ড. মোহাম্মদ আমীন
নতুন কর্মস্থল। হাতে লেখা যোগদানপত্রটা হাতে নিয়ে বস হাত নেড়ে বললেন, সিট ডাউন।
বসের মুখে সিগারেট, চোখ আমার যোগদানপত্রে। চওড়া কপালে উপচে পড়া ব্যক্তিত্ব দুই-একটা সাদা-কালো চুলের ছোঁয়ায় আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বসার ঢংও তাঁর অনাবিল, সমীহ আনে মনে। ঘিয়ে রঙের জামার উপর ধূসর ব্লেজারটা খুশিতে অনুপম। ভাগ্যবান ব্লেজার।
: তুমি একদম নতুন। এত বড়ো প্রকল্প চালিয়ে নিতে পারবে তো?
: ভুল হলে শুধরে দেবেন স্যার।
: নেশা-টেশা কর?
অপ্রত্যাশিত প্রশ্নের ধাক্কাটা বুকে লাগার আগেই সামলে নিলাম, না স্যার।
: নেশা কী?
: নেশা থেকে নিশা এবং নিশা থেকে নেশা। নিশা যাকে গিলে ফেলে, মানে নিশার মতো অন্ধকার জগতে টেনে নিয়ে যায় সেটাই নেশা।
: তোমাকে বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে। বাড়ি কোথায়?
: চট্টগ্রাম।
: এডিকশন খারাপ জিনিস, দেখো, সিগারেটের নেশা কী করেছে আমাকে। গ্যাস চেম্বার বানিয়ে দিয়েছে আমার কক্ষটাকে। বাই দা বাই— ডু ইউ স্মোক?
: আই ডোন্ট লাইক স্মোকিং।
: ডু ইউ স্মোক?
: স্মোকিং ইজ ইনজুরিয়াস টু হেলথ।
: সিগারেটের প্যাকেটে কী লেখা আছে তা জানতে চাইনি। আমি জানতে চাইছি ধূমপানের অভ্যাস আছে কি না। বিব্রতকর প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হলেও হরদম করা উচিত নয়। বিশেষ করে বসের কাছে। একজন এ.ও (প্রশাসনিক কর্মকর্তা) নিয়োগ দিচ্ছি। এ বিষয়ে কিছু জানো?
অফিসে পা দিয়েই জুনিয়র অফিসার, আদিলের কাছ থেকে অফিস সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা নিয়েছিলাম। বসের হাতে যোগদানপত্র দেওয়ার আগে কিছু জেনে নিলে ভালো ফলই আসে। এক অবসরপ্রাপ্ত সচিবই আমাকে বিষয়টা বলেছিলেন।
বললাম, আগামী পরশু সকাল নয়টায় নিয়োগ পরীক্ষা। সাতশ চৌত্রিশ জন আবেদন করেছে। লিখিত পরীক্ষা হবে একশ নম্বরের, দশ নম্বরের ভাইভা। মিনিমাম পাশ মার্ক চল্লিশ। আপনি নিজেই ভাইভা নেবেন।
: যোগদানের আগে অনেক কিছু জেনে নিয়েছ। আমি এমন একজন অফিসার চাইছিলাম। তোমার যোগদানপত্র গ্রহণে আমার আপত্তি নেই। তোমার আগে চার জনকে বিদায় করেছি। সবাই তোমার অনেক সিনিয়র ছিলেন। আমার চাই কাজ, সিনিয়র-জুনিয়র দিয়ে কী করব।
: থ্যাংক ইউ স্যার।
: বাই দা বাই, এ.ও পোস্টটি গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ, অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা— সবই তোমার হয়ে তাকে সামলাতে হবে। তাই চৌকশ, বুদ্ধিমান এবং ইংরেজি-বাংলা উভয় ভাষায় দক্ষ কাউকে নিয়োগ দিতে হবে। প্রশ্নপত্র ওভাবেই করা হয়েছে। ইফাদের চাকরি, সুযোগ-সুবিধা আর অভিজ্ঞতার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা— সব মিলে চাকরিটা খারাপ নয়, বেশ ভালো। ভালো বেতন। পদটি ছোটো হলেও দামি। গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প, খুব মন দিয়ে কাজ করবে— এমন লোক নিয়োগ দিতে হবে।
: আমি চেষ্টার ত্রুটি করব না, স্যার।
বসের নাম আবদুল হামিদ খান। তিনি একজন জাঁদরেল সিএসপি। সাড়ে ছয় ফুট উঁচু, ধবধবে ফরসা— দেখলে মনে হয় পৌরাণিক কাহিনির মহাদেব। চোখে বুদ্ধির দাপট, কলমে জ্ঞানের। প্রেসিডেন্ট এরশাদ পর্যন্ত খান স্যারকে সমীহ করতেন। প্রেসিডেন্ট এরশাদ আর খান স্যারকে নিয়ে একটা গল্প প্রচলিত আছে। অনেকের মুখে গল্পটি শুনেছি—
খান স্যার সারাক্ষণ সিগারেট টানতেন; একটার পর একটা নয়, একটা শেষ হওয়ার আগে আর একটা। তাঁকে সিগারেট ছাড়া কেউ দেখেনি। মাঝে মাঝে দুহাতে দুটো। জ্বালান আর টানেন। ক্যাবিনেট মিটিঙেও লুকিয়ে লুুকিয়ে সিগারেট টানতেন। একদিন প্রেসিডেন্ট এরশাদ ক্যাবিনেট সভায় ঢুকে দেখেন—আবদুল হামিদ খান সাহেবের মুখে সিগারেট। রুষ্ট হলেন প্রেসিডেন্ট। তিনি খান সাহেবকে মিটিং রুম হতে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।
