ড. মোহাম্মদ আমীন
খান স্যারের অফিস থেকে বের হয়ে আসার কিছুক্ষণের মধ্যে বদলির আদেশ পেয়ে যাই। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের পিয়নই তা নিয়ে আসে। পুরো পড়ার আগে দেখে নিলাম বদলিকৃত স্থান।
ভেবেছিলাম আমাকে রাজশাহী বিভাগে বদলি করা হবে, যমুনার ওপারে কিংবা পার্বত্য এলাকায়, কিন্তু বদলির আদেশে নতুন কর্মস্থল দেখে আমি হতবাক। আমাকে দূরে বদলি করা হয়নি, আসলে করা যায়নি। যেখানে বদলি করা হয়েছে তা ঢাকা জেলায় না হলেও ঢাকাই বলা যায়।

বাসায় এসে রচনাকে ঢাকার বাইরে বদলি হওয়ার কথা বললাম। ঢাকার বাইরে— এটি শুনেই কান্না শুরু করে দিল সে; স্থান কোথায় কিংবা ঢাকা থেকে কত দূরে এসব কিছুই তার মনে এল না।
কান্নার কী হলো?
বলল, স্যার, ঢাকার বাইরে যাবেন না।
কেন? ঢাকার বাইরে মানুষ কি চাকরি করে না? ঢাকা ছাড়া বাকি অংশ কি বাংলাদেশ নয়?
আপনি চলে গেলে আমাদের দেখবে কে?
অসুবিধা হবে না। তোমারা এখন নিজেদের দেখাশুনা নিজেরাই করতে পারবে।
কিন্তু- – -।
কিন্তু আবার কী?
আপনি আমাদের ভুলে যাবেন।
যত দূরত্ব তত মমত্ব। যত দূর তত সুর। যত বেশি নিকট, তত বেশি সংকট। এজন্য স্বামীস্ত্রীর সম্পর্ক কেমন মারকুটে হয় দেখোনি?
রচনা বলল, দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরস্পরের অবয়ব ছোটো হতে থাকে। তারপর ছোটো হতে হতে একসময় মিলিয়ে যায়। চাঁদটা কত ছোটো দেখায়, দেখুন। কাছে থাকলে প্রতিদিন বেড়ানো যেত। কত বড়ো দেখাতো।
কিন্তু দূরে বলেই চাঁদকে এত সুন্দর দেখায়। কাছে থাকলে কি অত সুন্দর দেখাত? দেখতাম চাঁদের বিদঘুটে পাথর, ভয়ংকর গর্ত, আলোবাতাসহীন পাণ্ডুর প্রান্তরে প্রাণহীন পরিবেশ। বিরক্তে মুখ ফিরিয়ে নিতে।
বদলি বাতিল করে নিন, নিন না স্যার।
নরসিংদী মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথ। প্রতিসপ্তাহে আসব। যখন ইচ্ছে তখনই চলে আসতে পারব। কয় ঘণ্টার পথ!
খান স্যারকে বললে তো বদলি ক্যান্সেল হয়ে যায়। সৈয়দ আবুল হোসেনও আছেন। আপনার ভোটাতো মন্ত্রীকে বললেও তো হয়ে যায়।
তদ্বির করে বদলি সবচেয়ে বড়ো অসততা। প্রকৃত অর্থে কোনো সৎ অফিসার বদলির জন্য তদ্বির করে না। একটু দূরে থাকলে সম্পর্ক মধুর থাকে। স্বাদ বিস্বাদ না-হওয়ার জন্য কিছু অভাব প্রয়োজন। পরিমিত অভাব প্রত্যাশাকে আকুল আর প্রাপ্তিকে সতেজ রাখে।
টুটুল বলল, ভাইয়া, আমিও যাব আপনার সঙ্গে।
যাবে। আমরা দুজন ওখানে থাকব।
কল্পনা বলল, আমি যাব।
যবে।
পরদিনই যোগদান করে দিলাম নতুন কর্মস্থলে। ঢাকায় আসব শুনলে সবাই আনন্দে অধীর হয়ে উঠত।তাদের প্রতি ভালোবাসা আগের চেয়ে প্রবল, মধুর এবং স্নিগ্ধ হতে থাকে। মাঝে মাঝে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য খবর না-দিয়ে চলে আসতাম। আমার আগমনে রচনাদের আনন্দ-মনে লোভের বন্যা বইয়ে যেত। এত আদর, এত ভালোবাসা— আমি আস্তে আস্তে লোভী হয়ে উঠি।
মনে পড়ে যেত বাবার কথা, ছোটোবেলার কথা। আমরা থাকতাম গ্রামে। বাবা কর্মের কারণে চট্টগ্রাম শহরে থাকতেন। প্রতি শনিবার রাতে বাড়ি আসতেন এবং সোমবার ভোরে চলে যেতেন। শনিবার রাত যতই গভীর হোক বাবা না-আসা পর্যন্ত আমরা ভাই-বোনেরা ঘুমাতাম না। গাড়ির আওয়াজ শুনলে গুলির মতো বের হয়ে বাবাকে জাপ্টে ধরে শ্লোগান দিতাম:
বাবা আসেন কোন বার? রোববার, রোববার। আমার বার তোমার বার, রোব বার রোব বার।
সোমবার ছিল অন্য রকম। আজান দেওয়ার আগে ঘুম ভেঙে যেত। সবার মন খচখচ করত কষ্টে। মনে মনে বলতাম: সব বার, নয় কেন রোববার। আসে কেন দুষ্ট এই সোমবার?
