ড. মোহাম্মদ আমীন
ইফাদ প্রকল্পের মূল কাজ শেষ হয়ে গেছে।
এখন কাজ কেবল ঋণ আদায়। এ দায়িত্ব পালন করবে ব্যাংক। হিসাব রাখার জন্য কয়েকজন কর্মচারী রাখা হয়েছে। সরকার, প্রকল্পের প্রায় সবকিছু গুটিয়ে নিয়েছে। অজিতের চাকরিও নেই। তার সমস্যা হবে না। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে প্রভাষক হিসাবে চাকরি হয়েছে তার।

আগামী মাসে যোগ দেবে।
আমার বদলি হলো ঢাকায়।
রচনা খুশিতে পাগল, স্যার প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে পড়াতে হবে।
কল্পনা বলল, আপনার গাড়িতে করে ঘুরব, ঢাকা শহরের কত কিছু দেখিনি!
গাড়ি কোথায় পাব?
আল্পনা বলল, পাজেরো?
আমি বললাম, ওটা প্রকল্পের গাড়ি। প্রকল্প শেষ, গাড়িও শেষ। এখন এটি এক বড়ো সাহেবের বউ-বাচ্চা আর শালা-শালিদের টানাটানি করে।
কল্পনা বলল, ভাইয়া আপনার গাড়ি নেই?
প্রজেক্টের বড়ো অফিসার সচিবালয়ে সবচেয়ে ছোটো অফিসার। পুকুরের বোয়াল মাছ নদীর পুঁটি। সচিবালয়ে ছোটোদের সবসময় গাড়ি চড়তে নেই। আমরা ইয়াং, শক্ত পা আছে, সরকার এটি জানে।
কল্পনা বলল, অফিসে আসা-যাওয়া করার জন্য গাড়ি দিল কেন?
নইলে যে বসের গাড়ি নিয়ে টানাটানি করে দেব।
রচনা বলল, আপনার মতো অনেক অফিসারের সার্বক্ষণিক গাড়ি আছে।
ওগুলো প্রকল্পের গাড়ি। সব মন্ত্রণালয়ে নেই, সব অফিসার পায় না।
আল্পনা বলল, গাড়ি কখন পাবেন ভাইয়া?
কয়েক মাসের মধ্যে পেয়ে যাব। মাত্র এলাম, শেকড়টা একটু ভিতরে যাক।
হঠাৎ নিচ থেকে মিছিলের চিৎকার ভেসে এল। বাসার অদূরে বস্তি, বস্তির পাশে গলিপথ, গলিপথ থেকে দুমিনিট হাঁটলে রাজপথ। রাজপথ দিয়ে মিছিল যাচ্ছে। সবার হাতে প্রতীক, আমার ভাই তোমার ভাই অমুক ভাই অমুক ভাই।
কল্পনা বলল, ভাইয়া, ভোট কেন হয়?
নেতা হওয়ার জন্য।
আল্পনা বলল, কারা ভোট চায়?
যারা নেতা হতে চায় তারাই ভোট চায়।
এর কি ভিক্ষুক?
ভোট যেভাবে চায় তাতে বলতে পারি ভিক্ষুকের চেয়েও হীন।
কল্পনা বলল, বাবা, কারা ভোট দেয়?
যে বোকা লোকদের কিছুই দেওয়ার থাকে না, তারাই ভোট দেয়।
আল্পনা বলল, এমন লোকরা তো সবাই বস্তিতে থাকে।
রচনা বলল, বস্তির লোকেরাই ভোট দেয়।
আল্পনা বলল, তাহলে ওরা কি বস্তির লোকের চেয়েও দরিদ্র?
হ্যাঁ, আমি বললাম।
আল্পনা আমাকে উদ্দেশ করে বলল, আপনারা ভোট দেন না ভাইয়া? আপনাদের বাসা তো বস্তি নয়।
আমি বললাম, সব বাসাই বস্তি নতুবা সব ভোটারই বস্তিতে থাকে। শুধু ছোটো-বড়ো কিংবা নির্মাণ সামগ্রীর তফাত। যত দামিই খাও, মল মাত্রই গন্ধবহ।
রচনা বলল, ভোট কী স্যার?
রাইফেলের মতো একটি মারাত্মক অস্ত্র। এর প্রয়োজনীয়তা ব্যবহারকারীর আচরণের ওপর নির্ভরশীল।
কল্পনা পেনসিলের ইরেজার কামড়াতে কামড়াতে বলল, ইরেজারটা যে শেষ হয়ে গেল।
এভাবে কামড়ালে থাকবে কীভাবে? রচনা ধমক দিল।
আল্পনা বলল, ভাইয়া কোন দেশের পেনসিলে ইরেজার নেই?
রচনা বলল, যে দেশে কোনো দুর্নীতি নেই।
স্যার, কোন দেশে দুর্নতি নেই? আল্পনা বলল।
এমন দেশ তো নেই।
রচনা বলল, দুর্নীতি কী স্যার?
