Warning: Constant DISALLOW_FILE_MODS already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 102

Warning: Constant DISALLOW_FILE_EDIT already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 103
স্যমন্তক: নবম পর্ব – Dr. Mohammed Amin

স্যমন্তক: নবম পর্ব

ড. মোহাম্মদ আমীন

স্যমন্তক: নবম পর্ব

নিয়োগের কাজ শেষ হওয়ার পরদিন আমি চট্টগ্রাম চলে যাই। নতুন অফিস, অনেক কাজ। রাকু এক সপ্তাহ পর চট্টগ্রাম যাবে এভাবেই তাকে বলা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে হলে প্রকল্প এলাকার একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সহায়তা প্রয়োজন।

ড. মোহাম্মদ আমীন

হাসান প্রকল্পের অধিক্ষেত্রভুক্ত চার উপজেলার একটির উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন কিছুদিন আমার ছাত্র ছিল সে। তাঁর বাবাও ছিলেন চেয়ারম্যান, চেয়ারম্যান থাকাকালীন মারা গেছেন। হাসানকে রাকুর বিষয়ে উপযুক্ত সাহায্যকারী মনে হলো।
খবর দিলাম।
পরদিনই চলে এল হাসান।
রাকুকে নিয়ে আমাদের পরিকল্পনার কথা শুনে খুশি হলো। তবু সংশয় নিয়ে বলল, বেআইনি হয়ে যাবে না তো আবার?
আমি বললাম, আমাদের পরিকল্পনায় তুমি আইন-বেআইন, বিধি-অবিধি এসব খুঁজতে যেও না। এটি নৈতিকতার বিষয়, আইনভিত্তিক ন্যায়বিচার নয়, নৈতিকতাভিত্তিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাই এর লক্ষ্য। তুমি লক্ষ টন আইনেও এক মিলিগ্রাম নৈতিকতা পাবে না। কোটি টন বিধিতেও পাবে না ডেসিগ্রাম মানবতা। আইন বড়োদের রক্ষার জন্য বড়োদেরই রচিত নৈতিকতাহীন কিছু নির্দেশনা। যাতে পুরো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আইন নামের খাঁচায় গৃহপালিত পশুর মতো বিধির কঠিন রশিতে বন্দি।
: আইন আর নৈতিকতার তফাত?
: একজন লোক প্রতিদিন সামনে দশ জনের খাবার নিয়ে খেতে বসে। দুমুঠো মুখে দিয়ে বাকিগুলো নষ্ট করে ফেলে। পাশের নয় জন ক্ষুধার্ত ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না-পেরে একদিন তার খাবার থেকে নয় জনের খাবার নিয়ে জোরপূর্বক খেয়ে ফেলল। ক্ষুধার্ত নয় লোক কি কাজটা ভালো করেছে?
উচিত করেছে, হাসান বলল।
:তুমি বললে, উচিত হয়েছে; এটাই নৈতিকতা। আইন বলবে, মালিক তার খাবার নষ্ট করুক আর যাই করুক, সেটি তার অধিকার। লোকগুলি ডাকাতি করছে। ওরা ডাকাত। তাদের শাস্তি দাও। অপরাধী কে? আইন যাকে অপরাধী বলে, আইন কি? ক্ষমতধর লোকের অস্ত্র। ব্রিটিশরাজের বিচারে ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত আসামি স্বাধীন ভারতের শ্রদ্ধাভাজন মন্ত্রী। কী বুঝলে হাসান?
হাসান বলল, বলুন স্যার, আমাকে কী করতে হবে? আমি রাজি।
: মেয়েটা তোমার ইউনিয়নের বাসিন্দা এবং ঘূর্ণি-উপদ্রুত—এরূপ একটা সনদ দিতে হবে। ঋণের আবেদনে তোমার সুপারিশ লাগবে। কত কোটিপতি তোমাদের কত চেয়ারম্যানের মিথ্যা সনদ আর ভুয়া সুপারিশে ঋণ পেয়ে যাচ্ছে  এবং যাবে, এবার না-হয় একজন অসহায়ের জন্য করলে— দেখো, ভালো লাগবে খুব। আবারও বলছি— বিধি খুঁজতে যেও না, যদি রাজি থাক করো, নইলে যাও।
: কিন্তু স্যার আমার ইউনিয়নের কোটা কমে যাবে না?
: তোমার ইউনিয়নকে প্রাপ্যতার চেয়ে আরও দুটো বেশি মানে একটা অতিরিক্ত দেওয়া হবে। খান স্যারের সঙ্গে আলাপ হয়েছে।
: তাহলে আমার আপত্তি নেই।
নির্ধারিত সময়ের আগে হাসান প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে গেল। রাকু এলে তার বাবার পক্ষে স্বাক্ষর নিয়ে ঋণের আবেদন প্রধান কার্যালয়ে প্রেরণ করা হবে। এসব করার জন্য রাকুকে কয়েকদিন চট্টগ্রাম থাকতে হবে।
কোথায় রাখি?
ছেলে হলে ভাবতে হতো না। মেয়ে বলেই সমস্যা। চট্টগ্রাম শহরে আমার এক চাচার বাসা আছে। ওখানে রাখলে কেমন হয়?
খান স্যারের পরামর্শ চাইলাম ফোনে। খান স্যার সোজাসাপ্টা বলে দিলেন, না।
আমি বললাম, তাহলে গ্রামে রাখি, মায়ের সঙ্গে?
: এ তো আরও ভয়ংকর।
: কেন স্যার?
: লোকে নানা কথা বলবে। মানুষের সবকিছুর অভাব আছে, শত্রুর অভাব নেই। জিহ্বা শরীরের সবচেয়ে নরম কিন্তু শরমহীন অঙ্গ। যে কোনো সময় যে কারো কাছে মেলে ধরা যায়। গ্রামে কোনো কথা গোপন থাকে না। বাঙালিরা পরশ্রীকাতর। আত্মীয়স্বজনই বেশি কাদা ছোড়ে। এমনকি তোমার মাও

