদিন বাসায় পড়ে থাকতেন আর আমার মায়ের নাম ধরে কাঁদতেন। টাকার অভাবে পাকা বাসা হতে বস্তিতে নেমে আসতে হলো। কর্জ শোধ করতে গিয়ে বাড়ির সব জিনিসপত্র বিক্রি করে দিলেন। কয়েক মাসের মধ্যে বাবা প্রায় অর্ধ পাগল। এ অবস্থায় বিয়ে করেন আল্পনা-কল্পনার মাকে। আমি তাকে মা ডাকতাম। বাঁচার জন্য বাবা জুটমিলে বদলি শ্রমিকের কাজ শুরু করলেন। প্রতিদিন কাজ পেতেন না, কাজ পেতে হলে সর্দারকে বকশিশ দিতে হতো। সেই সামর্থ্য তার ছিল না।
তারপর?
এর মধ্যে আল্পনা আসে, তারপর কল্পনা। কল্পনা সাত কি নয় মাস বয়সে তার মাকে হারায়।
কী হয়েছিল?
জাকাতের কাপড় আনতে গিয়ে পদদলিত হয়ে মারা গিয়েছেন। জাকাতপ্রার্থী গরিবগুলোর পায়ের চাপে আমার গরিব মায়ের শরীর থ্যাতলে গিয়েছিল। উনি মারা যাবার পর আল্পনা-কল্পনার ভার এসে পড়ে আমার ওপর। আমার বয়স তখন সাত কি আট।
টুটুলের মা?
আল্পনা-কল্পনার মা মারা যাবার চার মাস পর বাবা টুটুলের মাকে বিয়ে করেন।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি আমাকে মহৎ বলো, আমি তো তোমার কাছে কিছুই না! একদিনের জন্যও বুঝতে পারিনি এবং বুঝতে দাওনি ওরা তোমার আপন ভাইবোন নয়। অনেক কষ্টের মাঝে মানুষ হয়েছে এবং তোমার স্নেহে।
স্যার, ওই কষ্টই আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। সহজ জীবন মূল্যবান সময়ের একপ্রকার অপচয়। সময় জমা রাখা যায় না, কিন্তু স্যার, সদ্ব্যবহার করা যায়। সময়ের সদ্ব্যবহার মানে সময়কে জমা করে রাখা। সময়কে সদ্্ব্যবহার করতে হলে জীবনে কষ্ট থাকা আবশ্যক।
মেয়ে, তোমার প্রতি আমার শ্রদ্ধা।
স্যার, শ্রদ্ধায় ভালোবাসার মতো নৈকট্য নেই। আমি আপনার শ্রদ্ধা চাই না, ভালোবাসা চাই।
আমি বললাম, Respect is what we owe; love, what we give. শ্রদ্ধা পাওয়ার আর ভালোবাসা দেওয়ার। দুটো একসঙ্গে থাকলে ভালোবাসা প্রতিদিন নতুন সূর্যের মতো নতুনভাবে উদিত হয়। জাম্পত্য জীবনে কত ভালোবাসা, তবু এত দুর্বিষহ অবস্থা কেন জানো? পরস্পরের শ্রদ্ধাবোধের অভাব। স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার গলাজলে হাঁটুশ্রদ্ধা থাকে না। তাই গলাপরিমাণ ভালোবাসা গলাগলির পরিবর্তে গালাগালি হয়ে গলা টিপে ধরে।
স্যার, আপনি কি কাউকে ভালোবাসেন? আমি একজনকে ভালোবাসি।
সে কে? আমি প্রশ্ন করলাম।
আপনি। আপনি আমাকে দেন, আমি নিই, বলেই লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিল রচনা।
মেয়ে, তুমি ছাড়া আর কে আছে আমার, দেওয়ার বা নেওয়ার?
হুমায়ুন আজাদ স্যার কী বলেছিলেন মনে নেই, স্যার?
কী বলেছিলেন?
ভালোবাসা অনেক মূল্যবান জিনিস। এটাকে প্রয়োজনে জোর করে আদায় করে নিতে হয়।
আমি বললাম, জীবনে পাওয়ার শেষ নেই, শেষ নেই চাওয়ার আর অভাবের। চাওয়া-পাওয়ার মাঝে দেওয়ার যে অধীরতা সেটাই ভালোবাসা, সেটাই সংসারের প্রাণ, জীবনের অর্থ। এখানেই আনন্দদল সমূদ্রের ফেনারাশি হতে সৃষ্ট বুদ্বুদের মতো সূর্য থেকে আলো নিয়ে আনন্দবলয় হয়ে ওঠে। তোমার আনন্দ কী?
আপনি, আপনার পথ চেয়ে অপেক্ষা—
“আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ।
খেলে যায় রৌদ্র-ছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত।
আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ।”
গান শেষ করে রচনা বলল, স্যার চুপ করে আছেন যে?
আমি হাসলাম।
স্যার, হাসলেন যে?
নীরবতা সব প্রশ্নের সর্বোত্তম উত্তর আর হাসি সব অবস্থানের অত্যুত্তম প্রতিক্রিয়া।
“আসলেই স্যার”, রচনা বলল, “অর্থহীন কথা মানুষকে অর্থহীন করে দেয়। তবে কখনো কখনো অর্থহীন কথা নির্জীবতাকেও করে দেয় সজীব, প্রাণবন্ত। তাই আমি কথা বলব—অর্থহীন হোক আবা অর্থময় হোক, তবে সে শুধু আপনার সঙ্গে। বেশি বললে রাগ করবেন না তো?”
এদিকে এসো, একটু আদর করি।
রচনা এগিয়ে আসার আগে কল্পনা এগিয়ে এল, আগে আমাকে।
কেন?
আদরে ছোটোদের অগ্রাধিকার।
তাহলে বড়োদের?
শ্রদ্ধা।
—————————————————————————–
শুবাচ গ্রুপের লিংক: www.draminbd.com
তিনে দুয়ে দশ: শেষ পর্ব ও সমগ্র শুবাচ লিংক
Total Page Visits: 400 - Today Page Visits: 2