আমি বললাম, ধরো— প্রাণীর খাদ্যগ্রহণ একটি প্রকল্প। গৃহীত খাদ্য থেকে শরীর পুষ্টি হিসাবে যা টেনে নেয় তা উন্নয়ন, মলমূত্র হিসাবে যা ত্যাগ করে সেটি দুর্নীতি।
রচনা বলল, মলমূত্র ত্যাগ করে না এমন কোনো জীবন্ত প্রাণীর কথা কল্পনা করা যায় না।
আমি বললাম, তাহলে দুর্নীতিহীন কোনো জাতির কথাও কল্পনা করা যায় না। দুর্নীতি হচ্ছে উন্নয়নের অনিবার্য পূর্বশর্ত। তবে খেয়াল রাখতে হবে তা যেন ডায়রিয়ার মতো অতিরিক্ত না-হয়ে যায়।
আল্পনা বলল, পেনসিলের ভিতরের ছোটো কালো অংশ ছাড়া বাকি পুরোটাই অকাজের। শার্পনার দিয়ে যা কেটে আবর্জনা হিসাবে ফেলে দিতে হয়। এটি না থাকলে কী হয়?
রচনা বলল, তুমি যাকে অকাজের আবর্জনা অংশ বলছ সেটি আছে বলেই ক্ষুদে ছোটো অংশটা নিরাপদ, অক্ষত থাকে, কাজ করতে পারে। তোমার ওই আবর্জনাই নিরাপদ রাখে কাজের অংশটি। তুমি যাকে অকাজের বলছ, সে আসলে অকাজের নয়। সেই আসল কাজের। নিজেকে বিসর্জন দিয়ে অক্ষম পেনসিলকে কার্যকর রাখে এবং উদ্দেশ্য পূরণে সহায়তা করে। সমাজের সাধারণ মানুষ যেমন, পেন্সিলের বহিরাংশও তেমন। পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি এ যেমন মন সকলি দাও, তার মতো সুখ কোথাও কি আছে আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
কামিনী রায়ের সুখ কবিতা, কল্পনা বলল।
আমি আল্পনাকে বললাম, পেনসিল কাটলে কী হয়?
ভাইয়া ধারালো হয়। দ্রুত লেখা যায়। লেখা চিকন হয়, সুন্দর হয়।
পেনসিল আমাদের কী শিক্ষা দিল?
ভাইয়া আপনি বলুন।
কষ্ট তোমাকে ধারালো করবে। ওই ধার তোমার জীবনপথে চিহ্নের পর চিহ্ন রেখে যাবে অবলীলায়। যেমন পেনসিল রাখে। সবচেয়ে বড়ো শিক্ষা হচ্ছে— তোমার ভিতরে যা আছে সেটিই উপকারী, বাইরে কী আছে তা নয়। পেনসিলের আগে যদি ইরেজার শেষ হয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে, তোমার চলার পথে ভুলের পরিমাণ শুদ্ধের চেয়ে বেশি ছিল।
আমাদের কথার মাঝে কলিংবেল বেজে ওঠে।
দরজা খুলে দিল কল্পনা।
ঘরে ঢুকলেন আফজল চৌধুরী; সঙ্গে তার স্ত্রী ফিরোজা বেগম চৌধুরানি ও কনিষ্ঠা কন্যা তাহমিনা। আফজল সাহেবের দুই হাতে ঢাউশ আকৃতির দুটি মিষ্টির প্যাকেট—আলাউদ্দিনের মিষ্টি অপূর্ব সৃষ্টি।
রচনা উঠে গিয়ে স্বাগত জানাল।
তাহমিনা আমাকে আর রচনাকে পায়ে ধরে সালাম করল।
আমি বললাম, সালাম আর মিষ্টি— একই সাথে রোদ একই সাথে বৃষ্টি। কী ব্যাপার?
আফজল সাহেব মিষ্টির প্যাকেট দুটো রচনার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, বোন রচনা, তোমার লেখা রচনা লিখে আমার মেয়ে রচনা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে।
রচনা হেসে বলল, আপনার মেয়ে লেখাপড়ায় খুব ভালো।
আফজল সাহেব বললেন, নাতিন, সবাই তাড়াতাড়ি ভোটার হয়ে যাও। আগামী বার আমি কমিশনার প্রার্থী হব।

আমি ছাড়া বাকিদের বয়স আঠার বছরের কম, রচনা বলল।
তাতে কী? বয়স আমি যা বলি তা। এদের চেয়ে অনেক কম বয়সের বালকদেরও ভোটার করা হচ্ছে।
“দাদু”, রচনা বলল, “আপনার ভবনে কয়টি পরিবার থাকে?”
ষোলোটি।
কিন্তু কেউ কাউকে চেনে না।
ঠিক বলেছ, নাতনি।
রচনা বলল, ভবনের সব বাসিন্দাদের নিয়ে একটা মাসোৎসব করলে কেমন হয়?
এটা আবার কী?
সবাই মিলে প্রতিমাসে একবার উৎসব করব। খাওয়া-দাওয়া হবে, গান-বাজনা চলবে, শিশুবুড়ো আর নরনারী সবার জন্য কম্পিটিশন, খেলাধুলা—এ আর কী।
আফজল চৌধুরী খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে বললেন, অনেক সুন্দর নাম, মাসোৎসব। এ মাস থেকে রেগুলার মাসোৎসব করব। আমি সবাইকে খবর দিচ্ছি। এখান থেকে শুরু হবে আমার নির্বাচনী প্রচার।
কিছুক্ষণের মধ্যে ভবনের প্রায় সবাই চলে এলেন। রচনার প্রস্তাব মহানন্দে গৃহীত হলো। প্রথম মাসোৎসবে ভবনের সদস্যদের ভোটে রচনা সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়। প্রেসিডেন্ট হলেন আফজল ভবনের মালিক আফজল হক চৌধুরী।
ইদানীং ও ইদানীং-এর বিপরীতার্থক শব্দ