স্যমন্তক, পুথিনিলয়।

সহজভাবে নেবে না, বরং প্রথম বদনামটা বের হতে পারে তার জিহ্বা থেকে। আমি জেলাপরিষদের সচিবকে বলে দিচ্ছি। রাকু আমার অতিথি হয়ে ডাকবাংলোয় থাকবে।
: আমিও স্যার ডাকবাংলোয় থাকি।
: ভালোই হলো। খেয়াল রেখো নিজের প্রতি এবং রাকুর প্রতি। সে সাহসী, কিন্তু স্পর্শকাতর— মনে রেখো। আচরণে সে প্রবল বিনয়ী, তবে মারাত্মক স্পষ্টবাদী। এমন মানুষ সহজে আমানুষ চিনে নিতে পারে। আমি কী বলতে চাইছি বুঝতে পেরেছ?
: পেরেছি, স্যার।
দুটোর দিকে রাকু আমার অফিসে চলে এল। তার মুখে হাসি, চোখে আনন্দ। চাকরি হয়ে গেছে—আর কী চাই! স্বজনের থাকা-খাওয়ার কথা ভাবতে হবে না। পৃথিবীটা এখন তার, সংসারটাই তো মানুষের পৃথিবী, এর বাইরের সব— উপগ্রহ, গ্রহ আর নক্ষত্র। কয়জনের সুযোগ হয় এসব নিয়ে ভাবার? অফিসে অজিতকে দেখে রাকুর হাসি মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
: স্যার, আমি কী যোগদানপত্রটা জমা দেব?
: আমরা অজিতকে নিয়োগ দিয়েছি।
আমার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাকু পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। চোখ দুটোর একটাও নড়ছে না। পাথুরে চোখের মতো নিশ্চল পাথর। এতক্ষণ তার চুলগুলো ফ্যানের বাতাসে কাঁপছিল, এখন সেগুলোও নড়ছে না। মন আহত হলে পুরো পৃথিবী থ হয়ে যায়।
: এই মেয়ে?
কোনো সাড়া নেই। চোখের জল গড়িয়ে গড়িয়ে গণ্ড বেয়ে গলায়—ঘামের সঙ্গে মিশে সংগ্রাম। কয়েক মিনিট পর চেয়ার থেকে উঠে বলল, আমি তাহলে যাই স্যার?
: কোথায়?
: বস্তিতে, আমার শিকড় যেখানে।
: তোমাকে তো যাওয়ার জন্য ডেকে আনিনি? শিকড় মাটিতে রেখে কনিফেরাস কোস্ট রেডউড  কি আকাশ ছোঁয় না?
: আমি কী করব স্যার?
: কিছু কাগজ দিচ্ছি, ভালোভাবে পড়ো, তারপর তোমার বাবার পক্ষে স্বাক্ষর করে দাও। এরপর তোমার কাজ আজকের মতো শেষ।
রাকু না-দেখেই কাগজগুলোয় স্বাক্ষর দিয়ে দিল।
আমি বললাম, পড়লে না যে?
কষ্টের মতো নিস্পৃহ গলায় বলল, স্যার, এবার আমি যাই?
: কোথায়?
: বস্তিতে। আমার ভাই-বোনের কাছে। বুড়ির বাসায় কাজে যেতে হবে। নইলে নতুন কাউকে রাখবে।
আমি অনেকটা আদেশের সুরে বললাম, ড্রাইভার তোমাকে ডাকবাংলোয় নিয়ে যাবে। রুম রাখা আছে। কেয়ার-টেকারকে বললে হবে—সরি তোমাকে কিছু বলতে হবে না, যা বলার ড্রাইভার মাসুম বলবে। খেয়েদেয়ে এসি ছেড়ে আচ্ছামতো ঘুম দেবে। ঘুম থেকে উঠে ছাদে হাঁটবে। ডাকবাংলো পাহাড়ের ওপর, বেশ লাগবে চট্টগ্রাম দেখতে। বে অব বেঙ্গলের জলও দেখতে পাবে।
: স্যার, আমার এই চাকুরিটা তো হলো না। অন্য চাকুরি দিচ্ছেন বুঝি?
: চাকরি লাগবে না। তোমরা যাতে ভালোভাবে চলতে পার, লেখাপড়া করতে পার সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিছু কাজ বাকি আছে তোমার। কয়েকদিন থাকতে হবে চট্টগ্রাম।
: আমি কিছুই বুঝতে পারছি না স্যার।
: বেশি বোঝার দরকার নেই। আমাদের ওপর আস্থা থাকলেই হলো।

