অরুণাভসরকার হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে ঝড়ের বেগে হাঁপাতে হাঁপাতে আমার অফিস কক্ষে ঢুকে পড়লেন। তিনি এভাবে আকস্মিক এসে পড়েন।তবে আজ প্রচণ্ড তাড়া। সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে সচিবালয়ে ঢোকার আলাদা পাস আছে তার।
ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, রাখেন।
স্যমন্তক, পুথিনিলয়।
ভেতরে কী?
ভালো জিনিস। তবে দেখা যাবে না।
বোতল-টোতল নই তো আবার?
বাতল হলে আপনাকে দেব- পাগল না কি?
কী, তাহলে?
বই। অনেক দুর্লভ বই, সহজে পাওয়া যায় না। হঠাৎ পেয়ে গেলাম।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদের কিছু নেই।
কেন?
আপনার জন্য নয়, আমাদের সর্বজননী রচনা মায়ের জন্য। বইগুলোতে ঘোড়াশালের জমিদার আবু ইউসুফ লুৎফুল কবিরের স্বাক্ষর আছে। দেখলে পাগল হয়ে যাবেন। দুর্লভ সম্পদ। নিলামে দিলে লাখ টাকা পেতাম।
কোথায় পেলেন?
গতকাল আমাদের অফিসের স্টোর রুমটা পরিষ্কার করা হয়েছে। কবির ভাই অনেকগুলো নষ্ট আর পুরানো বইপত্র সের দামে বিক্রি করে দিলেন। আমি ঢুঁ মারলাম ভেতরে। কয়েকটা বই মনে হলো রচনা মায়ের মন জয় করার অস্ত্র হবে। ভাঙারিকে ধমক দিয়ে নিয়ে এলাম।
অরুণাভ সরকার রচনাকে খুব স্নেহ করেন, সাহায্য করতে পারলে খুশি হন। রচনাও অরুণাভ সরকারকে শ্রদ্ধা করেন। শুধু তিনি নন, মেয়েটির সঙ্গে যার পরিচয় ঘটে তারই একই ঘটনা ঘটে। মন জয় করার চেয়ে বড়ো বীরত্ব আর হয় না।
আহমেদুল কবির
আহমেদুল কবির ভাই কেমন আছেন?
জমিদারের ছেলে, তাঁদের খারাপ থাকার কোনো সুযোগ নেই।
আহমেদুল কবির সাহেব আমাকে খুব স্নেহ করেন। জাঁদরেল মানুষ তিনি। ১৯৪৫-১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্বাচিত ডাকসুর প্রথম ভিপি। বেশ সহজ-সরল মানুষ। গণতন্ত্রী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা।
দাদা, রচনা মায়ের হাতে ব্যাগটা দেবেন।
রচনা আসার পর সবাই আমার পর হয়ে গেল। সে হয়ে গেল আপন। তাকে এনে মনে হয় ভুল করেছি।
অরুণাভ সরকার আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে বললেন, একটা সিগারেট দিন।
হঠাৎ টেলিফোন বেজে ওঠল।
রিসিভার কানে দিয়ে টের পেলাম— মমতাজ উদ্দিন স্যার।
সুখবর তোমার, কী বলো তো?
আপনার ফোনের চেয়ে বেশি সুখবর আর কী হতে পারে?
