কাজ না-থাকলে খান স্যার পাঁচটায় অফিস ছাড়েন। খুব প্রয়োজন না-হলে অফিস-সময়ের পর জুনিয়র সহকর্মীদের বাসায় চলে যেতে বলেন। আবার অনেক সিএসপি আছেন খান স্যারের বিপরীত। আমার ব্যাচম্যাট চন্দনের বসও সিএসপি। তিনি নয়টা পর্যন্ত অফিস করেন, মানে অফিসে থাকেন। মাঝে

মাঝে দশটাও পার হয়ে যায়। অনেকে বলেন বউয়ের জ্বালায় সময়টা অফিসে কাটায়। তিনি অফিস ত্যাগ না-করা পর্যন্ত কেউ অফিস ছাড়তে পারেন না। বাসায় যেতে যেতে চন্দনের দশটা-এগারোটা বেজে যায়। বউ বকা দেন, প্রতিদিন এত রাত অবধি তোমার কীসের অফিস? জবাব দিতে পারে না।
আবদুল হামিদ খান অন্য মানুষ। তিনি বলেন— জীবনের জন্য চাকরি, চাকরির জন্য জীবন নয়। সংসার আছে, নিজের মন আছে, বন্ধু আছে, ফুর্তি আছে। চাকরিতেই যদি সব সময় শেষ হয়ে যায়, তো জীবনের দামটাই বা রইল কী! অতিরিক্ত কোনো কিছু ভালো নয়। তাতে চাকরিরই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়।
ঘড়ি দেখলাম। পাঁচটা বেজে পাঁচ মিনিট— খান স্যার চলে যেতে পারেন। আমি তাড়াতাড়ি স্যারের রুমে গেলাম।
স্যার তাঁর ব্রিফকেস গুছাতে গুছাতে বললেন, কিছু বলবে?
বিনয়ে বিনয় ঢেলে বললাম, মেয়েটার বিষয়ে কিছু বলতে এসেছিলাম।
: তাকে চাকরি দিতে তোমার অসুবিধা কোথায়?
: অসুবিধা নেই স্যার।
: তাহলে নিয়োগপত্রটা দিচ্ছ না কেন?
: অমন মেধাকে কেরানিগিরিতে নষ্ট করে দিতে চাইছি না।
: ইগো নয় তো?
: না।
: তাহলে আমি তোমার কথা বুঝেছি। আমিও একই বিষয় ভাবছি।
: থ্যাংক ইউ স্যার।
: এখন যাও। আমি বের হচ্ছি।
অন্য কেউ হলে ভয়ে আর কথা বলত না। আমি ভয়-ফয় সব ত্যাগ করে মরিয়া-সাহসে বললাম, স্যার আর একটা কথা বলব?
: বলো।
: মেয়েটা খুব গরিব। তিন বোন এক ভাই। সে সবার বড়ো।
: বাছা, এসব তো তোমার দেখার বিষয় না। তার বাপ দেখবে।
: বাবা পঙ্গু।
: এতদিন যেভাবে দেখেছে, সেভাবে দেখবে।
: কিছুদিন আগে দুর্ঘটনায় তার বাবা পঙ্গু হয়ে যায়। এখন পচন ধরেছে পায়ে। ভিক্ষা করার জন্যও নাকি বের হতে পারেন না।
: তাহলে তো বাছা চাকরিটা দিয়েই দিতে হয়।
: স্যার, আমি মানে …।
: আমতা আমতা করছ কেন? তুমি কি তার বাবা হতে চাও?
