Warning: Constant DISALLOW_FILE_MODS already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 102

Warning: Constant DISALLOW_FILE_EDIT already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 103
স্যমন্তক: বিংশ পর্ব – Dr. Mohammed Amin

স্যমন্তক: বিংশ পর্ব

 

ড. মোহাম্মদ আমীন
স্যমন্তক বিংশ পর্ব
টুটুল আপাতত বাসায় পড়বে। ভালোভাবে কথা বলতে পারে না, কিন্তু লেখা দেখলে মনে হয় হস্তাক্ষর-প্রশিক্ষক। একবার দেখে যে-কোনো কিছু আঁকতে পারে অনেকটা অবিকল। রাকুর কাছে জানা গেল— বাবাই শিখিয়েছেন।
আল্পনা-কল্পনা ভিকারুন্নেসায় ভর্তি হয়েছে। আমার ঢাকা-চট্টগ্রাম ঘোড়দৌড়। মাঝে মাঝে আবার দেশের বাইরেও যেতে হয়। দাপ্তরিক ব্যস্ততার কারণে

স্যমন্তক, পুথিনিলয়।

তাদের ভর্তির বিষয়ে প্রত্যক্ষ সময় দেওয়া সম্ভব ছিল না। কবি ও সাংবাদিক অরুণাভ সরকারকে অনুরোধ করেছিলাম— যতটুকু সম্ভব ভর্তির বিষয়ে সহায়তা করার। কিছু টাকাও দিলাম তাঁর হাতে— টাকা নয়, উদ্দীপক-বটিকা। টাকা পেলে তিনি আশাতীত আন্তরিকতা দেখান। বেচারা সর্বদা অভাবে থাকেন। দৈনিক পত্রিকায় চাকুরি করে যে বেতন পান তা মাসের পনের তারিখের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। বাকি পনের দিন চলে ধারকর্জে।প্রায় সময় ছুটে আসেন আমার কাছে, কিছু টাকা দেন, গলাটা যে ভেজাতে হয়!
অরুণাভ সরকার ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই চিন্তা করতে হয়নি। আমার অবর্তমানে রাকুদের স্থানীয় অভিভাবক আহমদ ছফা। যদিও তিনি আস্থা রাখার মতো অভিভাবক নন। নিজের কাজ নিজে করতে পারেন না, কখন কী বলেন না বলেন ঠিক থাকে না। দশটা কথায় নয়টার ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। মেয়ে দেখলে একতরফা বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে পড়েন, কখনো বাম আবার কখনো ডান। এমন লোকের ওপর আস্থা রাখার আস্থা ভীষণ নড়বড়ে হয়।
এত বড়ো স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়ে আল্পনা-কল্পনার খুশির শেষ নেই। আমিও খুশি। বস্তি হতে এসে প্রথম চেষ্টাতে বাজিমাত করে দিয়েছে দুই সাবেক বস্তিনী। একদম রাকুর মতো প্রতিভা। স্কুলের পরিবেশ দেখে আল্পনা অবাক, কল্পনা হতবাক। সারা অঙ্গ দিয়ে খুশির গৌরব ঝরে ঝরে পড়ছে। আমি এলে তাদের মাথায় যেন খুশির আকাশ ভেঙে পড়ে। সব রুটিন আকাশের চাপে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
প্রথম দিন স্কুল থেকে এসে বলেছিল, এত সুন্দর স্কুল!
কেমন?
কত্তো বড়ো?
তারপর?
সবাই পরির মতো। কারও গায়ে ছেড়া জামা নেই। সবাই রাজকন্যা। ছবির মতো পোশাক। আমাদেরও কি এমন জামা হবে?
হবে।
দুদিনের মধ্যে তাদের গায়ে রাজকন্যার জামা চড়ল।
স্কুল থেকে এসে কয়েকদিন শুধু সালামের পর সালাম দিয়েছে— পায়ে, হাতে, মুখে; যেখানে ইচ্ছে সেখানে। সারা শরীর হামিতে হামিতে ভরিয়ে দিয়েছে অকুণ্ঠ হাসিতে। আমি হতবাক হয়ে তাদের হামি উপভোগ করেছি অভূতপূর্ব আনন্দে। জীবন এত সুন্দর হতে পারে, এত স্নিগ্ধ? এত প্রশান্তির? অন্যের জন্য সামান্য করলে এত অসামান্য পাওয়া যায়? একেই কি বলা হয় একে লাখ! তাহলে মানুষ কেন এমন করে না? অথচ কয়েকটা কাগুজে নোটের জন্য রাস্তার কুকুরের মতো আজীবন ঘেউ ঘেউ করে বেড়ায় বিল গেটস-টাটারা।
স্কুলে প্রথম কয়েক মাস মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়েছিল তাদের।  মানুষের চেয়ে এত অধিক অভিযোজন-সক্ষম প্রাণী পৃথিবীতে আর নেই। তাই সে শ্রেষ্ঠ, তাই সে নিকৃষ্ট— তাই তার এত বিস্তার-প্রসার; অশান্তি-হাহাকার।
রাকু এখনো কোথাও ভর্তি হয়নি। তাকে নিয়ে আমার একটা পরিকল্পনা আছে। এত ভালো রেজাল্ট— যেখানে ইচ্ছে সেখানে ভর্তি হতে পারবে। খান স্যারের পছন্দ মেডিক্যাল কলেজ। তাঁর পছন্দে আমার দ্বিমত নেই। তিনিই আমাদের নির্দেশক।
আগে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলে সার্কিট হাউজে বা সুবিধাজনক কোনো সরকারি রেস্ট হাউজে উঠতাম। এখন উঠি রাকুর বাসায়। রেস্ট হাউজে এত

