ঢাকা শহরে মনের মতো বাসা পাওয়া সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া সুঁই খোঁজার মতো কষ্টসাধ্য, প্রচণ্ড বিরক্তিকরও। স্থান, ভাড়া, পরিবেশ, আয়তন, মালিকের শর্ত — এতসব জটিল বিষয়ের সমীকরণ মেলাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যেতে হয়। তবে কেন জানি, রাকুর বাসা খুঁজতে গিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একটা পছন্দসই বাসা পেয়ে যাই— মনে মনে যেখানে চেয়েছি একদম সেখানে। আসলে মেয়েটি ভাগ্যবান। কথায় বলে: ভাগ্যবানের বোঝা, ভগবান বয় সোজা।
বাসার মালিক বললেন, আমার নাম আফজল হক চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা। দেশের জন্য নয় মাস যুদ্ধ করেছি। মরে গেছিলাম, মরতে মরতে বাঁচি গেছি।
চৌধুরী নাম শুনে আমাদের গাছবাড়ীয়া স্কুলের শিক্ষক আজাদ স্যারের একটি ব্যাঙ্গাত্মক ছড়ার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি মজা করে বলতেন—
কথা শেষ হওয়ার আগেই আফজল সাহেব আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, অনর দাদারে আঁই পিরের মতো সম্মান গরি ওবা। আঁই তো মরি গেইলাম, তেঁই নিজের জীবনের হথা ন-ভাবি আরে বাঁচাই লইয়ে দে। অনে আঁর পির-নাতি। ভিতরে আইওন ওবা। কী হাইবান হন।
: দাদু, আপনার বাড়ি তো চট্টগ্রাম।
দাদু ডাক শুনে খুশি হলেন আফজল চৌধুরী। এভাবে মানুষকে তুষ্ট করতে হয়, প্রশিক্ষণে শেখানো হয়েছে। হাসিতে আন্তরিকতা ঢেলে বললেন, অহ্; অনর বাড়িও তো ওবা চিটাগাং।
জি, আমি বললাম।
:তই ছাবাইয়া হথা কিল্লাই হইতা লাইকগুনদে। বাংলা হথা হন।
পরিচয় আমার কদর বাড়িয়ে দিল। আফজল চৌধুরী আমাদের বারান্দা থেকে বাসার ভেতর নিয়ে গেলেন। এমনভাবে আপ্যায়ন করলেন যেন, আমার জন্য অনেক যুগ প্রতীক্ষায় ছিলেন। ব্যক্তিপ্রেম থেকে পরিবারপ্রেম। তারপর ক্রমান্বয়ে— গ্রাম, উপজেলা, জেলা, দেশ, উপমহাদেশ এবং বিশ্ব। তাই আঞ্চলিকতা দেশপ্রেমের উৎস, যদি উগ্র হয়ে যায় তো অন্য কথা। আফজল চৌধুরীর সঙ্গে দাদাকে নিয়ে কথা হলো। কথা হলো কীভাবে যুদ্ধ করেছেন;আহমদ হোসেন বীরপ্রতীক ও শেখ হাসিনা।
কথা হলো— আমার দাদা আহমদ হোসেন বীরপ্রতীক, আফজল চৌধুরীকে কীভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।
আমার প্লেটে রুটি তুলে দিতে দিতে বললেন, নাতি, অনে বাসাআন চই লন। পছন্দ অইলে লই লন। ভাড়ার লাই চিন্তা ন-গইজ্জুন। অঁনে আঁর জীবন-দাতার নাতি। আঁই রাজার পোয়া, চৌধুরী বংশ, চাটগাঁইয়া মানুষ।বাঁচিলে লাখ, মরিলে কোটি।
বাসা পছন্দের চেয়েও পছন্দ হয়ে গেল। তিন তলায়, তবে লিফট নেই, কিন্তু চারদিক যথেষ্ট খোলামেলা। বাতাসের ভাষার মতো মুখর থাকবে বাসাটি। চারদিক থেকে আলো-বাতাস আসবে হরদম গলগল করে— যুবতির লাজহীন উচ্ছ্বাসের মতো অনায়াসে।
রাকুকে বললাম, তোমার খাতায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জানি কত দিয়েছিলেন?
: আটানব্বই।
: বাসাকেও আমি আটানব্বই দিলাম, তুমি কত দিলে।
: একশ।
: গুড।
: এত বড়ো বাসার কী প্রয়োজন?
