ড. মোহাম্মদ আমীন
স্যমন্তক: পঞ্চচত্বারিংশ পর্ব (৪৫)
আমার বৃহস্পতিবার আসার কথা, একটা কাজ থাকায় আগের দিন চলে আসি। কেউ জানে না, সারপ্রাইজ হবে সবার। রচনার পা-ভাঙার পরও আমার শিক্ষা হয়নি। এদিকে ঢাকায় নতুন কর্মস্থলে যোগদানের তাগিদ দিচ্ছে সবাই।
তিন তলায় উঠে দেখি দরজা খোলা। রচনা টেবিল সাজাচ্ছে। গায়ে মেরুন রঙের জামা। তার উপর ঘিয়ে রঙের ওড়না পরেছে। চুলগুলো নিপুণভাবে সাজানো। মেয়েরা কীভাবে এত চুল এত চমৎকারভাবে গুছিয়ে রাখতে পারে— আল্লাহ-মালুম।
এই মেয়ে?
আমার ডাক শুনে অপ্রত্যাশিত আনন্দে রচনা হতভম্ব। দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে, তোমরা এসে দেখে যাও কে এসেছে, আল্পু-কল্পু-টুটুল-নিনি।
কে এসেছে?
এসো না ভাই তাড়াতাড়ি, আমার স্যার!
দৌড়ে এল সবাই।
জড়িয়ে ইচ্ছেমতো আনন্দোপদ্রব সমাপনের পর বাকি কাজের শুরু। আল্পনা জামার বোতাম খুলছে। রচনা জুতো খুলে নিয়ে বারান্দার সোফায় বসিয়ে দিয়ে বলল, স্যার, দিনটা বেশ চমৎকার।
বেশ, তাই চলে এলাম না বলে।
উহ্ কী যে ভালো লাগছে।
আসলেই দিনটা চমৎকার। সন্ধ্যা হয় হয় ভাব। কিছুক্ষণ পর সূর্য ডুবে যাবে। এ সময়টুকু আমার ভালো লাগে। দিনের সমাপ্তি, রাতের সূচনা। সূচনা আর সমাপ্তির মিলন বড়োই সিঁদুরে। আর সিুঁদর মানেই তো বিধুর।
কী সুন্দর দিন, তাই না? আমি বললাম।
স্যার, আজ আমার আনন্দের সীমা নেই। প্রতিদিন এমন আগেভাগে চলে আসতে পারেন না? আসেন-না কেন?
যা প্রতিদিন ঘটে তা আর কোনো ঘটনা থাকে না। স্বাভাবিক হয়ে যায়। কথায় বলে, “বেশি আদর যেখানে, নিত্যি যাবে না সেখানে; যদি যাও নিত্যি ঘটবে একটা কীর্তি।”
রচনা বলল, ঘটুক কীর্তি, নামুক ঝড়; তাতেই দেখুন সৃষ্টি হবে বিশাল মনস সরোবর। আমরা আজ অনেক মজা করব। ঠিক তো?
রচনা মেঝে বসে আমার পা-দুটো টেনে নিয়ে মোজা খুলে পাশে রাখল। তারপর গভীর একাগ্রে নরুন দিয়ে পায়ের নখ কাটা শুরু করল।
আমি করতে চেয়েছিলাম, তুমি শুরু করে দিলে আপু? অভিমানী গলা কল্পনার।
তুমি তো নখ কাটতে গিয়ে মাংস কেটে ফেল, রচনা বলল।
এবার হবে না।
নখের দিকে ঝুঁকে পড়ে রচনা বলল, অনেক লম্বা হয়ে গেছে স্যার। অনেকদিন কাটা হয়নি।
কতদিন?
পনেরো দিন হবে।
ম্যাডাম?
স্যার, আমি ম্যাডাম হলাম কখন?
আজ বাদে কাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হচ্ছন, ম্যাডাম না তো কী?