অরুণাভ সরকার

বিশ্রামপ্রার্থী যে, বিশ্রাম নিরানন্দের হয়ে যায়। রেস্ট হাউজে প্রচুর আপ্যায়ন আছে, কিন্তু এক ফোঁটা আদর নেই। খাবারে জৌলুশ আছে, কিন্তু তৃপ্তি নেই, সংখ্যায় ভিন্নতা আছে কিন্তু বৈচিত্র্য নেই, হাসি আছে মমতা নেই। রাকুর বাসায় তিন পিচ্চির কোলাহলে  আরাম তেমন বিশ্রামের সুযোগ পায় না। তাই বিশ্রামের আগ্রহ প্রবল স্বাদে সবল হয়ে ওঠে। বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ যত কম হয়, বিশ্রাম তত প্রত্যাশার হয়ে ওঠে।
রাকুকে বললাম, ভর্তি হয়ে যাও।
কোথায় ভর্তি হব, স্যার? প্রশ্ন করল রাকু।
: যেকোনো ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির যোগ্যতা তোমার আছে। জীবনের প্রথম চাকরি-পরীক্ষায় প্রথম হয়েছ। একজন ইন্টারমিডিয়েট পাশ মেয়ে হারিয়ে দিয়েছ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী প্রায় হাজার খানেক প্রতিযোগীকে। মেডিক্যাল বা বুয়েট আমার পছন্দ। তবে খান স্যারের পছন্দ মেডিক্যাল। আগামী মাসে ফরম ছাড়বে। তোমাকে নিয়ে ফজলুল হক স্যারের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। প্রয়োজনে তাঁর সঙ্গে দেখা করবে। ছফা চাচার ওখানে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
: কোন ফজলুল হক?
: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের টিচার। তোমার ডায়ারিতে তাঁর ফোন নম্বর লেখা আছে। আহমদ ছফা তো আছেনই। তবে তিনি তোমাকে কোনো সহায়তা করতে পারবেন না, করবেনও না। নিয়মতান্ত্রিক সব বিষয়েই তাঁর অনাগ্রহ। সারাক্ষণ সারাদিক নিয়ে বিরক্তে থাকেন।
: স্যার, ম্যাডিক্যাল ও বুয়েট- দুটোর একটাও আমার পছন্দ না।
: কেন?
: ভালো লাগে না।
: কোথায় পড়বে।
: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
: কোন সাবজেক্ট ?
: বাংলা।
আমি হেসে ওঠলাম, কথায় বলে:
অভিশাপ দিলে আল্লাহ, 
বিষয় পায় সে বাংলা।
অভিশাপ দিল ঈশ্বর— হতভাগা তুই বাংলা পড়।