আমি স্যারের কথা পুরো হৃদয়ঙ্গম করার পূর্বে ফস করে বলে দিলাম, জি স্যার।
খান স্যার আঁতকে উঠার মতো শব্দ করে বললেন, কী বললে? বুড়ি একটা মেয়ের বাপ হবে তুমি! তোমার কপালে ভীষণ বিপদ আছে।
: কারও যোগ্যতাকে পোক্ত করার জন্য আমি বাবা হতে রাজি। স্যার, বাবা এক ধরনের স্রষ্টা। জাতির জনক, বিজ্ঞানের জনক, দর্শনের জনক- – -।
: তাকে আসতে বলো, দেখি কথা বলে।
আমি খুশি হয়ে রাকুকে ডেকে আনলাম।
রাকু রুমে ঢুকে আমাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে মার্জিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। কাঁধের পুরানো ব্যাগটা আমার চোখের মমতায় ভরে যাচ্ছিল। মমতা, শূন্যতাকে পূর্ণ করে দিতে পারে ঐশ্বর্যে আর প্রাচুর্যে।
খান স্যার রাকুকে বললেন, তুমি প্রতিভাবান, মেধাবীও। এ বয়সে এত মেধাবী কেউ আমার চোখে পড়েনি। বাই দা বাই, তোমার গ্রামের বিশিষ্ট নেতা মাসুদ আমার বন্ধু। অনেক বড়ো শিল্পপতি। অনেক মেয়ে তার টাকায় পড়ছে। ডিসি থাকাকালে পরিচয়। তাকে তোমার কথা বলে দিচ্ছি। তিনি তোমার লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। চিন্তা করতে হবে না।
রাকু ভয়ার্ত গলায় বলল, তার কাছে গিয়েছিলাম।
: কী বলেছেন তিনি?
: বাবার চিকিৎসা আর আমাদের লেখাপড়ার যাবতীয় খরচ বহন করবেন।
: নাওনি কেন?
মাথা নত করে ফেলল মেয়েটা। কয়েক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেল, সে সাহসী ও স্পষ্টবাদী।
: বলো।
একটা ঢোক গিলে বলতে শুরু করল রাকু—খরচ দেওয়ার কথা বলে আমার পঙ্গু বাবার সামনেই আমার শরীরে হাত দিয়ে দিলেন উনি। স্পর্শের রকম-ফের আমি বুঝি; বুঝি বাবার স্পর্শ আর ধর্ষকের স্পর্শের তফাত। যত দূরে সরে যেতে চাইছিলাম ততই কচ্ছপের মতো হিংস্রতায় কাছে টেনে নিচ্ছিলেন। একসময় টেনে কোলে বসিয়ে ফেললেন। আমি ঝটকা মেরে উঠে এলাম।
: তিনি কিছু বলেছেন?
: স্যার।
: কী বলেছেন?
: অসভ্য মেয়ে, তোমাকে কোনো সাহায্য করব না। আমি বলে দিয়েছি— মরব, তবু আপনার সাহায্য নেব না। মাসুদ সাহেব বলেছিলেন— তাহলে এলি কেন? আমি বলেছিলাম— , সবাই আপনাকে রাজাকার বলত, আমার সন্দেহ ছিল। আজ বুঝলাম, আপনি আসলেই রাজাকার। ছি!

তারপর? খান স্যারের আগ্রহ উতলে পড়ছে।
: তিনি আমাকে মারতে আসছিলেন। এসময় রঞ্জন স্যার আসায় কোনো রকম বেঁচে গেলাম। আপনি স্যার আমাকে চাকরিটা দেবেন? দেন-না স্যার?
খান স্যার লজ্জায় বিড়বিড়িয়ে বললেন, কী অসভ্য মানুষ! আমাদের মতো আমলাদের তেল দিয়েই সে ধনী। আমরা এসব অমানুষের জন্য কাজ করেছি! সধারণ্যে লুকিয়ে থাকা প্রতিভাবানদের জন্য কিছুই করিনি, করতে পারিনি। মাসুদ সাহেব রাজাকার ছিলেন তা শুনেছি, কিন্তু এত লম্পট?
রাকুর চেহারায় লজ্জা ও ঘৃণার ছাপ। ভেজা গলায় বলল, ওখান থেকে সোজা চলে এলাম বাড়িতে।
তারপর? খান স্যারের গলায় আগ্রহের ঝড় ওঠেছে।
: ওইদিন রাত থেকে আমাদের উপর নানা অত্যাচার শুরু হয়। রাত-বিরাতে বাসায় ঢিল, রাস্তাঘাটে টিটকারি, জল আনতে গেলে কলসি ভেঙে দেওয়া— আরও কত কী। জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠল। রঞ্জন স্যার আমাকে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দিলেন। সেখানেও মাসুদ সাহেবের লোকজন অত্যাচার শুরু করে দিল। রঞ্জন স্যার ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। চাকরি অবস্থায় যা আয় করেছেন সব গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন। পেনশনের টাকা ও জমিজমা সামান্য যা ছিল, তা-ও গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য খরচ করে ফেললেন। একমাত্র মেয়ে মিনিকে বিয়ে দিতে গিয়ে তিনি যৌতুকের চাপে পড়ে পুরোই নিঃস্ব হয়ে গেলেন।
খান স্যার বললেন, থানায় যাওনি কেন?