স্যমন্তকের নায়িকা

রাকু অনড় বিশ্বাস নিয়ে আমার দিকে তাকাল। কিন্তু বিশ্বাস করার মতো কোনো বিশ্বাস মনের আনাচে-কানাচে খুঁজে পাচ্ছিল না। আবার অবিশ্বাসেরও কিছু পাচ্ছিল না। দৃষ্টিতে সংশয়, বুকে ভয় সবার বিশ্বাস আছে, পুরুষের নেই। পুরুষ মাত্রই  পরুষ। তারপরও চিকচিক করছে আশা, ভালো কিছু হবে নিশ্চয়; পুরুষই তো পুরুষকার বহন করে।
: আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?
: স্যার, আপনার উপর প্রবল বিশ্বাস কিন্তু …।
: চাকরিতে যোগদান করলে প্রতিমাসে যা পেতে তার চেয়ে বেশি পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
: কিন্তু স্যার কেন আমার জন্য এসব করছেন?
: উত্তরটা কী খুব জরুরি?
রাকু লজ্জায় মুখটা নত করে চেয়ার থেকে উঠে আমার পা ছুঁয়ে দিল দুহাতে।
আমি তার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম। চুলের পুরুত্বের জন্য মাথার স্পর্শ পেল না হাত। চুলের পিচ্ছিল মমতার মতো এক মন সুড়সুড়ি আমাকে মোহিত করে দিলে বেচয়েন স্নেহে। মাসুমকে বললাম, আপুকে ডাকবাংলোয় নিয়ে যাও। কেয়ার-টেকারকে বলিও-খান স্যারের মেহমান। কী করতে হবে না হবে তাকে বলা আছে।
স্যার, আপনার সঙ্গে যাই? রাকু বলল।
: তুমি ক্লান্ত। আমার অনেক কাজ, দেরি হবে। রুমে এসি আছে, খেয়েদেয়ে আরাম করো গিয়ে। তোমার এক রুম পরে আমি।
: আমি স্যার বস্তির মেয়ে, এসি চালাতে জানি না।
ধমক দিয়ে বললাম, কেউ কোনোকিছু মায়ের পেট থেকে জেনে আসে না। জেনে নিতে হয়। রিমোর্ট কন্ট্রোলের বোতামে সব লেখা আছে। খান স্যারের মতো জাঁদরেল সিএসপিকে নার্ভাস করে দিতে পার, একাজটা পারবে না কেন? মেয়েরা আসলে বেশি কথা বলে। যদি না পার, পিয়নকে বলিও।
লজ্জা পেয়ে সুড়সুড় করে বেরিয়ে গেল রাকু।

—————————————————-

ওয়েব লিংক
স্যমন্তক: দশম পর্ব
শুবাচ লিংক
স্যমন্তক: নবম পর্ব (শুবাচ লিংক)
স্যমন্তক: দশম পর্ব (শুবাচ লিংক)
=============== অন্যান্য==================

ইদানীং ও ইদানীং-এর বিপরীতার্থক শব্দ

ফলজ অর্থ পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ

————————————————————
————————————————————–