প্রতিদিনের মতো ফোন করে রচনাকে জানিয়ে দিলাম বের হচ্ছি। সচিবালয়ে সাধারণত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অফিস থেকে বের হওয়া যায়। জেলা সদরে তা প্রাযশ সম্ভব হয় না। অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা রিকশায়। অন্য সহকর্মীর গাড়িতে করেও আসা যেত, কিন্তু কাউকে অনুরোধ করতে ভালো লাগে না। এ বিষয়ে আমি খুব অহংকারী। এজন্য অনেকে ওভার স্মার্ট হিসেবে ভুল বুঝেন। বিভাগীয় মামলার পর সহকর্মীদের মানসিকতার ওপর একটা প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয়েছে। খুব কম সহকর্মীকে সামসময়িক মনে হয়। মনে হয়— আমার আশেপাশের প্রায় সবাই আমার চেয়ে কয়েকশ বছর বড়ো; সতীদাহ কালের মানুষ। আমাকে দাহ করার জন্য সবাই উন্মুখ হয়ে আছে।
রিকশা চলা শুরু করতে না-করতে বৃষ্টি। যাকে বলা হয় মুষলধারে। কাকভেজা হয়ে রচনার বাসায় পৌঁছি, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে প্রায়। রচনা সদলবলে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে। সবার চেহারায় উৎকণ্ঠা— দেরি হচ্ছে তাই। আমাকে দেখে আনন্দে উল্লসিত হয়ে ওঠে সবাই। গাড়ির আওয়াজ ছাড়া আমার আগমন তাদের কাছে অস্বাভাবিক লাগছিল। এমন আগে কখনো ঘটেনি।
কী করছিলে সবাই? হাসি দিয়ে জানতে চাইলাম।
আল্পনা বলল, ভাইয়া, আপনি আসবেন তাই পুরো বিকেলটাকে সন্ধ্যার ভিতর বেঁধে রেখেছি। বিকেলের সে কী কান্না। তবু ছাড়িনি। এখন ছেড়ে দেব।
কল্পনা বলল, আপনি আসবেন তাই আমাদের খুশিকে বর্ষা করে আপনাকে এগিয়ে আনার জন্য সারা আকাশে ছড়িয়ে দিচ্ছিলাম। কারটা ভালো হলো?
রচনা উৎকণ্ঠার গলায় বলল, গাড়ি কই স্যার? মোস্তাক, সোহরাব?
গাড়ি ছাড়া আসার কথা নয়। সাধারণত একলাও আসি না। সঙ্গে মোস্তাক বা অন্য কোনো পিয়ন থাকে।
এভাবে গাড়ি ছাড়া ভিজে ভিজে একলা আসার কারণ কী?
“মোস্তাকের বউ অসুস্থ, আমি বললাম, “তাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য গাড়িটা ছেড়ে দিয়েছি। বলেছিলাম-না পোয়াতি। ভালো করেছি না?
রচনা মাথা মুছে দিতে দিতে বলল, ভালো করেছেন, কিন্তু নিজেকে বঞ্চিত করে আমার মতো ওদের-তাদের উপকার— শেষ পর্যন্ত কি পরিণতি ডেকে নিয়ে আসে তাই ভাবছি। মোস্তাকের বউকে দেখতে যাব। এই বৃষ্টি ভালো না। শরীরে পড়লে জ্বর আসে। আপনি পুরোটা ভিজে গেছেন।
কাপড়-চোপড় পালটাতে না-পালটাতে শরীরটা কেঁপে কেঁপে ম্যাজ ম্যাজ শুরু করে দিয়েছে। ভালো লাগছিল না কিছু। বুঝতে পারছিলাম শরীরের ওপর ধকল আসছে ভারি। রচনা বুঝে ফেলল— আপনার জ্বর আসতে পারে, স্যার।
মেয়েদের অনুমান পুরুষদের বাস্তবতার চেয়ে শক্তিশালী। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে এটাই দেখে আসছি। তাই আমি ছোটো হোক বড়ো হোক মেয়েদের কথা কখনো হেসে উড়িয়ে দিই না, গুরুত্ব সহকারে নিই।
রচনা কপালে হাত দিয়ে বলল, যা ভেবেছি তাই।
সবাই জোর করে একটা ডিম ও এক মগ দুধ পেটে ঢুকিয়ে দিল। ততক্ষণে শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। বিছানায় এনে চাদর জড়িয়ে শুয়ে দিল। “থার্মোমিটারটি নিয়ে আসি।” বলে বের হয়ে গেল রচনা। শরীরটা যন্ত্রণায় ছটফট করছে। জ্বরের বিতৃষ্ণার সঙ্গে আড্ডা মারতে না-পারার কষ্ট আরও নিস্তেজ করে দিয়েছে। এক মিনিটের মধ্যে রচনা ফিরে এল। বিছানায় বসে মাথায় হাত রাখল। হাত রেখেই চিৎকার, স্যার, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে আপনার!