চা নিয়ে আসি? কল্পনা মাথার চুল টানতে টানতে বলল।
চা আমার পছন্দের পানীয় না। তবে চায়ের মধ্যে মুড়ি-বিস্কুট ভিজিয়ে খেতে খারাপ লাগে না। ছোটোবেলায় কত খেয়েছি।
নখ কাটা শেষ, রচনা এখন পা টিপছে। আল্পনা গম্ভীর প্রকৃতির। না-ডাকলে আসে না। বললাম, কাছে এসো।
ওরা তো সব দখল করে নিয়েছে। আমার জন্য কিছুই রাখেনি।
তুমি আমার হাতের আঙুল টেনে দাও।
গ্রিলের ফাঁক দিয়ে নিচে তাকালাম। একদল শিশু পাশের বাসার এক চিলতে উঠোনে ফুটবল নিয়ে লাথালাথি করছে। আয়তন বিশ-পঁচিশ বর্গ ফুটের বেশি হবে নাা। বল আর অসহায় শিশুগুলো ছুটতে গিয়ে দেওয়ালে বারবার বাধা পাচ্ছিল।
দেখো, নগর সভ্যতার অভিশাপ শিশুদের কেমন জিয়ল মাছ করে দিয়েছে।
রচনা বলল, এখানে বল রাখার মাটি আছে, বস্তিতে বল রাখার মাটিও ছিল না।
“মানুষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অভাবও দিন দিন বাড়ছে।”, আমি বললাম, “এমন দিন আসবে মানুষের শোয়ার জায়াগাও থাকবে না, অথচ বহু জায়গা খালি পড়ে থাকবে, অনাবাদি হয়ে।”
যেমন? আমি জানতে চাইলাম।
মরুভূমি হয়ে যাবে, স্থলভাগ জলে ডুবে সাগর হয়ে যাবে। মানুষ যেমন প্রকৃতিকে ধর্ষণ করছে, প্রকৃতি এর প্রতিশোধ না নিয়ে কী ছাড়বে? প্রকৃতি নারীর মতো। এরা প্রতিশোধ না নিয়ে কাউকে ছাড়ে না। স্যার, ষোলো বছরের অভিজ্ঞতা আমার। জীবনকে ভালোভাবে জানার জন্য প্রত্যেককে কিছুদিন বস্তিতে থাকা উচিত।
নিনি আর টুটুল রচনার জন্য চা আর আমার জন্য এক মগ দুধ রেখে গেল।মগের শক্ত শরীরের কানায় তরল দুধের জন্য চুমুক দিলাম। সামান্য কাত করতেই উষ্ণতার তরল পরশ এসে ঠোঁটে চুমে খেল। চামড়ার নরম ঠোঁটে অদ্ভুত স্বাদের দুধ আসছে সিরামিকের শক্ত আবরণ বেয়ে। কী বুদ্ধি মানুষের— বুদ্ধি না কি নৃশংসতা।
স্যার, কী ভাবছেন? রচনার প্রশ্ন।
ভাবছি, কী কুদরত রাখে আমাদের ভগবান/সিরামিকের শক্ত কানায় ঢালছে দুধের করুণ বান।

করুণ হবে কেন স্যার?
পশুর-শাবকের দুধাধিকার কীভাবে আমরা ডাকাতি করে নিয়ে আসছি সিরামিকের গ্লাসে।
কল্পনা আমার স্বচরিত কবিতা শুনে বলল, ভাইয়া, আমি একটা কবিতা বলি?
রচনা কল্পনাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ছাদে যাই; যাবেন স্যার? চলুন। অনেক ভালো লাগবে। আসেন-না স্যার, অনেক দিন ছাদে উঠিনি! রচনা আমাকে সোফা থেকে একরকম জোরপূর্ব টানতে টানতে বলল।
চলো।
কবিতা বলার জন্য জেদ ধরে কল্পনা। আমি কিছু বলতে যাব, তার আগে রচনা ধাক্কা দিয়ে কল্পনাকে সরিয়ে দিতে গেল। কল্পনা টাল সামালতে না-পেরে মেঝেতে পড়ে যায়। আমি গিয়ে তুলে নিই, ভাগ্যিস তেমন ব্যথা পায়নি।
কল্পনা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বড়ো বড়ো চোখে ফোঁটা ফোঁটা জল এনে বলল, আপু তুমি ভালো না। খুব হিংসুটে, খুব খারাপ, খুব পচা। আজ থেকে আমার ভাইয়াকে তুমি একদম ধরবে না।
আমি ডাকলাম, কল্পু, আমার কাছে এসো।
না, আপু থাকলে আর কক্ষনো আপনার কাছে যাব না। শুধু ধাক্কায়, চোখ রাঙায়। তার ঈর্ষা তার চুলের চেয়ে কালো।
রচনাকে বললাম, তুমি মাঝে মাঝে এমন করো কেন? আমি ছাড়া ওদের কে আছে?