অভিশপ্ত বাংলা জ্ঞান, ণত্ব-ষত্বের ঘানি টান।
শোনো মেয়ে—যারা অন্য কোনো বিষয়ে ভর্তি হতে পারে না তারাই বাংলা পড়ে। তুমি নিশ্চয় মজা করছ।
: মজা নয়, স্যার। আপনার সঙ্গে মজা করার মতো বেয়াদব আমি নই। বাংলার সঙ্গে আমি মিশে আছি অবিচ্ছিন্ন সপথ শপথে।
: এত প্রেম বাংলায়, কেন?
: আমি লিঙ্গুয়িস্ট হব।
: লিঙ্গুয়িস্ট হতে হলে বাংলা পড়তে হবে— এমন বাধ্যবাধকতা নেই।
: অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষায় জেলায় প্রথম হয়েছিলাম। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল আমাদের শ্রমিক-বস্তির অখ্যাত স্কুল। কী উপহার নেব জানতে চাইলে রবীন্দ্র রচনাবলির কথা বলেছিলাম। জুটমিলের ম্যানেজার এক সেট রবীন্দ্র রচনাবলি দিয়েছিলেন। এটা নাকি কলকাতা থেকে আনিয়েছিলেন। এরপর পরীক্ষায় প্রথম হলে আমাকে বই উপহার দেওয়া হতো। থালাবাটি উপহার হিসেবে আমার পছন্দের ছিল না। যদিও আমি থালা-বাটির ভিক্ষুক ছিলাম। আগে ভাবতাম বস্তির বাসিন্দা বলে থালাবাটি উপহার দেওয়া হয়। কলেজে গিয়ে দেখি- ধনী লোকের ছেলেমেয়েদেরও থালাবাটি উপহার দেওয়া হচ্ছে। তার মানে তারা আমার চেয়েও কাঙাল। আচ্ছা স্যার, ওদের বাসায় কি থালাবাটির অভাব?
রাকুর অনেক বই। তার বহি-রেজিস্টার দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। উপহারে এত বই হওয়ার কথা নয়। সত্য বলতে কি, ওই বয়সে আমার কাছে তার দশ ভাগের এক ভাগ বইও ছিল না।
বললাম, এত বই তুমি কীভাবে সংগ্রহ করেছিলে?
: বস্তির বাচ্চাদের পড়িয়ে কিছু টাকা হলে বই কেনায় খরচ করতাম। পুরানো বইয়ের দোকান থেকে কিনে নিতাম। বাসায় এসে বাঁধই করতাম পোস্টার দিয়ে। আমার-না স্যার, কয়েকশ বই ছিল।
: তালিকায় তাই দেখলাম। এ দুরবস্থার মধ্যেও বইয়ের জন্য খরচ করতে?
: আমার কোনো মনুষ্যবন্ধু ছিল না। বই উত্তম সঙ্গী। মনের খাবার, জ্ঞান বাড়ায়, কষ্ট কমায়। কষ্ট যখন সহ্যের বাইরে চলে যেত তখন বই পড়ে কষ্টকে অক্ষরের ফাঁদে বেঁধে কষ্টমুক্ত হতাম। বেশি গরম পড়লেও বই পড়তাম, গরম আর লাগত না। বই কিনে কেউ দেউলিয়ে হয় না।
আমি হেসে বললাম, বই কিনে কেউ দেউলিয়ে হয় না তবে বই লিখে অনেকেই দেউলিয়ে হয়ে গেছে। এখন নতুন লেখকরা লেখক হওয়ার জন্য হরদম দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। প্রকাশকেরা টাকা ছাড়া বই করে না। চট্টলবিদ আবদুল হক চৌধুরীর কথা শোন-নি?
রাকু বলল, শুনেছি স্যার। লেখকরা দেউলিয়ে হয়ে পাঠকদের সমৃদ্ধ করে। তাই লেখক দেউলিয়ে হলেও পাঠক হয় না। মানব সভ্যতার নির্মাণে লেখকদের অবদানই সবচেয়ে বেশি। স্যার, বই বাদ দিলে মানুষের শ্রেষ্টত্বের আর কী থাকে?
: থাকবে না কেন?