জ্বর তাহলে আসছে? কথা কেঁপে কেঁপে ভেঙ্গে যাচ্ছিল।
থার্মোমিটার দেখে বলল, জ্বর আসছে নয় স্যার, এসে গেছে।
কত ডিগ্রি? ডাক্তার ডাকতে হবে? আমার গলায় উৎকণ্ঠা, কাল জরুরি মিটিং অফিসে। প্রধানমন্ত্রী আসবেন, ফাইল সব আমার হাতে। যদি যেতে না পারি তো ভীষণ ঝামেলা হয়ে যাবে।
আমি অর্ধেক ডাক্তার।
পুরো ডাক্তার হওয়ার জন্যই তো মেডিকেলে ভর্তি হতে বলেছিলাম। হলে না। হরে আজ আমার চিকিৎসা করতে পারতে। কে শোনে কার কথা।
এক বুড়ির বাসায় বুড়ির সেবকের কাজ করতাম না, স্যার?
বলেছিলে।
সেখানে এক ডাক্তারনি এসে বলতেন কী হলে কী করতে হবে।
রচনা আমার হাত টিপছে। আরাম লাগছিল বেশ। শরীর টিপলে মনটা আমার ঝিমিয়ে পড়ে আনন্দে। ফিসফিস করে রচনাকে বললাম, আর একটু জোরে দাও মেয়ে, আর একটু।
স্যার, এ জ্বরটা-না খুব খারাপ।
তাই?
এটি যাওয়ার জন্য আসে না।
কে বলেছে?
ডাক্তার।
ওষুধ নেই?
নেই।
কী!
ভয় পাবেন না, স্যার। পুরো শরীর ম্যাসেজ করে দিতে হয়। তারপরও যদি না যায় তাহলে জোরে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে হয়। শরীরে-শরীরে উষ্ণ মমতার মাখামাখিতে শিষ্ট-পুষ্টতায় দুষ্ট জ্বর টিকতে পারে না। পালিয়ে যায়।
রচনার কথায় মনে পড়ে গেল অনেক আগের একটি ঘটনা। এইচএসসি ইংরেজি পরীক্ষার দ্বিতীয় দিন সকালে হঠাৎ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল। মায়ের কী কান্না, তার ছেলে বুঝি আর পরীক্ষা দিতে পারবে না। বেগমা ফুপু এসে এমনভাবে শরীর ম্যাসেজ করে দিলেন- পাঁচ মিনিটের মধ্যে জ্বর হাওয়া।
এসব তোমাকে কে বলেছে? রচনাকে প্রশ্ন করলাম।
ডাক্তার নুরজাহান ভূঁইয়া।
কোথায় পেয়েছ তাঁকে?
বুড়িকে একদিন দেখতে এসে আমাকে এসব শিখিয়ে দিয়েছেন। তিনি বুড়ির আত্মীয়া। বুড়ির জ্বর উঠলে আমি শরীর টিপে দিতাম। জ্বর চলে যেত। না-গেলে বুড়ির বুকে বুক লাগিয়ে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতাম। জ্বর বাপ বাপ করে পালাত।
আমি হেসে বললাম, জ্বর তোমাকে বাপ ডাকত?
স্যার, ঠ্যালার নামই তো বাবাজি।
রচনা শরীর টিপে যাচ্ছে। জ্বরের ঘোরে আমি গান গেয়ে চলছি
যদি তারে নাই চিনি গো সে কি,
সে কি আমায় নেবে চিনে
এই নব ফাল্গুনের দিনে। …
স্যার?
মেয়ে আমার, কিছু বলবে?
আপনি আমাকে মেয়ে ডাকেন কেন?