তোমার রচনা প্রথমবর্ষ অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম হয়েছে। শুধু প্রথম নয়, এত বেশি নম্বর পেয়েছে যে, শিক্ষকেরাও অবাক। নরেন বিশ্বাস বলেছে। তোমার ফোন নম্বর জানে না, নইলে সেই জানিয়ে দিত।
খুব খুশি লাগছে।
ইয়াংম্যান, তোমার প্রকল্প শতভাগ সফল হতে যাচ্ছে। এই মেয়ে তো দুর্লভের দুর্লভ। পেলে কীভাবে? আমরা তো পাই না।
আপনার সঙ্গে কথা বললে মনে হয়, আনন্দে ভাসছি।
তোমার রচনা একদিন তোমাকেই রচনা করবে নতুনভাবে। এভাবে অনেক সৃষ্টি তার স্রষ্টাকে রচেছে যুগের প্রয়োজনে- যুগের পর যুগ এবং রচে যাবে যুগ যুগ।
আপনি আমাকে খুব স্নেহ করেন।
মমতাজ উদ্দিন আহমেদ স্বভাবসুলভ লাস্য বাক্যে বললেন,
ড. মোহাম্মদ আমীন
তুমি আসলেই জিনিয়াস,
তোমার আবিষ্কার তার চেয়েও জিনিয়াস;
তুমি করেছ তা- যা করতে পারেনি কলম্বাস।
আমি বললাম, ধন্যবাদ, প্রশংসা উৎসাহের উর্বরক।
মেয়েটাকে নিয়ে একদিন চলে এসো, নাটকের কিছু ট্রিপস দিয়ে দেব। এমন শৈল্পিক অবয়ব আর লুব্ধকোজ্জ্বল চোখ আমি দেখিনি। নাট্যদেবী নিজ হাতে বানিয়েছেন। কী গভীর চোখ, ডুবে দিলে নীল তিমিও হদিসহীন হয়ে যাবে আলপিনের ছ্যাঁদার মতো। জানো— আমি তার চোখ দেখি না হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে/ এরূপ চোখই যুগে যুগে প্রলয় আসে লয়ে।
আমার খুশি গড়িয়ে, মমতাজ উদ্দিন আহমেদের মতো লোক রচনার প্রশংসা করছে, আমার প্রশংসা করছে। খুশিগুলো ক্রমশ ফুলে ওঠছে। বুকের ভেতরেমমতাজ উদ্দিন আহমেদ
এত খুশি ধরে রাখার জায়গা ছোটো হয়ে আসছিল। শ্বাসের বাতাসগুলোও আনন্দ হয়ে যাচ্ছিল, আনন্দ কি অক্সিজেনের বিকল্প হতে পারে?
ফোন রেখে অরুণাভ সরকারকে বললাম, রচনা প্রথম বিভাগে প্রথম হয়েছে।
অরুণাভ সরকার খুশির চোটে আমার সিগারেটের প্যাকেটটা হাতের মুঠোয় ভরে নিয়ে বললেন, এমন আনন্দ কখন পেয়েছি মনে পড়ছে না— আমার বনের তলে নবীন এল, মনের তলে ভোর। সর্বজননী রচনা-মা সর্বজয়ী হয়ে থাকবে, আমি গেলাম। দিন, কিছু টাকা দিন মিষ্টি খাব। এত খুশিতে মিষ্টি না-খেলে কবি কষ্ট পাবে। বই আনা আমার আমরণ সার্থক হয়ে গেল।
অরুণাভ সরকারের হাতে কিছু টাকা দিলাম। তিনি টাকাগুলো পকেটে ভরে চেয়ার হতে উঠতে উঠতে বললেন, চললাম?
যাচ্ছেন?
অরুণাভ সরকার চলে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে হাঁটা শুরু করে বললেন, যাওয়া বলে কিছু নেই, সবই ঘুরে-ফিরে আসা। ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্ন অবয়বে। ভিন্ন দিনে ভিন্ন জায়গায়, ভিন্নভাবে। আমি যাচ্ছি আসার জন্য আর আনার জন্য। কবিরা যায় না, আসে আর আসে— কাকের মতো অসংখ্য হয়ে।
বললাম, দাদা, আমার সিগারেটের প্যাকেট?
আরুণাভ সরকার আমার সিগারেটের প্যাকেটের সব সিগারেট বের করে আর একটা খালি প্যাকেটে ঢুকিয়ে নিলেন। তারপর খালি প্যাকেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে সরল একটা হাসি দিয়ে বললেন, নিন আপনার সিগারেটের প্যাকেট। সিগারেট তো আর চাননি।
টাকা দিলাম আবার সিগারেট? আমি হাসতে হাসতে বললাম।
টাকা দিয়েছেন গলা ভেজানোর জন্য, শুকাতে হবে না?
