স্যমন্তক: দ্বাবিংশ ও ত্রয়োবিংশ পর্ব
রাকু হাতপাখা নেড়ে আমাকে বাতাস করছে। বিদ্যুৎ আসবে আরও চল্লিশ মিনিট পর। অফিস থেকে ফোন করে জানিয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী। জেনারেটর মেরামতের কাজ চলছে সামনে। রাকুর হাতপাখার দোল বৈদিক ভরতনাট্যমের মতো ছন্দময়; তবে বড়ো গাণিতিক, কারওয়ান বাজারের মজুদদার ব্যবসায়ীর মতো চুলচেরা হিসেবি। আমি তাকালাম রাকুর দোলায়মান হাতপাখাটির দিকে:
“ছন্দে ছন্দে দোলে আমার হাতপাখাটি কনের,
বাতাস ভেঙে মিষ্টি পরশ খবর রাখে মনের।
মেয়ে আমার কষ্ট মনে জড়িয়ে ধরে বলে—
সত্যি সত্যি রোববারে কি যেতে হবে চলে?”
রোববার ভোরে চট্টগ্রামের উদ্দেশে বিমান বন্দর যাবার সময় রাকু বারবার একটি প্রশ্ন করত, সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছেন? আজ না গেলে হয় না, স্যার? সোমবার তো আছেই।
কারও কারও হাত-পাখার বাতাস বেশ আদর নিয়ে গায়ে লাগে। সাকি, স্বাদ পরিবর্তন করে দিতে পারে। মায়ের হাতের পান্তা ভাত, আর কোথা পাই এমন স্বাদ! রাকুর ডান হাতে পাখা; বাম হাতের আঙুল দিয়ে মাথার চুলে বেণি টানছে বিধুনিত বিনয়ে, আমি স্যার এ বছরও ভর্তি হতে পারব বলে মনে হয় না।
কেন?
এসএসসি সনদে আমার নাম রাখসনা, কিন্তু এইচএসসি সনদে রাকখসনা। এক জনের সনদ দুই নামের হয় কীভাবে?
তাতে কী?
ভর্তিতে সমস্যা হবে। আবেদনই করা যাবে না। গতবার এজন্য ভর্তি হতে পারিনি। নাম পরিবর্তন করা অনেক কঠিন কাজ, অনেক খরচ হয়, অনেক সময় লাগে। অনেক কিছু লাগে, ঘুস দিতে হয়। দুবেলা খাওয়া যেখানে জোটে না সেখানে আবার পড়ার মতো বিলাসিতা। তারপর লেখাপড়া বাদ দিয়ে চাকুরির দিকে ঝুঁকে পড়ি।
“সমস্যা আসে সমাধানের খোঁজে”, আমি বললাম, “তাই সমস্যা এলে আমরা সমাধান খুঁজি। সব সমস্যার সমাধান আছে। সমস্যা হচ্ছে সমাধানের সন্তান। চিন্তা করো না।”
“সময় স্যার বেশি নেই”, রাকু বলল, “এবার ভর্তি হতে না-পারলে আরও একটা বছর নষ্ট হয়ে যাবে। যত সমস্যা সব অসহায়দের ওপর দিয়ে যায়। দুর্বল শরীরে বীজাণুর আক্রমণ প্রবল হয়।”
নিরুদ্বেগ গলায় বললাম, একটা নামও থাকবে না, নতুন নাম হবে তোমার।
রাকু আগ্রহসহকারে বললেন, কী নাম রাখবেন, স্যার?
একগাদা নাম বলল আল্পনা-কল্পনা।
সুন্দর একটা নাম বলো, রাকুকে বললাম।
আপনি বলুন।
নিজের নাম নিজে রাখতে পারা জাতিস্মরের মতো রোমাঞ্চকর বিষয় হবে। তোমার কোনো পছন্দ আছে?
না, স্যার।
বলো একটা নাম— শুনি।
আমাকে সমর্থন দিল আল্পনা-কল্পনা, রীতিমতো তালি দিয়ে।
রাকু একটু চিন্তা করে বলল, স্যার, আপনি আমাকে আপনার মনের মতো করে রচনা করছেন, গড়ে তুলছেন। তাই না?
তাই তো মনে হয়।
আপনাকেই নাম দিতে হবে। রচনার নাম রচিয়তাই দেয়। আপনার লেখা সবগুলো বইয়ের নাম তো আপনিই দিয়েছেন, ঠিক না?
আমি সোল্লাসে বললাম, নাম পেয়ে গেছি।
কী?