কী ডাকব? তুমি আমার মেয়ে, মা জগজ্জননী, দুর্গতিনাশিনী, শান্তিদায়িনী, মহামায়া। অসুখে এমন মমতায় মমতায়, মেয়ে আর মা ছাড়া কে সেবা দেবে? “বধূ কোন আলো লাগল চোখে।”
স্যার, খুব খারাপ লাগছে আপনার?
আরে না- আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে …।
স্যার, আপনার জ্বর কমছে না, বেড়ে যাচ্ছে।
কীভাবে বুঝলে?
জ্বর, ভারি নষ্ট বিষয়। আসার সময় পোনার ঝাঁকের মতো অনেক গান-কথা আর প্রলাপ নিয়ে আসে। প্রলাপের মতো গান বকে যাচ্ছেন। যতবার জ্বর এসেছে ততবার দেখেছি এমন কাণ্ড ঘটিয়েছেন। আমরা সবাই ভয় পেয়ে যাই।
আচ্ছা, আমি যদি এই জ্বরে মরে যাই?
কষ্ট পাব কিছুদিন, কিছু হবে না-তারপর সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। মানুষ সব ভুলে যায়, ভুলে যেতে পারে- সে তো আর হাতি না।
আমার তো মনে হয় জ্বর কমে গেছে।
না স্যার, বেড়ে যাচ্ছে। জ্বর বাড়ছে বলে গানও বাড়ছে।
এখন উপায়?
পরের ধাপে যেতে হবে স্যার, আমি কী বলছি আপনি বুঝতে পেরেছেন?
আমি বুঝতে না-পারলেও বললাম, বুঝতে পেরেছি।
কী বুঝতে পেরেছেন?
তোমার শ্যামলা গালে রূপের কোলাকুলি,
মেয়ে, গড়িয়ে পড়ে গভীর মায়ায় নরম গোধূলি।
স্যার, একটু শান্ত হোন।
ত্রিশটি বসন্ত আমি শীতের চিল্লায় কাটিয়েছি, আজকের দিনটির জন্য। শান্ত হতে বল? এখন যাও, যাও বলছি। কাউকে লাগবে না। মা, মাগো তুমি কোথায়? আমাকে নিয়ে যাও, তুমি কোথায় মা?
রচনা আমার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে, আপনি এমন করছেন কেন স্যার? খুব কী কষ্ট হচ্ছে? স্যার অ স্যার?
মা, মাগো তুমি কোথায়?
রচনা আমাকে মৃদ ধাক্কা দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, এই তো আমি এখানে।
মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব। মাকে এখন নিয়মিত ফোন করা হয় না। বন্ধুদের অভিযোগ-আমি বিবাহিতের মতো যোগাযোগ-ম্যানিয়ায় ভুগছি। রচনা আমার অনেক অভ্যেস পালটে দিয়েছে।
স্যার, আপনার চোখে জল!
জল নয়, বৃষ্টি। গ্রীষ্মের পর শীত এলে কী হতো?
প্রকৃতির ইচ্ছেকে কেউ থামাতে পারে না। মেনে নিতে হতো, আমরাও অভ্যস্ত হয়ে উঠতাম। তাই না স্যার?
মেয়ে তুমি যাও, আমি ঘুমাব, একটু কাঁদব, একটু স্বপ্ন দেখব …।
এমন জ্বরে আপনাকে ছেড়ে কোত্থাও যাব না।
রচনা আমাকে দুই বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরে মুখোমুখি শুয়ে পড়ল। আর এক পাশে কল্পনা, পায়ে উপুর হয়ে শুয়ে আছে আল্পনা। আমার কপোল-কপালে সুড়সুড়ে চুমো দিয়ে যাচ্ছে রচনার রাশি রাশি চুল।
উষ্ণতার আলাদা আমেজ আছে। আমার সব প্রলাপসংগীত মুখ থেকে বুকে ঢুকে হৃদয়ের চারপাশে ইচ্ছেমতো গুনগুন করতে করতে স্মৃতিহীন শব্দে বোবা হয়ে গেল।
তারপর এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি।
বুঝতে পারি জ্বর চলে গেছে। আর কিছু মনে নেই।
ইদানীং ও ইদানীং-এর বিপরীতার্থক শব্দ