খান সাহেব বের হয়ে যেতে যেতে বললেন, ইয়োর অনার, অ্যাজ ইউ উইস।
প্রেসিডেন্ট বললেন, মিটিঙে সিগারেট না-টেনে থাকতে পারলে আসবেন, নইলে আসবেন না।
আবদুল হামিদ খান ছাড়াই ক্যাবিনেট মিটিং শেষ হয়ে গেল। মিটিঙের পর কার্যবিবরণ লিখতে হয়। তারপর সরকার প্রধানের সই। সভার কার্যবিবরণ লিখে প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষরের জন্য উপস্থাপন করা হলো।
কার্যবিবরণ পড়ে প্রেসিডেন্ট ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, এটি সেল্ফ অ্যাক্সপ্ল্যানেটরি হয়নি। আগে যেভাবে লেখা হতো সেভাবে লিখে আনতে বলুন।
: আপনার পছন্দের রেজুলেশন লিখতেন আবদুল হামিদ খান। তিনি মিটিঙে ছিলেন না।
: ওহো হো, তাঁকে তো আমি বের করে দিয়েছিলাম।
: ইয়েস স্যার।
পরের মাসের ক্যাবিনেট সভাতেও আবদুল হামিদ খান নেই।
খান সাহেব কোথায়? প্রেসিডেন্ট জানতে চাইলেন।
সচিব বললেন, তিনি ধূমপান ছাড়া থাকতে পারেন না।
প্রেসিডেন্ট বললেন, তাকে ডাকুন।
পাশের রুমেই ছিলেন খান স্যার। তলব পেয়ে মিটিং রুমে ঢুকে প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ করে বললেন, মহামান্য, ক্যাবিনেট মিটিঙে ধূমপান করা উচিত নয়।
প্রেসিডেন্ট হাসি দিয়ে বললেন, আপনিই তাহলে জিতলেন, আমাকেও জেতালেন।
এই সেই জাঁদরেল অফিসার আবদুল হামিদ খান।
চাকরিতে যোগদানের তিন মাসের মাথায় জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইফাদ-এর এই প্রকল্পে আমার বদলি হয়। প্রকল্পের নাম ‘ঘূর্ণি উপদ্রুত পরিবারবর্গের জন্য সাহায্য প্রকল্প’। আনোয়ারা, বাঁশখালী, কুতুবদিয়া ও চকরিয়া প্রকল্প এলাকা। উনিশশ একানব্বই সালের ঘূর্ণিঝড়ে এই চারটি উপজেলা লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল।
যোগ্যতার গুণে বদলি হওয়ার নজির বাংলাদেশে খুব একটা দেখা যায় না। এসব প্রকল্পে বদলির ক্ষেত্রে সাধারণত তদবিরই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তাই
যোগ্যতা প্রায় সময় আড়ালে থেকে যায়। আমার ক্ষেত্রেও একই বিষয় ঘটেনি— এমন বলতে পারব না।

আমার চাচা, মানে পড়শি চাচা মানে উপজেলাতো চাচা বদলিতে সাহায্য করেছেন। তিনি বিরাট মন্ত্রী, তিন জনের একজন ছিলেন তখন। আমি তাঁর ভোটার। আমাদের দয়ার ভোটে তিনি মন্ত্রী এবং তাঁর দয়ার তদবিরে আমার বদলি। এসব প্রকল্পে বদলি হওয়ার প্রতিযোগিতা অনেক অফিসারদের মনে লোভের জন্ম দেয়। লোভ দুষ্ট প্রতিযোগিতার ইন্ধন।
খান স্যার বললেন, প্রকল্পে এলে কেন?
: আমার হোম ডিস্ট্রিক্ট চট্টগ্রাম, প্রকল্পের অফিসও চট্টগ্রামে, তাই মায়ের কাছাকাছি থাকা যাবে। তাছাড়া সার্বক্ষণিক গাড়ি, ডেপুটেশন অ্যালাউন্স, ফরেন ট্যুর প্রভৃতি সুযোগ রয়েছে। কাজের অবসরে পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার মজা অন্য রকম।
খান স্যার একটা সিগারেটের শেষাংশ ছাইদানিতে ফেলে দেওয়ার আগে আর একটা জ্বলাতে জ্বলাতে বললেন, আর কিছু?
: এলাকার মানুষের উপকার করতে পারব।
: ভবিষ্যতে রাজনীতি করার, মানে এমপিগিরি করার পথ ক্লিয়ার করতে চাও, তাই না?
: স্যার, এভাবে কখনো ভাবিনি।
: ইদানীং অনেক অফিসার চাকরি শেষে এমপি হয়ে যাচ্ছে, তারপর মন্ত্রী।
: স্যার, আমার রাজনীতি ভালো লাগে না।
: এমপি-মন্ত্রী হতে হলে রাজনীতি করতে হবে, একথা তোমাকে কে বলেছে।
: স্যার।
খান স্যার বললেন, ব্যক্তিগতভাবে একজন রাজনীতিকের প্রত্যাশা শুধু হতাশায় গিয়ে শেষ হয়। শেষ পর্যন্ত হতাশাগ্রস্ত হননি, পৃথিবীতে এমন কোনো রাজনীতিবিদ নেই। চাকরিজীবী মন্ত্রীদের পরিণতি হয় আরও ভয়াবহ।
———————-