রচনা।
রচনাও সোল্লাসে বলল, দারুণ নাম। আমারও বেশ পছন্দ হয়ে গেছে। আগের নামের সঙ্গেও কিছুটা মিল আছে। কী অর্থবহ, কী দারুণ শুনতে। সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন করে দিল, আল্পনা ও কল্পনা, এখন তারা আল্পু-কল্পু। পিচ্চি টুটুলও পছন্দ করে ফেলল— ভাইয়া, অনেক সুন্দর নাম। আমার নামটাও বদলিয়ে দিন, বস্তির লোকেরা আমাকে দেখলেই বলত— চেয়ার-টেবিল আন টুল তার নাম টুল টুল।
রাকু বলল, স্যার, নতুন নাম আমাকে একটা গান স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
আমি বললাম, আমাকেও একটা গান স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। চলো, দুজনে দুজনের গান-দুটো গাই একসঙ্গে।
শুরু করুন:
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা,
মম শূন্যগগনবিহারী,
আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে, তোমারে করেছি রচনা।
তুমি আমারি, তুমি আমারি
মম অসীমগগনবিহারী।।
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা
গান থামিয়ে বললাম, দুজনে একই গান, কী আশ্চর্য! এটাই কী তাহলে কাকতালীয়?
না স্যার।
তাহলে কী?
হৃদ-তালীয়।
এটা আবার কী?
মানুষের মন চাহে মানুষেরি মন, আপনি ভুলিয়া দিকে দিকে ছুটে মুগ্ধ সমীরণ।
তুমি কাকে মানুষ বলছ?
যার মনুষ্যত্ববোধ আছে, যার হাত থেকে পৃথিবীর সব জীব, সব বস্তু, সব মতবাদ, সব নারী, সব যুবতি, সব কিশোর, সব কিশোরী সব বাক্ নিরাপদ— তিনিই মানুষ। সেই মানুুষ স্যার, যে মানুষ মৃত্যুপরবর্তী ভোগ নিশ্চিত করার জন্য পৃথিবীকে দুর্বিষহ করে তুলে না। সেই মানুষ— যে বিবেচনা বোধ প্রয়োগে আত্ম আর পর সমান মমতায় মথিত হয়।
আমি জানি না কোনটা ভালোবাসা আর কোনটা হৃদয়; আর কোনটাই বা মানুষ। তবে মানুষ নিয়ে আমার ধারণা শুনলে তোমার ভালো নাও লাগতে পারে।
কেন, স্যার?
মানুষ কেবল দুঃখের হিসাবই রাখে, সুখের হিসাবগুলো রাখে না। বঞ্চনার খাতায় দাগ দেয়, প্রাপ্তির খাতায় কিছুই করে না। মানুষের চেয়ে নিষ্ঠুর প্রাণী আর অকৃতজ্ঞ দুর্যোগ হয় না। সব মানুষই এক একটা কসাই মইজ্জা, এক একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আমিও। চারদিকে কত জ্ঞানবিজ্ঞানের ছড়াছড়ি, তবু অসংখ্য মানুষ কল্পিত মতবাদে অন্ধ হয়ে পৃথিবীটাকে রক্তের সাগর বানিয়ে দিচ্ছে— তারা স্বর্গে যাবে। পৃথিবীতে যে সম্পদ আছে তা প্রত্যেক মানুষের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট। তারপরও লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিন না খেয়ে মরছে। বিনা-চিকিৎসায় অকালে প্রাণ হারাচ্ছে।
আমারও অমন ধারণা ছিল। কিন্তু – – –
কিন্তু কী?
আপনি সে ধারণা পালটে দিয়েছেন।
আমি কী করলাম?
আমি জেনেছি মানুষ কাকে বলে, আমি জেনেছি হৃদয় কাকে বলে। স্যার, আপনার ভালোবাসা না-পেলে আমরা এখন কোথায় থাকতাম?
যেখানে আছ সেখানেই থাকতে।
আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন।
আমি তোমার জন্য কিছুই করিনি। পরিবর্তক হিসেবে মানুষ মানুষের অনুঘটক মাত্র, অনিবার্য কিছু নয়। নইলে মানুষ গুহা থেকে নক্ষত্রে অধিষ্ঠিত হয় কীভাবে? কে তাকে সাহায্য করেছে?
তাহলে কে করেছে?
তোমার প্রতিভা, তোমার মেধা, তোমার বুদ্ধি। তোমার সঙ্গে আরও অনেক মেয়ে ছিল, সবাই তোমার চেয়ে সুদর্শন। আমি করলে তাদের জন্য করতাম। তোমার জন্য কখনো করতাম না।
আপনার ভূমিকা?