পৃথিবীতে এমন অনেক প্রাণী আছে, যাদের বুদ্ধি মানুষের চেয়ে ঢের বেশি। কিন্তু মানুষের মতো সভ্য হতে পারেনি।
: কারণ কী?
: মানুষই কেবল তাদের অতীতকে বইয়ের মাধ্যমে বর্তমানের সঙ্গে সেতুবদ্ধ করে ভবিষ্যতেও প্রজন্মান্তরের যোগ্যতার অধিকারী। যার ফলে প্রত্যেকের একক এবং অতি খুদে খুদে জ্ঞানসমূহ একীভূত হয়ে জ্ঞানের হিমালয় গড়ে তুলেছে, প্রতিদিন বিশাল হচ্ছে জ্ঞানগিরি। এটাই স্যার মানব সভ্যতা এবং মানব জাতির শ্রেষ্ঠত্বের নিয়ামক। বইহীন মনুষ্যজ্ঞান শিয়ালের কাছেও ধরাশায়ী হয়ে যাবে।
: তোমার বাকি বইগুলো কোথায়?
: বাবার চিকিৎসার খরচ যোগাড়ের জন্য অনেকগুলো বই বিক্রি করে দিয়েছি। বাবা-মায়ের চেয়েও বইগুলোর কথা বেশি মনে পড়ে।
: কেন?
: অক্ষম শিশুরা একদিন সক্ষম হয়ে ওঠে। একসময় বাবা-মায়ের চাহিদাও শেষ হয়ে যায়। তারা বুড়ো হয়ে যায়, অথর্ব হয়ে যায়, বোঝা হয়ে পড়ে— মরে যায়। কিন্তু স্যার বইয়ের চাহিদা কখনো শেষ হয় না। একটা বই লাখ জনে পড়লেও একদম অবিকল, অবিভাজিত থেকে যায়। কী অদ্ভূত- তাই না, স্যার?
কথাগুলো বলে রাকু ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে আমার ওপর এলিয়ে পড়ল। এটা এখন তার স্বভাব, যখন ইচ্ছে এলিয়ে পড়ে, যখন ইচ্ছে জড়িয়ে ধরে। সে  এমন এলিয়ে পড়াকে আমাদের শরীরে বাতাসের এলিয়ে পড়া মনে করে।সে কাঁদছে— এত সহজ অথচ কঠিন কান্না  আর দেখিনি। তার চোখের জল যেন একটা চলমান জীবনের ছায়াছবি; গঞ্জের ভাঙাগড়ার বোধহীন ইতিহাস।
আমি চাইছিলাম রাকু মেডিকেল বা বুয়েট, না-হলে অর্থনীতি বা ইংরেজি বিষয় নিয়ে পড়ুক। বাংলা বলাতে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
বললাম, বাংলা পড়া ঠিক হবে না।
রাকু বলল, স্যার, মাতৃভাষা মায়ের মতো। মা মারা গেছেন, মাতৃভাষা এখনও আছে। উপযুক্ত যত্ন না-পেলে সেও মারা যেতে পারে। আমরাই তো তার সন্তান, আমাদেরই তাকে দেখতে হবে, শুশ্রূষা দিতে হবে। অনাদর অবহেলায় ভাষাটাও যদি মরে যায়— কাকে নিয়ে থাকব, স্যার? আমি কথা বলছি বাংলায় অথচ পুজো দিচ্ছি অন্য ভাষাকে, যে থালায় খাচ্ছি সে থালায় ঢালছি মল— এটি স্যার নিমকহারামের কাজ। তবে আপনার অবাধ্য হয়ে আমি বাংলা পড়ব না। আমি আমার ইচ্ছাটা ব্যক্ত করেছি। সিদ্ধান্ত আপনার। আপনাই সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
: তা হবে কেন?
: আপনার ইচ্ছাই আমার নিয়তি।
————————————————————
=============== অন্যান্য==================

ইদানীং ও ইদানীং-এর বিপরীতার্থক শব্দ

ফলজ অর্থ পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ

————————————————————
————————————————————–