ড. মোহাম্মদ আমীন
লিখিত পরীক্ষা দুপুর বারোটায় শেষ হলেও উত্তরপত্র যাচাই করতে করতে রাত আটটা বেজে গেল। খান স্যার বারবার তাগিদ দিচ্ছেন। আমি নম্বরসূচি তৈরি করে খান স্যারের রুমে চলে গেলাম। রুমে ধোঁয়ার বিশ্রী গন্ধ। সিগারেট টানতে ভালো লাগলেও অন্যের টানা সিগারেটের ধোঁয়া ভালো লাগে না।

অনেকটা ভিন্ন জনের বমির মতো বিরক্তিকর।
খান স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাদের কতদূর হলো?
স্যারের সামনে রেজাল্ট সিট রাখতে রাখতে বললাম, কমপ্লিট স্যার।
: কয়জন লিখিত পরীক্ষা দিয়েছে?
: সাতশ বিশ জন।
: পাশ করেছে কয় জন?
: তেইশ জন। প্রথম হয়েছে একটা মেয়ে। আটানব্বই পেয়েছে, নাম রাকখসনা।
ছানাবড়া চোখে বিস্ময় টেনে খান স্যার বললেন, কত পেয়েছে?
: আটানব্বই।
: আমি আর নজরুল মিলে প্রশ্ন করেছি, এত নম্বর পেতে পারে না। নিশ্চয় কোথাও ভুল হয়েছে। নজরুলকে খাতাটা দেখিয়েছ?
নজরুল মানে জামাল নজরুল ইসলাম। তিনি আর খান স্যার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অক্সফোর্ডের অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন এবং বিশ্বখ্যাত মেধাবীদের মধ্যে অন্যতম প্রতিভার অধিকার একজন। যেমন জ্ঞান তেমন অনুভূতি, তেমনি তার বিবেচনা বোধ।
আমি বললাম, দেখিয়েছি।
: আর কাউকে দেখিয়েছ?
: তিনি ছাড়াও আরও দুজনকে দেখানো হয়েছে, সবার মন্তব্য একই। নিচে আছে। দ্বিতীয় হয়েছেন মাহবুব, তিনি পেয়েছেন উনপঞ্চাশ। সাতচল্লিশ পেয়ে অজিত তৃতীয় হয়েছেন।
রাকখসনা, মাহবুব ও অজিতের উত্তরপত্র উলটাতে থাকেন খান স্যার। আমি ওদের জীবনবৃত্তান্ত দেখছিলাম। রাকখসনা বিরানব্বই খ্রিষ্টাব্দে এইচএসসি পাশ করেছে।
: দ্বিতীয় জন?
: মাহবুব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। একানব্বই খ্রিষ্টাব্দে মাস্টার্স করে বের হয়েছেন। এখন একটি বেসরকারি কলেজে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাষক।
: তৃতীয়?
: অজিত। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট হতে প্রথম শ্রেণি পেয়েছেন।এখনো কিছু করেন না।
আদিল বলল, স্যার, মাহবুব প্রভাষকগিরি ছেড়ে কেরানিগিরি করতে চাইছেন।
খান স্যার বললেন, চাকরি গ্রহণ ও পরিবর্তনের স্বাধীনতা সবার আছে। প্রার্থী নির্বাচন বৈচারিক কাজ। আইন ও বিধির বাইরে এক চুলও যাওয়া যাবে না। যোগ্যপ্রার্থীই নিয়োগ পাবে।
: জি স্যার।
রাকখসনার উত্তরপত্র দেখছেন স্যার। যতই দেখছেন ততই চেহারায় বিস্ময়ের ছাপ পড়ছে। অনেকক্ষণ দেখার পর উত্তরপত্র বন্ধ করে বললেন, অবিশ্বাস্য।
: স্যার।
: আমি আর নজরুলের প্রশ্নে ইন্টার-পাশ একটা বালিকা এত নম্বর পেয়েছে— মাথা ঘুরে যাচ্ছে। এরকম মেধাবী মেয়ে কেরানিগিরি করতে চাইছে কেন?
আমি বললাম, জানি না স্যার।
: বাই দা বাই, সবার ভাইভা নেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। অন্যরা ভাইভাতে দশে দশ পেলেও মেয়েটার চেয়ে বেশি পাবে না।

আমি বললাম, মেয়েটা যদি যোগদান না-করে?
খান স্যার গম্ভীর গলায় বললেন, এমন মেধাবীদের অনেকে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে নিজেদের যাচাই করে, চাকরি করে না।
: স্যার, মেয়েটা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করেছে।
: তাহলে তো সে আসবেই না।
: জি স্যার।
: যাও, রেজাল্ট জানিয়ে দাও।
: ভাইভা কখন হবে স্যার?
: আগামীকাল, সকাল দশটায়।
: কয়জনকে ডাকব?
: প্রথম সাতজনের ভাইভা নেব। সাতজনকেই ডাকবে। প্রতিভাধারিণী ওই নম্বরখোর মেয়েটাকে ভাইভাতে ভালোভাবে ঝাঁকিয়ে নিতে হবে। দেখব ঘাম কত ঝরে। আটানব্বইয়ের মজা হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে ছাড়ব। পিচ্চি বালিকা, এত নম্বর কীভাবে পায়?