ছফা বাঁশি বাজাচ্ছিলেন আর কিছুক্ষণ পরপর কাশছিলেন। সামনে হারমোনিয়ামও আছে— ক্ষণে বাঁশি আবার পরক্ষণে হারমোনিয়াম। আসলে তিনি

হারমোনিয়াম ও বাঁশি কোনোটাই সুর তুলে বাজাতে পারেন না, ইচ্ছেমতো বাঁশিতে ফুঁ দেন এবং হারমোনিয়ামের বেলো টানেন। তবু তাঁর বাজনায় এমন সুর উঠত যেন, ছফার এই বেসুরের জন্যই যন্ত্র-দুটির পয়দা হয়েছে। যদিও কিছুক্ষণ থাকলে কান চেপে ধরা ছাড়া কোনো উপায় থাকত না। ভাগ্যিস বেশিক্ষণ করতেন না।
আমাদের দেখে উঠে আসতে আসতে বললেন, ওয়াল্লাহ, তোমরা এ সময়! ইদ্রিসটা বাইরে, মেয়েটাকে নিয়ে এসেছ, কী খেতে দেই বলো তো?
আমি বললাম, তাহলে চলে যাই?
বে আক্কেলের মতো কথা বলো না।
রচনা বলল, চাচা, আপনি বসুন। যা দরকার আমরা করে নেব, যা প্রয়োজন হয় তা আনিয়ে নেব।
ছফা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখো, ভদ্রতা কাকে বলে, শেখো আদব কাকে বলে। কবীর চৌধুরী তোমার এ মেয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এমন ব্রিলিয়ান্ট তার চোখে নাকি আর পড়েনি। তার অনুবাদ কাজে বেশ সাহায্য করে না কি?
তাই তো দেখি। আমার সময়গুলো সব অনুবাদে দিয়ে দেয়। আমি কিছু পাই না।
টাকাটুকা কিছু দেয়, নাকি মাগনা করিয়ে নেয়? প্রকাশকদের কাছে ঠকতে ঠকতে প্রকাশক দেখলেই কেবল ঠকার কথা মনে পড়ে।
রচনা বলল, দেন।
কী খাবে বলো?
আমি বললাম, কিছুই খাব না।
তোমার কাছে কে জানতে চাইছে, রচনা-মা তুমি বলো।
রচনা হাসল।
আহমদ ছফা আমার হাত থেকে মেহমান-পুঁটলিটা নিতে নিতে বললেন, তোমরা দেখি অনেক কিছু এনেছ। চা খাও। তোমার চাচা সারাদিনই চা খায়। চায়ের সঙ্গে সিগারেট। উভয়ের মিলন বড়ো রঙময়। চায়ের ধোঁয়ার সঙ্গে সিগারেটের ধোঁয়ার মিলন প্রতিবারই প্রথম প্রেমের মতো হৃদয়কাড়া।
কথা শেষ করার আগে আবার কাশতে শুরু করলেন। রচনা এগিয়ে ছফার বুকে হাত দিয়ে বলল, চাচা, আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন?
ওয়াল্লাহ তুমি জানো না— আমাদের বংশের সবাই অ্যাজমা রোগী। কাশতে কাশতে মরে। কাশতে কাশতে বাঁচে। আমিও এভাবে মরব। যতদিন বাঁচি এভাবে কাশির মাঝেই বেঁচে থাকব।
সামনেই ছিল চায়ের কেটলি। ছফা কাপে চা ঢালতে ঢালতে বললেন, ‘সূর্য তুমি সাথী’ নিয়ে একটা সিনেমা হচ্ছে। রচনা-মা, তুমি অভিনয় করবে?
রচনা হেসে বলল, আমি তো চাচা অভিনয় জানি না।
তাহলে সংসার করবে কীভাবে? অভিনয় ছাড়া সংসার করা যায় না। আমি অভিনয় জানি না বলে সংসারে ঢুকিনি। গান জান?
জানি।
নাচতে পার? ছফা যেন সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন।
না।
ছফা নাছোড়বান্দা, তাহলে একটা গান কর। আমি হারমোনিয়াম বাজাই।
রচনা গান শুরু করে—
“হে মোর দেবতা, ভরিয়া এ দেহ প্রাণ
কী অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান।
আমার নয়নে তোমার বিশ্বছবি
দেখিয়া লইতে সাধ যায় তব কবি – – -।”
হারমোনিয়া বাজাচ্ছেন ছফা, সুর হচ্ছে না। গানের সুর কেটে যাচ্ছে রচনার। হারমোনিয়াম বন্ধ করে ছফা বললেন, কে তোমার দেবতা?
রচনা কিছু বলল না। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। তার হাসিতে প্রাণ, দৃষ্টিতে নীরব আকুতি। সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে ছফা বললেন, আশীর্বাদ করি, তোমাদের দিনগুলো যেন রাতের অপেক্ষায় আর রাতগুলো যেন দিনের অপেক্ষায় না-থাকে। অপেক্ষা বড়ো কঠিনরে মা, নিকোটিনের আখড়া।
আশীর্বাদ করুন, যেন ঈশ্ব রের নিবিড় সান্নিধ্য আমরণ পাই।
ঈশ্বর কী জান?
রচনা বলল, আমার ঈশ্বর একটি শ্রদ্ধা, একটি ভালোবাসা এবং এ দুটোর প্রগাঢ় মিলনে পূর্ণ একজন মানুষ। আমার ঈশ্বর কায়াহীন নয় বলে ছায়া দিতে পারে, ছোঁয়া যায় বলে নোয়া যায়। তিনি মানবেশ্বর, মানুষের চেয়ে বড়ো ঈশ্বর কে হতে পারে?
