স্যমন্তক: পঞ্চাশত্তম পর্ব

ড. মোহাম্মদ আমীন

স্যমন্তক: পাঞ্চশত্তম পর্ব

তুমি কাজটা ভালো করনি?
কোন কাজ স্যার?
হুমায়ুন আজাদ স্যারের সামনে অমন না-করলেও পারতে। মোটেও ভালো লাগেনি।
রচনা চট করে বলে দিল, ভালো না-লাগলে টেনে তুলে এভাবে জড়িয়ে ধরেছিলেন কেন? আমি আমার স্রষ্টার প্রতি শ্রদ্ধা জানাব, তাতে আপনার কী?
লজ্জা পেয়ে গেলাম তার কথায়। লজ্জা পেলে মানুষ হিতাহিত বোধ হারিয়ে ফেলে। আমারও তাই হলো। অনেকটা অবিবেচকের মতো বলে দিলাম, তুমিও তো আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে।
আপনি ধরেছেন বলে আমি ধরেছি।
আমি আরও রেগে যাই, চুপ করো মেয়ে। দিন দিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছ।
রচনা চুপ করে গেল। তাকে চুপ দেখে আমি ভীতু লোকের মতো সাহসী হয়ে উঠি, “Never follow the crowd, until and unless you’re crossing the road.” 
কী বললেন স্যার? কথাটি আরও কয়েক বার বলেছেন।
আমি সস্তা হয়ে গেছি। আগে কী করতে আর এখন কী কর আমি বুঝি না মনে কর? সব বুঝি, বলি না; ধৈর্য ধরে দেখি।
বলা শেষ করার পর বুঝলাম বলা উচিত হয়নি। বাবা বলতেন,
“নিত্যি রাগের মানব,
ভয়ংকর এক দানব।
নিত্যি রাগ যার মনে,
সে কেন যায় না চলে শ্বপদ চরা বনে!”
আমি কী তাহলে দানব হয়ে যাচ্ছি? কিন্তু কী আর করা, ছেড়ে দেওয়া গুলি আর বলে ফেলা বুলি ফিরিয়ে আনা যায় না। রচনা মুখ ভার করে অন্যদিকে তাকিয়ে। নিশ্চয় চোখ জলে ভরে গেছে, মন নুয়ে আছে কষ্টে।
অনুতপ্ত গলায় আদর ঢেলে বললাম, এই মেয়ে রাগ করেছ?
স্যার, রাগ করলে নিজেরই ক্ষতি। জীবনটা খুব ছোটো, তাই রাগ করে সময় নষ্ট করি না। রাগের সময় মৃত সময়, রাগের মন কবুরে একাকিত্বের হাহাকার। বর্তমানটাই জীবনের সবচেয়ে সেরা মুহূর্ত, এই সেরা মুহূর্তটাই যদি রাখের আগুনে ফেলে পুড়ে ফেলি তাহলে জীবন রেখেই বা লাভ কী?
সত্যি, রাগ করোনি তো?
স্যার, রাগের ফল কষ্ট। রাগ যার উপর ভর করে তার সবকিছু রাগের অধিকারে চলে যায়। এ অবস্থায় মানুষ মাছের মতো নিজের সন্তানকেও খেয়ে ফেলতে দ্বিধা করে না। রাগের বশে গেলে মানুষ স্বজনহীন হয়ে যায়।
রাগ না-করলে হুতোম প্যাঁচার মতো মুখটাকে ভার করে রেখেছ কেন?
অভিমান করেছি স্যার, রাগ নয়। আপনি স্যার মাঝে মাঝে রাগ করেন।