আফজল সাহেব রাকুর কথা শুনে বললেন, মনে অদ্দে নাতিন বউ চিটাইঙ্গা নয়। ভাড়া নিয়ে ভাববেন না, নাতবউ। বেশি মনে করলে ভাড়া নইদ্যুন। একখান ফ্ল্যাটের ভাড়া ন-লইলেও আঁর কিুছ অইতো ন। আঁই রাজার পোয়া, চৌধুরী বংশ, চাটগাঁইয়া মানুষ।বাঁচিলে লাখ, মরিলে কোটি।
লজ্জা পেয়ে যাই আমি এবং রাকু। কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। যদি আসল কথা বলে দিই ভাড়া দেবেন তো! না দিক, আসল কথাই বলে দেওয়া ভালো। একদিন তো জানাজানি হবেই। তখন লজ্জার সীমা থাকবে না।
বললাম, ওর নাম রাকু। সে আমার স্ত্রী নয়।
তাইলে কী? আঁতকে ওঠলেন আফজল চৌধুরী।
: আমার মেয়ে, কন্যা।
: কী হইলানদে ওবা! হত্তে বিয়া গইজ্জুন, হত্তে এত বড়ো মাইয়া অইয়ে! হন ধরনের মাইয়া? পাতাইন্যা মাইয়া নয় তো আবার? এহন ঢাহা শহরত পাতাইন্যা মাইয়া লই বাসাবাড়িত বওত কেলেঙ্কারি অর। এতল্লাই পুছ গজ্জিদি। নাতি, কিছু মনে ন-গইজ্জুন।
আমি বললাম, পাতানো হোক আর সাজানো হোক, মেয়ে মেয়েই। তিন বোন আর এক ভাই থাকবে। ভাড়া দেবেন কি না বলুন।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। খারাপ মন নিয়ে চৌধুরীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নামতে থাকি। এত সুন্দর একটা বাসা। ভিকারুননেসা আর সিদ্ধেশ্বরী স্কুলের মাঝখানে। ভাড়াটাও বেশি ছিল না। রাকুর মনটাও খারাপ হয়ে গেছে। তার চোখ দিয়ে জল পড়ছে লজ্জায়।
আমি বললাম, রাকু, আফজল সাহেবের কথায় কষ্ট পেয়েছ?
: না, এর চেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা আমার আছে। এক মুঠো ভাতের জন্য কত জন ঘাড় ধাক্কা দিয়েছে! কত জন কত অসিলায় শরীরে হাত দিয়েছে, অপমান করেছে। আমি আপনার জন্য কষ্ট পাচ্ছি। স্যার, কেন আমার জন্য এত কিছু করছেন? আমার কাছে আপনি কী চান? কী পাবেন আমার কাছে?
আমি হাসলাম, রাকু, ডিমের আকার ডিম্বাকৃতি কেন জানো?
: যাতে ডিমটি সহজে গড়িয়ে পড়ে ভেঙে না-যায়।
: কিন্তু অনেক পাখির ডিম গোলাকার।
: পৃথিবী গোলাকার, তাই।
: তাহলে বুঝে নাও কেন আমি তোমার জন্য এত করছি। তোমাদের জন্য বাসা খুঁজতে বস্তিতে গেলে এমন তিক্ত ঘটনা ঘটত না, অভিজাত এলাকায়ও
ড. মোহাম্মদ আমীন
ঘটত না। যত সংশয়, যত সমস্যা সব মধ্যবিত্তে। মধ্যবিত্তের মতো জটিল সমাজ আর হয় না। মধ্যবিত্ত মানে মাঝের মানুষ, মধ্যপন্থী। রাস্তার মাঝখানে হাঁটলে দুদিকের গাড়িই তোমাকে ধাক্কানোর সুযোগ পেয়ে যাবে।
গেট খুলে বাসার সীমানা থেকে বের হওয়ার আগে তিন তলা হতে আফজল চৌধুরীর গলা ভেসে এল— ওবা নাতি, রাগ ন-গইজ্জুন। বেয়াদপি গড়ি থাইলে বুড়া দাদারে মাফ গরি দিওন। উরে আইয়ুন। এই বাসা অনরে ভাড়া দিওয়ুম দে। আজিয়াত্তুন ইয়ান অনর বাসা মনে গরি থাইবানদে। আত্তে ভাড়া লাইগদু ন। আঁই ওবা রাজার পোয়া, বুইজ্জন-না? চৌধুরী বংশ। চাটগাঁইয়া মানুষ।বাঁচিলে লাখ, মরিলে কোটি।
আবার ওপরে ওঠলাম। আফজল সাহেব আমাকে জড়িয়ে ধরে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বললেন, অনর দাদাল্লই হথা অইয়ে। অনে এত বড়ো অফিসার ইয়ান ন-হইবান না ওবা? আইজহাইল্যা পোয়াছল বেশি বেকুব। দেহিলে মনে অয় অনে কলেজত পড়অন। আঁই তো মনে গজ্জি ছাত্র।
আফজল চৌধুরী বলেন, একটি অসহায় পরিবারের জন্য আপনি যদি এত কিছু করতে পারেন, তাহলে আমি পারব না কেন? দরকার হলে ভাড়া নইদ্দুন। আঁই রাজার পোয়া। আপনার দাদার কাছে সব শুনেছি। আপনি অনেক বড়ো মনের মানুষ। দাদার মতো অইওনদে।
আমি বললাম, কত ভাড়া দিতে হবে?
