ড. মোহাম্মদ আমীন
রাত বারোটা পঞ্চান্ন মিনিটে ফ্লাইট। সময় বেশি নেই।
রচনার সময় যতই ঘনিয়ে আসছে তার মেয়েরূপ আসন ততই টলছে। নানাদিক হতে কুয়াশা এসে ভিড় করছে রচনার মা-রূপকতায়। কুয়াশার ভেতর যাকে দেখা যাচ্ছে সে কন্যা-মা রচনা নয়, আমিও যেন তার বাবা-স্যার নই; অন্য একজন- প্রেমিকার মতো মহাকামনার উদ্্বাহু মদিরতা নিয়ে ছুটে আসছে আমার দিকে, আমিও ছুটে যাচ্ছি তার দিকে।
মাঝখানে কেবল দূর,
কতদূর!
রচনায় এখন অন্য রচনা ভর করেছে। তার চোখে যুদ্ধের ইতিহাস, স্পৃহারা জয়ের মত্ততায় বিভোর। আমি বুঝতে পারছি না কী আমার করা উচিত। শুধু বুঝতে পারছি- কন্যারূপী চঞ্চলতায় প্রেমিকের আনাগোনা বড়োই ভয়ংকর।
রচনা গোঁ ধরে আছে, অক্সফোর্ডে যাবে না। অনেক কষ্টে, রীতিমতো ধমকিয়ে রাজি করানো হয়েছে। এতদিন সেই আমার লাগেজ গুছিয়ে দিয়েছে। আজ তার লাগেজই আমাকে গুছিয়ে দিতে হলো। পার্থক্য হচ্ছে তাকে আমার লাগেজ গুছাতে হয়েছে বারবার, কিন্তু আমাকে গুছাতে হবে একবার। বাকি তিনজনের অবস্থাও করুণ। সবার চোখ জলকরুণায় জ্বলে জ্বলে পাণ্ডুর।
নিনির চিৎকার, আমার কী হবে গো আপা।
শুধু আমাদের ভবন নয়, পুরো মহল্লার সবার মনে বিদায়ের বেদনা। তাদের প্রিয় রচনাকে আর দেখবে না। ব্যথায় আমার বুক ধড়ফড় করছে, এ ব্যথা সিগারেটের নিকোটিনের প্রতিক্রিয়া নয়, ভালোবাসার ধাক্কা। ভালোবাসার নিকোটিন সিগারেটের নিকোটিনের চেয়ে মারাত্মক।
কল্পনা, আমি ডাক দিলাম জোর গলায়।
ভাইয়া কিছু বলবেন?
হারমোনিয়ামটা নিয়ে এসো।
আমার ডাকে স্বাভাবিকতা ছিল না। ছুটে এল সবাই। সবার মুখে প্রশ্ন। রচনা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, শরীর খারাপ, স্যার?
আমি তার প্রশ্নকে পাত্তা না-দিয়ে বললাম, গান শুনব, একটা গান। যে গানটা গাও, কী জানি লিরিক … মনে পড়ছে না।
রচনা বলল, যদি তারে নাই চিনি গো সে কি?
না।
“যদি আপনার মনে মাধুরী মিশায়ে এঁকে থাকো কারো ছবি
সে কথা বলিয়া যেও ভুলিয়া যাবে কি সবি।”
না।
কোনটি?
আমি অস্থির আবেগে বললাম, যেটা গাইতে নিষেধ করতাম বারবার, তবু তুমি গাওয়ার চেষ্টা করতে কিন্তু দুই লাইনের বেশি গাইতে দিইনি কখনো। গাইতে পারলে আমিই গেয়ে শোনাতাম।
রচনা গাইতে শুরু করল
আমার পূজার ফুল ভালোবাসা হয়ে গেছে,
তুমি যেন ভুল বুঝ না। …।
আমি বললাম, আবার গাও।
রচনার চোখ ছলছল।
তবু গাইল কেঁদে কেঁদে। আরও শুনতে ইচ্ছা করছিল, ঘড়ি দেখে ইচ্ছাকে থামিয়ে দিলাম। সময় আমার কষ্ট বুঝল না, সে যথাসময়ে এসে কড়া নাড়ল কর্তব্যের গোড়ায়।
এবার উঠতে হবে মেয়ে, সময় সময়ের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। বন্ধ হওয়ার আগে পৌঁছতে হবে গন্তব্যে।