কই?
রচনা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, এই যে কিছুক্ষণ আগে আমাকে আজেবাজে কথা বললেন। তারপর কথা ঘুরিয়ে বলল, স্যার, দেখুন, কী সুন্দরভাবে সন্ধ্যেটা নেমে আসছে, সূর্যটা সরে গিয়ে সন্ধ্যাকে পথ করে দিচ্ছে আসার। এভাবে মৃত্যুকে পথ করে দেয় জীবন, আবার জীবনকে আসার পথ করে দেয় মৃত্যু। সকাল বেলা ঘটে সন্ধ্যার উলটো। আমরা স্যার কোন বেলা?
আমি চুপ করে আছি, এটি রাগের পূর্বাভাস। আমাদের গাড়ি যানজটে থেমে আছে। রচনা আমাকে মৃদ ঠেলা দিয়ে রাস্তার দিকে চোখ দিয়ে বলল, দেখুন স্যার, ছেলেটা কীভাবে ভিক্ষা চাইছে। একদম আমাদের টুটুলের মতো। গাড়ি থামান ড্রাইভার, আমি বাচ্চাটাকে কিছু টাকা দিয়ে আসি।
গাড়ি থামার আগে আমি মুখর হয়ে উঠি, তুমি নামবে না, এ রাস্তায় প্রচুর আবর্জনা। বলো কত টাকা দেব, আমি দিয়ে আসি।
আমি বস্তির মেয়ে। আবর্জনায় আমার জন্ম। আবর্জনাই পৃথিবীর একমাত্র বস্তু যার কোনো আবর্জনা নেই। তাই তার কোনো হিংসে নেই। এটাই আবর্জনার সবচেয়ে বড়ো গুণ। আবর্জনাহীন জগৎ সহজে আবর্জনার দখলে চলে আসে। তাই ধনীদের সর্বক্ষণ আবর্জনার ভয়ে তটস্থ থাকতে হয়।
চুপ মেয়ে, বস্তি বস্তি করলে চড় মেরে দাঁত ভেঙে দেব।
সরি, স্যার।
আমাদের নামত হলো না, ছেলেটাই কাছে এসে হাত পাতল। রচনা ভ্যানিটি ব্যাগ হতে কিছু টাকা বের করে ছেলেটির হাতে দিতে দিতে আমাকে উদ্দেশ করে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার, অবিকল আমাদের টুটুল।
সব শিশুই টুটুল। মানুষই টুটুলকে ভিক্ষুক বানায়।
স্যার, ছেলেটাকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাই?
কেন?
আমাদের মতো করে গড়ে তুলব।
না।
তাহলে আমাদের এনেছেন কেন?
পৃথিবীর সব সম্পদ আমার নয়, তেমনি সব দায়ও আমার নয়।
ছেলেটা স্যার ভালো হবে।
আচ্ছা, বলছ যখন গাড়িতে তুলে নাও।
রচনা ছেলেটাকে ডেকে বলল, আমাদের সঙ্গে যাবে?
যাইতাম না।
কেন?
বাসায় মারে। রোজগার কম।
তোমাকে মারব না, লেখাপড়া করাব। আদর দেব, স্কুলে পাঠাব।
পয়লা এমন সবাই কয়। আঁই হইরতাম ন। হইরলে মাইনষে খারাপ অই যাই।
তোমারে কে কইছে?
রচনার কথার উত্তর না দিয়ে ছেলেটি আর একটা গাড়ির কাছে চলে গেল। রচনা আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে বলল, দেখুন