তোমার মেধা আর প্রতিভায় মুগ্ধ হওয়া ছাড়া আর কোনো ভূমিকা নেই।
কথোপকথনের মাঝে অরুণাভ সরকারকে টেলিফোন করলাম— রাকুর নাম পরিবর্তনের একটি বিজ্ঞপ্তি দিন পত্রিকায়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে অ্যাফিডেভিট পাঠিয়ে দিচ্ছি।
অফজল ভবনে একজন নোটারি পাবলিক আছেন। তাকে দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে অ্যাফিডেভিটের কাজটা করিয়ে নিলাম। তার ফটোকপি ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম অরুণাভ সরকারের কাছে।
পরদিনই পত্রিকা-বিজ্ঞপ্তি পেয়ে যাই। অরুণাভ সরকার নিজেই নিয়ে এসেছেন। রচনার জন্য তার সময় দিতে সময়ের কোনো অভাব হয় না।যুবতিদের এ একটা সুবিধা—সবাই এগিয়ে আসে।
পত্রিকা-বিজ্ঞপ্তি পাওয়ার পর রাকুর নাম পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু করে দিলাম। ভেবেছিলাম অরুণাভ সরকারকে দায়িত্বটা দিয়ে চট্টগ্রাম চলে যাব। তিনি বললেন, তার একার পক্ষে কাজটা এত তাড়াতাড়ি করা সম্ভব হবে না। কমপক্ষে পনের দিন লাগবে। এটি বেশ জটিল। আপনার থাকতে হবে।
দশ দিনের মধ্যে না পেলে ভর্তি হওয়া যাবে না। আমি থেকে গেলাম।পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রদান হতে শুরু করে অ্যাফিডেভিট করা, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অভিমত, বোর্ডে গিয়ে এসএসসি আর এইচএসসির সার্টিফিকেট সংশোধন— এলাহি কাণ্ড। আমার দেরি লাগল না। তদবির পড়লে কোনো কাজই আর জটিল থাকে না। পৃথিবীর সব দেশে একই নিয়ম। তদবিরের জোরে জটিল কাজটা দুদিনের মধ্যে সহজে হয়ে গেল।
রাকখসনা, এখন রচনা (পুরো নাম দেওয়া হলো না)।
পরের মাসে ভর্তি হয়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
২৩
বস্তির রাকখসনা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। বুড়ির বাসার কাজের বুয়া ব্রিটিশ কাউন্সিলের আজীবন সদস্য; কবীর চৌধুরীর অনুবাদ সহায়িকা। এটি তার প্রত্যাশার উত্তরণ, কিন্তু আমার কাছে সীমাহীন গর্বের অশেষ আনন্দ।
রচনা আমার রক্ত সম্পর্কের কেউ নয়; তবু তার উত্থান আমাকে কেন এত আনন্দ দিত বুঝতে পারতাম না।
এটাই কি তাহলে ভালোবাসা?
প্রথম দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় পায়ে ধরে সালাম করে জানতে চেয়েছিল রচনা, স্যার, বলুন তো— আমি কে?
কে? প্রশ্নের ভেতর প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলাম। সাক্ষাৎকারে নিজের পরিচয় যেভাবে দিয়েছিল, তাতে এছাড়া আমার আর কোনো উত্তরই নিরাপদ মনে হয়নি।
স্যার, বলুন-না আমি কে?
তুমি কে?
আমি রচনা। আগে অনেক কিছু ছিলাম। এখন কেবল রচনা, কেবলই রচনা। আমার স্যারের রচনা। রচয়িতার রচনা, যেমন রচিবেন তিনি তেমন হওয়াই আমার নিয়তি।
আমি কে? আমি জানতে চাইলাম।
মম হৃদয়রক্তরাগে তব চরণ দিয়েছি রাঙিয়া,
অয়ি সন্ধ্যাস্বপনবিহারী।
তব অধর এঁকেছি সুধাবিষে মিশে মম সুখদুখ ভাঙিয়া
তুমি আমারি, তুমি আমারি
মম বিজনজীবনবিহারী।।
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা।
“থাক, বাবা আর না”, “আমার প্রশংসা করা তোমার বদভ্যাস হয়ে গেছে।” আমার কথা থামাতে পারেনি তাকে। সে গেয়ে চলেছে বলার মতো গুরুত্বে—
মম মোহের স্বপন-অঞ্জন তব নয়নে দিয়েছি পরায়ে,
অয়ি মুগ্ধনয়নবিহারী।
মম সংগীত তব অঙ্গে অঙ্গে দিয়েছি জড়ায়ে জড়ায়ে,
তুমি আমারি, তুমি আমারি,
মম জীবনমরণবিহারী।।
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা।
রচনার গান শেষ হওয়া মাত্র করে দরজার গোড়া থেকে ভেসে আসে কল্পনার গলা: আপু বাংলার গান গায়, আমি বাংলায় গান গাই …।
রচনা আর আমি কল্পনার সুরে সুর মেলাই আল্পনা-সহ। সবাই একসঙ্গে গাইতে থাকি বড়ো বড়ো গলায়, আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই।
ইদানীং ও ইদানীং-এর বিপরীতার্থক শব্দ
There is noticeably a bundle to know about this. I assume you made certain nice points in features also.