আফজল সাহেব বললেন, অন্য ভাড়াইট্টা অল যা দে, তাত্তুন তিন আজার ট্যায়া হম দিওন ওবা নাতি। এই এলাকাত ভাড়া একটু বেশি। দরহার অইলে নইদ্দুন। বাসাত উডি যন আগে। তারপর অন্য হথা।
আমি বললাম, দাদু, কয়টা রুম?
: চারটা বেডরুম, ডাইনিং, ড্রয়িং আর কিচেন। সাত-আট বছর আগে বানাইছি। এহন বানাইলে পাঁচ রুম গইত্তাম। মানুষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রুম ছোডো হয়ে যাচ্ছে। এত মানুষ থাকবে কোথায়?
: ঢাকা, ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মানুষের জঞ্জালে।
১৬
দুই মাসের অগ্রিম দিয়ে বাসার চাবি নিয়ে নিলাম। ফ্ল্যাটে ঢুকে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে রাকু। খুশিতে চিৎকার দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে,
আমি সামান্য হতচকিত হয়ে যাই। জড়িয়ে ধরেই রাকু বুঝতে পারল আবেগটা আবেগময় হয়ে গেছে। দ্রুত ছেড়ে দিয়ে বলল— সরি, স্যার।
লজ্জা আর ভয়ে রাকু কিছুটা গুটিয়ে গেল। আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল ফের। চোখে অনুতাপ নয়, লজ্জা। শরীর কাঁপছে তার— হালকা বাতাসে মোচড় খাওয়া সবুজ পাতার ছায়ার মতো। লজ্জা ভেঙে দেওয়া প্রয়োজন। একজন সপ্তদশী, কালও ছিল বস্তিতে, সে আজ ফ্ল্যাটে। তার এমন আবেগপ্রবণ না-হওয়াটাই হতো অস্বাভাবিক।
অনুচ্চকণ্ঠে বললাম, বাসা পছন্দ হয়েছে?
: স্যার, আমি কী সীমা অতিক্রম করে ফেলেছি?
: কীসের সীমা?
: আপনি তো মেয়ে বলেছেন। তাই জড়িয়ে ধরেছি। উচ্ছ্বাস সবসময় ঢেকে রাখা যায় না। ঢেকে রাখলে তা বানের জলের মতো দুকূল প্লাবিত করে দেয়।
“আমার একটা মেয়ে প্রয়োজন”, আমি বললাম, “যে আমাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরবে কিছু দিলে; আবেগপ্রবণ হয়ে কবিতা আওড়াবে কৃতজ্ঞতায়— বাবা আমার কল্পতরু, সবুজ বানায় ধু-ধু মরু।
“ওগো, তোরা কে যাবি পারে,
আমি তরী নিয়ে বসে আছি নদী কিনারে।”
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই রাকু বলে উঠল,
ও পারেতে উপবনে কত খেলা কত জনে,
এ পারেতে ধু ধু মরু বারি বিনা রে।” স্যার, আমি পারব আপনার মেয়ে হতে।
: একটা বোন প্রয়োজন, যে অভিমানে অভিমানে অস্থির করে দেবে আমাকে।
: আমি পারব।
: আমার একটা বন্ধু প্রয়োজন, যে দুষ্ট সব আবদারে আবদারে অতীষ্ঠ করে দেবে জীবন। বিরক্ত হয়ে ছুটতে হবে পালিয়ে।
স্যমন্তক, পুথিনিলয়।
“ আমি দেব, সব দেব। আর কোনো মেয়ে লাগবে না।” বলে রাকু আবার আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “স্যার, বড়ো রুমটায় আপনি থাকবেন। পাশেরটায় আমি আর টুটুল। বাকি দুটোর একটিতে আল্পনা অন্যটিতে কল্পনা।”
: আমি এখানে থাকব— এটা তোমাকে কে বলল?