“তেমনি মানুষের চেয়ে বড়ো শয়তানও কেউ হতে পারে না”, ছফা হেসে বললেন, প্রেম কর?
লজ্জা-হাসি বিলিয়ে রচনা বলল, করি।
কার সঙ্গে?
রচনা চুপ করে আছে। আমি বললাম, চুপ করে আছ কেন? উত্তর দাও।
রচনা বলল, জীবে প্রেম করে যেজন তাতেই আমার প্রেম, আমাকে যে ভালোবাসে সে-ই আমার ভালোবাসা। আমার প্রেম আমার ঈশ্বর।
ছফা বলল, কে তোমাকে ভালোবাসে?
ঈশ্বর।
তাহলে তুমি মরেছ।
মরেছি বলেই আমি ভয়হীন, নিঃশঙ্কায় কাটে আমার রাত, আমার দিন।
আমি বললাম, ইদানীং সে বেশি কথা বলা শুরু করেছে।
ছফা বললেন, সে সাহিত্যের ছাত্রী, তার কথা বলার যোগ্যতা আছে। বলতে হলে জানতে হয়। তুমি বিজ্ঞানের ছাত্র, তোমার সে যোগ্যতা নেই। তোমরা কি কচুটা জানো, খালি পটর পটর করো। আমলাদের জ্ঞান শুধু ফাইলে। এর বাইরে তারা গোমূর্খ।
রচনা বলল, চাচা, স্যার-না আমাকে ঘৃণা করেন।
কেন?
আমি বস্তির মেয়ে, গেঁয়ো, চামড়া কালো, ঠোঁট মোটা, আপনাদের মতো শিক্ষিত পরিবারের নই, তাই।
আমি বললাম, মিথ্যার একটা সীমা থাকা উচিত।
ছফা বললেন, থাম তোমরা। কথা শুনে মনে হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী। হাফিজ কিন্তু গেঁয়ো মেয়ের জন্যই জীবন ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন। গেঁয়ো মেয়েতেই তিনি পেয়েছিলেন তার সুধাসপ্তক—
“দাও মোরে ঐ গেঁয়ো মেয়ের
তৈরি খাঁটি মদ পুরানা।
তাই পিয়ে আজ গুটিয়ে ফেলি
জীবনের এই গালচে খানা।”
একটু থেমে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ওয়াল্লাহ, চা তো হাফিজের মদের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে। মদ এ মুহূর্তে পাব না, দামও অনেক।
আমি বললাম, আপনার বই তো ভালো চলে।
প্রকাশকগণ আমার বই নিয়ে বিল্ডিং বানায়, দামি গাড়ি হাঁকায়, বিদেশ ঘুরে বেড়ায়। আর আমি এক গ্লাস জল কেনার পয়সাও পাই না। মদ-বদ বাদ দাও, বদলে এক কাপ চা বানিয়ে দিতে পার মা?
রচনা রান্নাঘর হতে চা বানিয়ে আনল। ছফা চুমুক দিয়ে বলল, খাসা হয়েছে। গরম চা যৌবনের মতো ঊষ্ণ। বনমালীর কৃষ্ণ।
রচনা বলল, একটা গান করেন চাচা।
বলামাত্র ছফা গাইতে শুরু করেন—
“ঘর করলাম নারে আমি
সংসার করলাম না
আউল বাউল ফকির সেজে
আমি কোনো ভেক নিলাম না।”
গান শেষ হওয়ার পরও কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকি। কান মিষ্টি আমেজে ঝাঁঝাঁ করছে, যদিও এক ফোঁটা সুর ছিল না। তবু সারা বিশ্ব যেন ছফার গানের নিনাদিত রসে ব্যাকুল হয়ে আছে। কিছুক্ষণ সবাই চুপ।
আমি নীরবতা ভেঙে বললাম, চাচা, উঠি?
দুপুরে খেয়ে যাবে। ডাল হবে টক দিয়ে, ঠকবে না মনে রেখ।
আমি বললাম, তাহলে ততক্ষণ গান হোক।
ছফা বললেন, মা একটা গান কর। ইদ্রিস ততক্ষণে চলে আসবে।
রচনা গাইতে শুরু করে,
“পথ চলিতে যদি চকিতে কভু দেখা হয়, পরান-প্রিয়!
চাহিতে যেমন আগের দিনে তেমনি মদির চোখে চাহিও।”
গান শেষ হওয়ার পর ছফা একদম শিশুর মতো উচ্ছলতায় প্রচণ্ড শক্তিতে তালি বাজাতে শুরু করলেন। আমি বিমোহিত চোখে ছফার সহজ-সরল আনন্দমাখা মুখের দিকে চেয়ে থাকি। ছফা আরও শিশু হয়ে গেলেন গানে গানে— এমন সারল্য কোটিতেও দেখা যায় না।
তালি শেষ করে ছফা বললেন, তুমি না কি মা ব্রিটিশ কাউন্সিলের ইংরেজি ভাষা প্রতিযোগিতায় পুরো উপমহাদেশে প্রথম হয়েছ?
রচনা কিছু বলার আগে আমি গর্বের সঙ্গে বললাম, জি চাচা।
রচনা বলল, আগামী সপ্তায় ব্রিটিশ কাউন্সিল আমাকে সংবর্ধনা দেবে। আপনি যাবেন চাচা?
আমার আগামী সপ্তাহে কক্সবাজার যেতে হবে।
কিন্তু আপনি যাচ্ছেন না।
ওয়াল্লাহ, তিন মাসের আগের প্রোগ্রাম, তুনি না করলে যাই কীভাবে?