আমি বাসায় ঢুকলে রচনাদের উল্লাস ছোটোবেলায় বাবার আগমনের কথা মনে করিয়ে দিত। আমি বাবা এবং রচনা, আল্পনা-কল্পনা ও টুটুল আমার সন্তান। নিনিও যুক্ত হয়েছে তাদের সঙ্গে। ভালোবাসার কী নিখুঁত মহিমা, প্রকৃতিকেও হারিয়ে দেয়। আজকের সন্তান আগামীকালের পিতা।
প্রতিবারের মতো সেদিনও এলাম আকস্মিক। কলিংবেল দিতেই বুঝে গেল আমি এসেছি। একসঙ্গে সবাই হুড়োহুড়ি করে চলে এল দরজায়।
রচনা খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে বলল, স্যার, পৃথিবীটা এত মোহনীয় কেন?
আমি বললাম, এক দেবতা ঈশ্বরকেও এ প্রশ্নটি করেছিলেন।
ঈশ্বর কী বলেছিলেন? অধীর আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল রচনা।
শোনো তাহলে তাদের কথোপকথন-
দেবতা: ঈশ্বর, পৃথিবী কেন এত মায়াময়?
ঈশ্বর: তাহলে হে দেব তুমি— ভালোবাসা পেয়ে গেছ নিশ্চয়।
রচনা বলল, পৃথিবীটা আলো-বাতাস ছাড়া হয়তো কিছুদিন বাঁচতে পারবে, কিন্তু স্যার, ভালোবাসা ছাড়া একদিনও বাঁচতে পারবে না।
ঠিক বলেছ।
কিন্তু স্যার, প্রকৃতির প্রতি যথেচ্ছাচার, মানুষের ভালোবাসার অভাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মানুষ এখন ক্রমশ ভালোবাসাহীন হয়ে যাচ্ছে। যাদের ভালোবাসা আছে তারা কাউকে কষ্ট দিতে পারে না। প্রকৃতিকে একটু কম কষ্ট দিলে ক্ষতি কী স্যার? সে তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না।
আমি বললাম, প্রকৃতির দানই তো মানুষের জীবন। প্রকৃতির দান নিতেই হবে।
রচনা বলল, দান আর ডাকাতি এবং ভালোবাসা আর ধর্ষণ কি এক?
না।
মানুষ প্রকৃতির দানের জন্য অপেক্ষা করতে চাইছে না। ডাকাতের মতো ধর্ষণ শুরু করে দিয়েছে। পুষ্ট হওয়ার পূর্বেই ছিঁড়ে নিচ্ছে সজীবতা, পাকার আগে

পাকিয়ে নিচ্ছে নানা রাসায়নিক দিয়ে। প্রকৃতিই যদি না-থাকে মানুষ থাকবে কীভাবে? শরীরের উপর অত্যাচার ব্যক্তির আয়ু কমায় আর প্রকৃতির উপর অত্যাচার মানব জাতির আয়ু কমিয়ে দেয়। প্রকৃতি একদিন প্রতিশোধ নেবে, বেশিদিন নেই, দেখো।
কল্পনা বলল, প্রকৃতির লাভ কী তাতে?
রচনা বলল, প্রকৃতি আমাদের মায়ের মতো। মানুষ, পশুপাখি, মাছগাছ সবই তার সন্তান। তার স্তন্য আমাদের জীবনপ্রবাহ। আমাদের প্রতি তার ভালোবাসার অন্ত নেই। কিন্তু কোনো সন্তান যদি মায়ের স্তন ছিন্নভিন্ন করে দেয়, কেটে নিয়ে একাই সব রস উপভোগ করার চেষ্টা করে, তো প্রকৃতি-মা নিজেকে এবং তার অন্য সন্তানদের বাঁচানোর জন্য কী করবে?
কী করবে? কল্পনা বলল।
তুমি বলো।
ওই কুলাঙ্গার সন্তানকে ছুড়ে দেবে।
প্রকৃতিও তাই করবে।
আপনি ঢাকায় চলে আসেন, রচনা বলল।
কয় মাস হলো?
দুই মাস।
দেখো মেয়ে, আমি এখানে যে কাজ করতাম সেকাজ আমার মতো করে কেউ আপাতত করতে পারছে না। বেশিদিন আমাকে রাখবে না, সরকারই বাধ্য হবে নিয়ে আসতে। যে সচিব আমাকে বদলি করেছেন, তিনিই ফোন করে বলেছেন, একটা আবেদন দিতে।
দেন?
মাথা খারাপ! তাদের প্রয়োজনে তারা আমাকে নিয়ে আসবে।