স্যমন্তক: পঞ্চত্রিংশ পর্ব (৩৫)

ড. মোহাম্মদ আমীন

স্যমন্তক: পঞ্চত্রিংশ পর্ব (৩৫)

পুথিনিলয়।

“তুমি একটা অসাধারণ কাজ করেছ।” হুমায়ুন আজাদ তার ব্যতিক্রমী ভঙ্গিমায় এমনভাবে কথাটি বললেন রচনা আকস্মিক চমকে উঠল। কৌতূহলী গলায় আমার দিকে তাকিয়ে হুমায়ুন আজাদকে বললেন, কী কাজ, স্যার?
হুমায়ুন আজাদ রচনার দিকে তাকিয়ে আমাকে বললেন, তোমার রচনা।
আমি বললাম, স্যার, সে আমাদের সবার রচনা।
আমাদের হবে কেন?
আপনাদের অবদান কীভাবে অস্বীকার করি?
যোগ্যতাই তাকে এ পর্যায়ে এনেছে। রচনা মেরূদন্ডণ্ডহীন কোনো বুদ্ধিজীবীর কল্পনা নয়, শিল্পীর আল্পনাও নয়। তোমার একান্ত, কলি থেকে বের হয়ে আসা দৃশ্যমান সৌরভ, ধরাও যায়, ছোঁয়াও যায়, পিষে ফেলাও যায়। কিন্তু তুমি শেষের কাজটি করোনি, যা সবাই করে।
প্রশংসা শুনলে কার না ভালো লাগে। কিন্তু এমন ভালো-লাগা আসলেই ভালো না। প্রতিদিনই গুরুপাক খাদ্য গ্রহণের মতো ক্ষতিকর। এভাবে প্রশংসা পেতে পেতে প্রশংসার আকাঙ্ক্ষা এত বেড়ে যায় যে, তা ঈশ্বরত্বের দাবিতে গিয়ে ঠেকে। তবু প্রশংসার নেশা কাটে না এবং তা পূরণের জন্য একদিন মানুষ সত্যি সত্যি ঈশ্বরত্ব দাবি করে বসে। এভাবে মানুষে ঈশ্বরের ধারণা জাগ্রত হয়। এরপর শুরু হয় অহংবোধের কান্না। নিজেকে অদ্বিতীয় করে তোলার জন্য  ঈশ্বর তার অনুসারীদের মাঝে দলননীতি কায়েমের নির্দেশ জারি করে। যার অনিবার্য পরিণতি— বিভাজন, যুদ্ধ, রক্তাক্ত ইতিহাসের নৃশংস কাহিনি।
বললাম, রচনার মতো প্রতিভাবানের জন্য আপনিও এমন করতেন।
অত সাহস আর উদারতা আমার নেই। আমি পোষণ করি পিষ্ট করতে। মানুষ স্বভাবতই পাশব।
হুমায়ুন আজাদের সামনে আবুল কাশেম ফজলুল হক, তার পাশে একজন ফরসা মতো লোক— মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি। চোখে অহংবোধের কঠিন দৃষ্টি।
হুমায়ুন আজাদ, তার দিকে তাকিয়ে আমাকে বললেন, ড. গফুর। তোমার মন্ত্রণালয়ে তার, ঠিক তার না, তার ভাইয়ের একটা কাজ আছে। এজন্য আমার মাধ্যমে তোমার কাছে পরিচিত হতে এসেছে।