: আপনি না-থাকলে সমুদ্রের সমান এই বাড়িতে কীভাবে একা একা চার ভাইবোন থাকব?
: এসব হিসাব এখন থাক। আগে ওদের নিয়ে আসি।
কাশির শব্দে ফিরে তাকাই, আফজল সাহেব। তিনি রাকুর ফ্ল্যাটে ঢুকতে ঢুকতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওবা নাতি, আজিয়া রাতিয়া তোয়ারা বেয়াকগুন আর বাসাত হাইবানদে। অনর দাদি রান্নাবান্না শুরু গইজ্জে।
রাকু বলল, দাদু, কী বললেন?
: আফজল সাহেব রাতে সবাইকে তাঁর বাসায় ডিনারের দাওয়াত দিয়েছেন।
রাকু বলল, এত কষ্ট করবেন? দাদু, অন্যদিন খাই।
: বেশি হথা ন-হইও।আঁই ওবা রাজার পোয়া, বুইজ্জন-নি? চৌধুরী বংশ। চাটগাঁইয়া মানুষ।বাঁচিলে লাখ, মরিলে কোটি। কী কী হাইবা ইয়ান হন।
আমি বললাম, ডাল, আলুভর্তা, সবজি আর ডিম।
: চিটাইঙ্গা মানুষ দশ তরহারির নিচে ফইররেও ন-হাবাই।
আমি বললাম, একটা ফোন করা খুব জরুরি।
আফজল সাহেব আমাকে তার বাসার দিকে নিয়ে যেতে যেতে বললেন, ওরা কোথায় থাকে?
: যাত্রাবাড়ির বস্তিতে।
: বস্তি বেশি হারাপ জায়গা। মাইয়াপোয়া অইলে আরও বেশি। ইতারা বাইচ্চা, মাথাত যত চুল তার ডবল থাগে উইন। ইতারা আইলে পুরো বিল্ডিঙে উইনে ভরি যাইব।
ফোনের পাশে বসতে বসতে আমি বললাম, দাদু, তারা এখন ন্যাড়া। উকুনের ভয় নেই।
: অনে ফোন গরন। আই নাতিন কি গরের চাই আয়।
আমি যাত্রাবাড়ি থানার ওসিকে ফোন করে বস্তির ঠিকানা আর যাত্রার সময় বলে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিতে বলি। ফোন শেষ করে বাসায় ঢুকে দেখি আফজল সাহেব রাকুকে চিটাইঙ্গা ভাষা শেখাচ্ছেন—
নাতিন বরই হা, বরই হা হাতে লইয়া নুন,
ঠেইল ভাঙিয়া পইজ্জে নাতিন বরই গাছত্তুন।
আমাকে দেখে চাটগাঁইয়া ছড়া থামিয়ে দরদি গলায় বললেন, তাড়াতাড়ি যান। নাতিন গো নিয়ে আসেন। আমার একটা লাইগব, আপনার দাদি বুড়ি অঁয় গেছে-গা।
To provide the best experiences, we use technologies like cookies to store and/or access device information. Consenting to these technologies will allow us to process data such as browsing behavior or unique IDs on this site. Not consenting or withdrawing consent, may adversely affect certain features and functions.
Functional
Always active
The technical storage or access is strictly necessary for the legitimate purpose of enabling the use of a specific service explicitly requested by the subscriber or user, or for the sole purpose of carrying out the transmission of a communication over an electronic communications network.
Preferences
The technical storage or access is necessary for the legitimate purpose of storing preferences that are not requested by the subscriber or user.
Statistics
The technical storage or access that is used exclusively for statistical purposes.The technical storage or access that is used exclusively for anonymous statistical purposes. Without a subpoena, voluntary compliance on the part of your Internet Service Provider, or additional records from a third party, information stored or retrieved for this purpose alone cannot usually be used to identify you.
Marketing
The technical storage or access is required to create user profiles to send advertising, or to track the user on a website or across several websites for similar marketing purposes.