স্যমন্তকের নায়িকা

স্যার, মানুষ পরস্পরের প্রতি কত আস্থাহীন হয়ে পড়েছে। ছেলেটির মনেও অবিশ্বাস। দেওয়ালের পর দেওয়াল উঠছে চারদিকে, আলামারির ভিতর আলমারি, তালার ভিতর তালা। সবাই বন্ধন ছিন্ন করে নিজের গণ্ডিকে সীমিত করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। চারদিকে বন্ধন বিস্তারের উদ্যোগ, সেতু নির্মাণের কেউ নেই।
তোমার মা-বাবাকে মনে পড়ে?
রচনা আমার ডান হাত নিজের কোলে টেনে নিয়ে বলল, মাকে মনে পড়ে, বাবাকেও। তার চেয়ে বেশি মনে পড়ে নিজেকে।
আমার চেয়েও বেশি মনে পড়ে আমার রচয়িতাকে। স্যার, আমার ওপর রাগবেন না, আমাকে বকা দেবেন না। আপনার সামান্য বকাতেই নিজেকে অনেক বড়ো অপরাধী মনে হয়। বকবেন না না তো?
না।
স্যার, আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন?
এখানেই ছিলাম, যেখানে আছি। আমি বর্তমান, তোমার সেরা মুহূর্ত।
রচনার হাত এখন আমার কাঁধে। রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট। অনেকক্ষণ এক জায়গায় থেমে আছি। তবু খারাপ লাগছে না। এই প্রথম বুঝতে পারলাম, মাঝে মাঝে বিরক্তিকর যানজটও অবস্থার কারণে মধুর হয়ে ওঠে। এটিই আপেক্ষিক তত্ত্ব।
রচনা বলল, স্যার, যানজটও ভালো লাগে, যদি প্রিয় মানুষটা পাশে থাকে।
আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই, তোমাকে দেখে। কীভাবে এলে, কোত্থেকে। তুমি এলে, শুধু আমাকে নয়- সবাইকে মুগ্ধ করে দিলে।
দেখুন স্যার, মানুষ কীভাবে দলবেঁধে রাস্তা পার হচ্ছে। আমিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসার পথে রাস্তা পার হওয়ার সময় জনতার জন্য অপেক্ষা করি। বেশি মানুষ হলে রাস্তা পার হতে বেশি সুবিধা। আপনি বলতেন—“Never follow the crowd, until and unless you’re crossing the road.”  আপনার উপদেশ আর সহায়তাই আমার পাথেয়।
কেবল সেই সাহায্য পায়, যে সাহায্য পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। তুমি আমাকে কতটুকু চেন?
রচনা বলল, যতটুক চিনি তাই যথেষ্ট। পুরো চিনতে গেলে আমি আর আমার থাকতে পারি না। আমি শুধু প্রার্থনা করি আপনি এভাবেই আমার হয়ে থাকবেন।
রচনা কবিতার লাইনের মতো নিবিড় মমতায় আমার কাঁধে তার মাথাটা এলিয়ে দিয়ে বলল, স্যার, আপনাকে আমি চিনতে পারি না, কত চেষ্টা করি চেনার।
চেনার চেষ্টায় হচ্ছে চেনার উপায়।
স্যার, আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন?
আমি রচনার লেখা একটা কবিতা আবৃত্তি করে রচনাকে শুনালাম,
“তোমাকেই আমি বাসিয়াছি ভালো, চারদিক করে আলো,
তোমাকেই আমি বাসিয়াছি ভালো ,শতদিক করে কালো।
তাই আমারে চিনতে পার না, আলো-আঁধারের মাঝে
ধরতে এলেও হয় না ধরা;
ভয়ে। নয় তো লাজে।”
তোমার অনেক কষ্ট, তাই না? কবিতা শেষ করে বললাম।
রচনা ম্লান হেসে বলল, একসময় কষ্ট ছিল। আপনাকে পেয়ে সব ভুলে গিয়েছিলাম। এখন আবার শুরু হয়েছে কষ্ট। ভয় লাগে স্যার।
কীসের ভয়?
আর কোনো ভয় নেই, ভয় শুধু হারাবার। স্যার, আপনি আমাকে কতটুকু চেনেন?
মেয়ে, অচেনার মাঝ দিয়ে আমাদের চলতে হবে। যাতে আগ্রহের ইতি না-ঘটে। সবকিছু চিনে নিলে আর চেনার কিছু থাকে না। আগ্রহ কমে যায়। আগ্রহ ভালোবাসার চেতনা। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা আছে, আগ্রহ নেই- এমনটি হাস্যকর।
রচনা তার মাথাটা আরও মমতায় আমার উপর ছেড়ে দিয়ে বলল, প্রেজেন্ট মানে কী?
উপহার, কিন্তু হঠাৎ এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন কেন?
গতকাল অতীত, আগামী কাল ভবিষ্যৎ, কিন্তু আজ একটা অনবদ্য উপহার। এজন্য বর্তমানকে বলা হয় প্রেজেন্ট। তাই না স্যার? আপনি সবসময় আমাদের বর্তমান। তাই আপনিই আমাদের উপহার।
আমার প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা না করে রচনা গুনগুন করে গাইতে শুরু করে
“আমার আকুল জীবন-মরণ
টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো
তোমার অতুল গৌরবে।
ভালোবেসে সখী— ”
গান শেষ করতে না-করতে রচনা আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। ঢাকার যানজট, অনেকক্ষণ থেমে আছি। তবু মনে হচ্ছে, এক সেকেন্ড। আমি ঘুমন্ত রচনার মাথায় এমনভাবে হাত বুলিয়ে যাচ্ছি যাতে তার ঘুম আরও গভীর হয় পরম নিবিড়ে।
এত যানজট কেন?
ড্রাইভার জানাল, নিউইয়র্ক থেকে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরছেন। দলের লোকজন তাকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে গেছেন। এজন্য পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের আরও অনেকক্ষণ থেমে থাকতে হবে।
আমি মনে মনে বললাম, এই যানজট যেন লাখ বছরেও শেষ না হয়।
“স্যার”, ড্রাইভার বললেন, “যারা সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করেন, তারাই সাধারণ মানুষের কষ্টের কারণ। যারা অবিচার রোধের দায়িত্বে আছেন তারাই অবিচারের হোতা। জানি না কতক্ষণ থেমে থাকতে হবে।”
আমি মনে মনে বললাম, থাক, থেমে থাক। কিছু কিছু থেমে থাকা, কেবল থেমে থাকা নয়, মহাগতিবেগ পাওয়া গতিহীন অনুভূতি। এমন অনুভূতি জীবনের অতুলনীয় প্রাপ্তি।


শুবাচ গ্রুপের লিংক: www.draminbd.com
তিনে দুয়ে দশ: শেষ পর্ব ও সমগ্র শুবাচ লিংক
Language
error: Content is protected !!