অরুণাভ সরকার
বেশি ভেজালে কিন্তু সর্দি হয়ে যাবে।
কবির গলা না-ভেজালে কবিতা কোথায় পাবেন? কবিতা ছাড়া সভ্যতা শতবর্ষী যুবতির মতো কুঁচকানো কাঁথা। শুকনো মাঠে ফলন হয় না দাদা। শরাব পিয়ে ভেজাব আর ধুম পিয়ে শুকাবে।
অরুণাভ সরকার চলে গেলেন। বারোটার দিকে টেলিফোন করল রচনা, স্যার আমাদের বস্তির নিনি ভিক্ষা করতে এসেছে। আপনি যদি অনুমতি দেন, তাকে বাসায় রেখে দেব। রেখে দেব? আমার মনে পড়ে গেল রচনার সেই কলজেবিদারি বাক্য- স্যার, চাকরিটা আমাকে দেবেন। দেবেন তো?
মেয়েটার বয়স কত? জানতে চাইলাম।
বারো, দেখলে মনে হবে সাত। বস্তি পাঁচ বছর খেয়ে ফেলেছে, স্যার। হাড়ের ওপর চামড়া, মাঝখানে কিছু নেই। বস্তির আল্পু-কল্পু মনে করুন। বস্তির লোকেরা মোটা হওয়ার জন্য মরে আর ভবনের লোকেরা মরে চিকন হওয়ার জন্য। কী দারুণ কষ্টের নষ্ট মিল, তাই না স্যার?
মেয়েটা কেমন?
ভালো। আল্পু-কল্পুর বন্ধু ছিল। তিন কুলে কেউ নেই। মাঝে মাঝে আমাদের ঝুপড়িতে রাত কাটাত। রাস্তায় থাকে, রাস্তায় খায়।
আমাদের একজন ছোটো গৃহকর্মী প্রয়োজন। ছুটা বুয়া দিয়ে সব কাজ করানো যায় না। অনেক সময় অনেক কিছু লাগে। টুটুল বাচ্চা। মেয়েদের ঘনঘন দোকানে পাঠানো আমার ভালো মনে হয় না।
ভালো হলে রেখে দাও। পড়তেও পারবে আল্পনা-কল্পনার সঙ্গে।
নরেন বিশ্বাস
থ্যাংক ইউ, স্যার।
তোমার রেজাল্টের খবর জানো?
তিনটার দিকে দেবে। আমি যাচ্ছি।
যাও।
স্যার, আপনি কি জেনে গেছেন?
উত্তর দেওয়ার আগে ইন্টারকমে বসের সালাম। সালাম মানে— ডাক। আমি রচনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেলাম না। কিন্তু রচনা বুঝে গেছে, আমি জেনে গেছি। বস আর বউয়ের ডাক জগতের বাকি সব ডাককে ডার্ক করে দিতে পারে।
To provide the best experiences, we use technologies like cookies to store and/or access device information. Consenting to these technologies will allow us to process data such as browsing behavior or unique IDs on this site. Not consenting or withdrawing consent, may adversely affect certain features and functions.
Functional
Always active
The technical storage or access is strictly necessary for the legitimate purpose of enabling the use of a specific service explicitly requested by the subscriber or user, or for the sole purpose of carrying out the transmission of a communication over an electronic communications network.
Preferences
The technical storage or access is necessary for the legitimate purpose of storing preferences that are not requested by the subscriber or user.
Statistics
The technical storage or access that is used exclusively for statistical purposes.The technical storage or access that is used exclusively for anonymous statistical purposes. Without a subpoena, voluntary compliance on the part of your Internet Service Provider, or additional records from a third party, information stored or retrieved for this purpose alone cannot usually be used to identify you.
Marketing
The technical storage or access is required to create user profiles to send advertising, or to track the user on a website or across several websites for similar marketing purposes.