ফজলুল হক স্যার বললেন, পারলে কাজটা করে দিও।
আমরা পরস্পর সালাম বিনিময় করলাম।
ড. গফুর বললেন, আপনার কথা অনেকের কাছে শুনেছি।
আমি বললাম, ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ নয়, বলুন আলহামদুলিল্লাহ।
আমি হাসলাম, হুমায়ুন আজাদ স্যার আর ফজলুল হক স্যারও হাসলেন। আমাদের হাসিকে তেমন পাত্তা না দিয়ে ড. গফুর বললেন, একটা পরিবারকে আপনি তুলে এনেছেন, ভালো কথা, এমন সহজে দেখা যায় না। কিন্তু হাজার হাজার পরিবার যে রাস্তায়। তাদের কী হবে? তাদের জন্য কী করলেন? শুধু এক জনের জন্য করলে হবে?
হুমায়ুন আজাদ বললেন, প্রত্যেকে যদি এভাবে একজনকে তুলে আনত তাহলে রাস্তায় আর কেউ থাকত না। আপনি একজনকে তুলে আনুন। আমার সেই যোগ্যতা নেই, তাই পারছি না এবং করছি না। লজ্জাহীনের মতো স্বীকার করে নিচ্ছি।
“আমি একজন সৃজনশীল মানুষ”, ড. গফুর বললেন, “ধর্মকর্ম আর গবেষণা নিয়ে থাকি। এসব বাজে কাজ করার সময় আমার নেই।”
হুমায়ুন আজাদ বললেন, আলো যখন ভালোবেসে অন্ধকারের গলায় মালা পরিয়ে দেয়, পুষ্পভরা হাত যখন পুষ্প ফেলে দিয়ে ডাস্টবিন হতে মুমূর্ষু পাখির ছানাটা বাঁচিয়ে আনে— তখন যা ঘটে সেটিই সৃজনশীল ঘটনা। আপনারা যা করেন এবং আমরা যা করি  তা আসলে সৃষ্টি নয়, অনাসৃষ্টি। এগুলো দিয়ে তালি পাওয়া যায়, কিন্তু একটা বালিও নাড়তে পারেন না। সৃজন শব্দের অর্থ জানেন?
ড. গফুর বললেন, আল্লাহ ছাড়া কেউ সৃষ্টি করতে পারে না।
হুমায়ুন আজাদ বললেন, গফুর, আপনি একটা অমানুষ, একগ্রন্থমুখীরা অমানুষই হয়।
ড. গফুর আপনি শুধু শুধু আমাকে অমানুষ ডাকেন স্যার।
আপনার ছয় বছরের মেয়েকে আপনি এই গরমে বোরকা পরিয়ে স্কুলে পাঠান, এটা কী মানুষের কাজ?
ড. গফুর বললেন, এখন ধর্ষকদের হাত থেকে ছয় মাসের মেয়েরাও নিরাপদ নয়। রাস্তাঘাটে মেয়ে নিয়ে পুরুষের ঢলাঢলি দেখে অন্ধ হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়।