: বাড়ি থেকেই বের হওয়া যাচ্ছিল না। থানা কি স্যার আমাদের অভিযোগ শুনত? বরং উলটো আমাদের হয়রানি করত। কে সাক্ষ্য দেবে আমাদের পক্ষে? দিন দিন আমাদের ওপর সামাদ সাহেবের সন্ত্রাসীদের অত্যাচার বেড়ে যেতে থাকল। অতিষ্ঠ হয়ে পড়লেন রঞ্জন স্যার। তাঁর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হলো। একটা গোরু ছিল স্যারের একমাত্র সম্বল। ওটি বিক্রি করে কিছু টাকা দিয়ে রাতের আঁধারে আমাদের ঢাকার ট্রেনে তুলে দিলেন।
: কোথায় থাক এখন?
: বস্তিতে।
রাকুর কথা আমাকে স্নেহ-বিষাদে ভিজিয়ে দিল। আদিলের মুখ রাকুর চুলের চেয়েও কালো হয়ে গেছে। খান স্যারের মুখে সহানুভূতির ধাক্কা এত প্রবলভাবে লেগেছে যে, তিনি কয়েক সেকেন্ডের জন্য সিগারেট টানা পর্যন্ত ভুলে গেলেন।
খান স্যার আর্দ্র গলায় বললেন, তুমি যাও। দেখি কী করা যায়।
রাকু চলে যাওয়ার পর খান স্যার বললেন, তুমি কী করতে চাও?
: আপনি কী বলেন স্যার?
: মেয়েটার কথা এক ভাগ সত্য হলেও তাকে চাকরিটা না-দেওয়া উচিত হবে না। প্রয়োজন কিছুই মানে না। বাই দা বাই, আমরা হয়তো তার মাধ্যমে আরও তিনজনকে পাব। এভাবেই সভ্যতা গড়ে উঠেছে। মৃতের দেহাবশেষ থেকে বেরিয়ে আসে নতুন জীবন। পুরাতনের লাশের ওপর গড়ে ওঠে নতুন

সভ্যতা।
আমি বললাম, স্যার, আমি তাকে চাকরিটা দিতে ইচ্ছুক না। তবে তার ভবিষ্যৎ যাতে নষ্ট না-হয় সে বিষয়ে একটা পরিকল্পনা আছে।
খান স্যার চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বললেন, এ নিয়ে কাল আলাপ হবে। আর একবার ভালো করে ভেবে দেখো। মেয়েদের প্রতি অতি আগ্রহ কেউ ভালো চোখে দেখে না। আগে মানুষ তিলকে তাল বানাত এখন বানায় ফুটবল।
: স্যার।
: আমরা বাঙালি, যতই লেখাপড়া করি এখনও সভ্যতার মানেটাও বুঝি না। উদারতা থেকে অনেক দূরে। আপাদমস্তক কুসংস্কার আর পশ্চাৎপদতা ঢেকে রেখেছে। এমন লোক লেখাপড়া করলে আরও ভয়াবহ হয়ে পড়ে। তাদের আচরণ এতই খারাপ যে, মানুষ পরিচয়টাকেও লজ্জাকর করে তোলে।
:ঠিক বলেছেন স্যার।
খান স্যার কক্ষ হতে বের হতে হতে বললেন, সাবধান। কাউকে সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে যেন নিজেই সহানুভূতির কাঙাল হয়ে না-পড়। আমি কী বলেছি বুঝতে পেরছ?
স্যার, বুঝতে পেরেছি, আমি বললাম।
——————————————————–