রচনা আমাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে সিঁড়ির দিকে, যেন কিছুই হয়নি। সিঁড়ির ধাপ পেরোতে পেরোতে একসময় শেষ হয়ে গেল। আকাশে তারা ফুটতে শুরু করবে কিছুক্ষণের মধ্যে। রাত সাজার অপেক্ষায় বিভোর হয়ে উঠছে ষোড়শীর মায়ায়। রাত না এলে অন্ধকার নামে না, অন্ধকার না হলে রাত সাজে না।
স্যার দেখুন না, সন্ধ্যাতারা কেমন মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে আছে। খুব সুন্দর লাগছে। না-এলে মিস করতেন।
আমি চুপ করে আছি।
রচনা আকাশে চোখ রেখে বলল, দিগন্তে দেখুন স্যার, আকাশ আর মাটিতে কী আদরে কানাকানি হচ্ছে।
তারপরও চুপ।
রচনা বলল, আপনি চুপ করে আছেন কেন, স্যার? কিছু বলুন।
আমার চুপের অর্থ যদি তুমি বুঝতে না পার, তাহলে কথাও বুঝতে পারবে না।
এসময় পেছন থেকে কল্পনা ডাক দিয়ে ওঠে, ভাইয়া, আকাশ-মাটি কানে কানে কী কথা বলে তা আপু জানে না।
অভিমান ভেঙেছে। রচনা গিয়ে কল্পনাকে আদরে জড়িয়ে ধরে আমার কাছে নিয়ে আসে। দু-বোনের রাগভাঙা ঘনিষ্ঠতা দেখে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল আবার।
কল্পনার কাঁধে হাত দিয়ে বললাম, আকাশ আর মাটি কখনো এত কাছাকাছি আসে না। মনে হয় তারা সুদূরে গিয়ে মিলেছে, কানাকানি হচ্ছে। এটি আমাদের কল্পনা, মানে তুমি।
যাহ!
রচনা বলল,
আকাশ আর মাটি
মাঝখানে তার বাতাস সুদূর,
মিলন পরিপাটি।
তাই তো, রচনা ঠিকই বলেছে! আমি বাতাসের কথা ভাবিনি। মাটি আর আকাশ, মাঝখানে বাতাস। বাতাস, আকাশ আর মাটির অবিচ্ছেদ্য মিলন-সূত্র।
“আসলে স্যার”, রচনা বলল, “বাতাসের কথা চিন্তা করলে আকাশ আর মাটি মিলে না, কিন্তু কানাকানি করে। যেমন নারী-পুরুষ— কোনো মিল নেই তাদের।”
আমি বললাম, Love isn’t something you find. Love is something that finds you.
রচনা তার ওড়নাটা দুহাতে পতাকার মতো মেলে ধরে।
একটা কবুতর উড়তে গিয়ে জাপ্টে পড়ে রচনার মুখে। হয়তো বাসায় ফিরছিল সেটি। সন্ধ্যার তাড়াহুড়োতে রচনায় ধাক্কা খেয়েছে। রচনার মুখে ছোটো একটা আঁচড় ফুটে উঠে চাঁদের শশীর মতো। রক্ত আসেনি তবে লাল হয়ে গেছে। রচনা ‘বাপ্স’ বলে ছোটো একটা লাফ দিয়ে কবুতরটিকে ছুঁয়ে দিয়ে বলল, তুমি আমার চেয়ে বেশি ব্যথা পেয়েছ হে।
পেছন থেকে আল্পনা তালি দিয়ে গেয়ে ওঠে, আপু, তুমি অনেক সুন্দর।
রচনা বলল, আসুন স্যার, বাসায় ঢুকে যাই।
কল্পনা বলল, তুমি যাও।
তুমি যাবে না?
না। ভাইয়া আর আমি সারা রাত ছাদে থেকে যাব।
———————————————————