হুমায়ুন আজাদ

চরিত্রহীনের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন। কেয়ামতের লক্ষণ এসব।
হুমায়ুন আজাদ বললেন, নপংসুক হওয়ার চেয়ে চরিত্রহীন হওয়া ভালো।
রচনাকে হুমায়ুন আজাদ আদর করে ডাকেন রসনা। এতক্ষণ রচনা একটা কথাও বলেননি। সে স্যারদের আলাপে সহজে অংশগ্রহণ করে না। জানতে চাইলে কেবল যতটুকু মার্জিত এবং না-বললে নয় ঠিক ততটুকুই বলে। তার সব বকবক শুধু আমার সঙ্গে।
হুমায়ুন আজাদ ড. গফুরের উপস্থিতি দৃশ্যত অবহেলা করে বললেন, রসনা মা, আমি তোমাকে কত নম্বর জানি দিয়েছিলাম?
অনেক স্যার, রচনা হাসল, শ্রদ্ধামাখা হাসি, চোখের পল্লবে খুশির ছটায় আনন্দ টিকরে।
রচনায় এত রসনা থাকলে নম্বর কম দিই কীভাবে?
আপনার সাবজেক্টেই স্যার আমি সবচেয়ে কম নম্বর পাই।
এত নম্বর দিলাম, তবু বলিস কম নম্বর দিয়েছি। এজন্যই তো বলি— আমাদের পূর্বসূরিরা কত বলদ ছিল, তারা তোদের মতো অকৃতজ্ঞ উত্তরসূরি পয়দা করার জন্য আমাদের মতো রামছাগল রেখে গিয়েছেন। যা, আমি আর তোর খাতাই দেখব না। যে বেশি নম্বর দেবে, তারে দিয়ে দেখিয়ে নিস।
আপনার আশীর্বাদই আমার নম্বর।
হুমায়ুন আজাদ বললেন, এদিকে আয়, তোর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিই। তোর চেয়ে বেশি নম্বর কাউকে দিতে পারিনি। তুই আমার কলমের কালি। তুই আসলেই ভাগ্যবতীরে! 
রচনা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি যদি ভাগ্যবতী হই, তাহলে ‘স্যার’ আমার ভাগ্য বিধাতা।
ড. গফুর বললেন, কোন স্যার?
হুমায়ুন আজাদ আমাকে দেখিয়ে বললেন, বাবা-স্যার। বুঝলেন না, এই ছেলে ওই মেয়ের স্যার আর এই মেয়ে ওই ছেলের কন্যা।
ড. গফুর বললেন, এমন আজব সম্পর্কের কথা আগে কখনো শুনিনি।
হুমায়ুন আজাদ বললেন, পুরাতন কথা হলে শুনতে পেতেন। এটি বাবা-স্যারের সৃষ্টি। আপনার মতো কলম দিয়ে কাগজে টুকে ক্লাসে এসে উগরে দেওয়া নয়। একদম নতুন, তাই আগে শোনেননি। খোকাখুকুরা অনেক কিছু জানে না, বোঝে না। গফুর, রবীন্দ্রনাথ কী বলেছে জানেন?
আপনারা অযথাই রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ করেন, নজরুলের কথা বলতে দোষ কী? তিনি ইসলামের ঝান্ডা তুলে ধরেছেন তার গানে আর কবিতায়।
হুমায়ুন আজাদ বললেন, নজরুলও কিন্তু রবীন্দ্রনাথ-রবীন্দ্রনাথ করতেন। তার শ্যামাসংগীতগুলো শুনেছেন? তিনি ছিল শাক্ত, মাকালীর ভক্ত ছিলেন।
তিনি ইসলামি সংগীতও লিখেছেন। শ্যামাসংগীতের পাপ ইসলামি সংগীত কেটে দিয়েছে।
ড. গফুর আপনি আসলে একটা ইডিয়ট। এখন যান, আমি এদের সঙ্গে কথা বলব।
আমার যে একটা তদবির আছে?

ড. মোহাম্মদ আমীন

আমি যা বলার বলে দিয়েছি। বাকিটা আপনার কাজ।
ড. গফুর একটু বিমর্ষ গলায় বললেন, বিপদে না-পড়লে আমি এক্ষুনি চলে যেতাম।

আমি বললাম, আপনি যেতে পারেন। আগামীকাল সচিবালয়ে আসুন। এই আমার নম্বর। রিং করলে পাশ পাঠিয়ে দেব।

আবুল কাসেম ফজলুল হককে নিয়ে  ড. গফুর চলে গেলেন। আবুল কাসেম স্যারকে ড. গফুরই নিয়ে এসেছিলেন। তাঁরা চলে যাওয়ার পর হুমায়ুন আজাদ বললেন, কী বুঝলে মা রসনা?

আপনি আমার বিরল শ্রদ্ধার কয়েকজন মানুষের একজন।

 কেন, কেন?

মানুষ তার ভেতরের  খারাপগুলো সর্বদা ভেতরেই লুকিয়ে রাখে। বাইরে যা দেখায় তার অধিকাংশই প্রহসন। আপনি মানুষটি ঠিক তার উলটো। ভেতরে খারাপ কিছুই রাখেন না। মন্দ কিছুই নেই আপনার ভেতরে। সব খারাপ মুখ দিয়ে  বের করে ভেতরটা পবিত্র রাখেন। তাই ভণ্ডবেষ্টিত সমাজে আপনি অনাহূত। এজন্যই আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি। এজন্যই আপনি আমার বিরল শ্রদ্ধার পাত্রদের একজহন।

Language
error: Content is protected !!