ড. মোহাম্মদ আমীন
স্যমন্তক: সপ্তত্রিংশ পর্ব (৩৭)
আফজল ভবনের মূল ফটক খোলার আগে দুজন লোকের কথোপকথন শুনে দাঁড়িয়ে যাই— বাড়িঅলা আফজল হক আর দ্বিতীয় তলার নতুন ভাড়াটে মাজেদ সাহেব কথা বলছেন।
… মেয়েটা আপনার নাতির গা না-ঘেঁষে হাঁটতে পারে না।
আফজল চৌধুরী বলেন, মাজেদ সাহেব, আপনার ছেলে-মেয়ে এর চেয়ে বেশি গা-ঘেঁষে চলাফেরা করে; দেখেছেন?
ওরা তো ভাইবোন।
রচনা আর নাতি শুধু ভাইবোন নন, বাপ-মেয়েও। আমার নাতি কত বড়ো মনের মানুষ আপনি জানেন? ভবিষ্যতে এমন পাপের কথা মুখেও আনবেন না। মেয়েটা অমায়িক, বুদ্ধিমতী, সবার বিপদে এগিয়ে আসে। আচরণে কোনোদিন ত্রুটি পেয়েছেন?
নতুন এসেছি, তাই বুঝতে পারিনি। আসলেই মেয়েটা খুব ভালো— কয়েকদিনে কেমন আপন করে নিল আমাকে। কী সুন্দর করে চাচা ডাকে। বুকটা ভরে যায়। আমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও ভালো খাতির হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মেয়েটার কাছ থেকে পড়া জেনে আসে। আমার ওয়াইফ রচনা বলতে পাগল।
আফজল চৌধুরী বললেন, মেয়েটি আসার আগে আমার বিল্ডিঙের ষোলো পরিবার ছিল ষোলোটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। পরিচয় হলে কয়েক দিন পর শুরু হতো ঝগড়া। কেউ কাউকে চিনত না। মেয়েটি ষোলোটা পরিবারকে এক পরিবারে পরিণত করে দিয়েছে। তার চেষ্টায় প্রতিমাসে সব পরিবার মিলিত হয়ে একসঙ্গে খাওয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে। শহরকে গ্রামের মায়ায় ঢেকে দিয়েছে সে।
আপনার নাতিও খুব ভালো মানুষ।
নাতি আসার পর এলাকার আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে। আগে দিনের বেলাতেও মেয়েরা রাস্তায় বের হওয়ার সাহস পেত না। এখন রাত দুটো হলেও ভয় নেই।
তাদের কথোপকথন আমার সরল প্রাত্যহিকতায় বিরাট ধাক্কা দিল। মুখটা লজ্জায় ঘেমে ওঠেছে। বুঝতে পারি, রচনা আমার বোন নয়, রচনা আমার মা নয়, মেয়ে নয়, স্ত্রী নয়; এককথায় কেউ নয়— আমি যতই দাবি করি না। এখন মূল বিবেচনা ডিএনএ, মন যতই কান্নাকাটি করুক কিছু যাই আসে না বিধির। রচনার দিকে তাকাই, তার কোনো ভাবান্তর নেই। মনে হচ্ছে, সে এদের কথা শোনেনি। খান স্যারের কথা শুনছেনÑ যে যাই বলুক, কাউকে পাত্তা দিও না। নিজে ঠিক থাকলে কেউ তোমাকে কিচ্ছু করতে পারবে না। অন্যের কথা তার নিজের আচরণকে প্রকাশ করে, তোমার আচরণকে নয়। তোমার কথাই তোমার প্রতিনিধি। অতএব,কিক দেম আউট।
গেট খোলার আওয়াজ কথোপকথনের ইতি ঘটে। রচনা ওদের দেখানোর জন্য ইচ্ছে করে আমার বাম বাহু তার ডান বাহু দিয়ে আগের চেয়ে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে-সেঁটে ভেতরে ঢুকল। হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলেও রচনা আঁকড়ে ধরে ফিসফিস করে বলল, স্যার, ভয় পাওয়া মানে হেরে যাওয়া। আমি বস্তির মেয়ে হারানোর কিছু নেই, যা পাই তাই লাভ। যে হাত ধরেছি সে হাত ছাড়ব না, ছিঁড়ে নেব প্রয়োজনে। আমার জন্য যদি আপনার ক্ষতি হয়, ছেড়ে দিন; উৎসে চলে যাব এই মুহূর্তে। তবে যা দিয়েছেন তাতে আর অন্তত ভাত-কাপড়ের চিন্তা করতে হবে না। বুড়ির বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে হবে না।
আমাদের দেখে দুজনে সালাম দিলেন, আমরাও সালাম দিলাম, কেমন আছেন আপনারা?
রচনা বলল, ভালো, আপনারা?
আমরাও ভালো আছি আল্লাহর রহমতে।
রচনা বলল, দাদু-চাচা এবার আফজল ভবনের মাসোৎসবে আপনাদের সব দায়িত্ব পালন করতে হবে। নতুন চাচা বাজারের দায়িত্বে থাকবেন। তিন খুব সিনসিয়ার মানুষ, দুদিনেই চিনে ফেলেছি। বাজারে ওস্তাদ।
আফজল চৌধুরী বললেন, কেন মা? তুমি থাকতে আমরা কেন?
আপনি সভাপতি।
তুমি ভবন কমিটির নির্বাচিত সেক্রেটারি, সেক্রেটারিই আসল।
রচনা বলল, আপনারা মুরুব্বি, আপনাদের বুদ্ধি আমাদের শক্তি।
মাজেদ সাহেব বললেন, বাহ! কী লক্ষ্মী।
আপনাদের স্নেহ আমার প্রার্থনা।
মাজেদ সাহেব বললেন, কথা শুনলেই বোঝা যায়, অনেক বড়ো বংশের মেয়ে।
রচনা বলল, মাজেদ চাচা, আপনাকে পাঞ্জাবি পরলে খুব স্মার্ট দেখায়Ñ না দাদু?
আফজল চৌধুরী উত্তর দেওয়ার আগে মাজেদ সাহেব বললেন, হ্যাঁ, আমার মেয়েও বলে, তোমার চাচিও একই কথা বলে। তাই পাঞ্জাবি পরি।
রচনা বলল, আসি, ভালো থাকবেন।
মুখ আমার গোমড়া হয়ে আছে। এতক্ষণ একটি কথাও বলিনি। গোমড়া মুখের দিকে তাকিয়ে রচনা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বলল, স্যার, মন খারাপ আপনার?
এদের কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেছে? অপেক্ষা করুন, দেখুন কী হয়।
কী হবে?
রচনা দৃঢ়কণ্ঠে বলল, কে কী বলল সেটি তখনই আমাদের বিষয় হবে, যখন তাকে আমরা আমাদের বিষয় করে নেব। আপনাকে কেউ কিছু দিতে এল, আপনি নিলেন, ওটা তারই থেকে যাবে।
পেছন থেকে ভেসে আসে মাজেদ সাহেবের গলা, মা রচনা।
চাচা।
স্যার-সহ তোমার বাসার সবাইকে আগামী শুক্রবার সন্ধ্যায় দাওয়াত। পথের দাওয়াত, কিছু মনে কর না। তোমার চাচি বাসায় গিয়ে দাওয়াত দিয়ে আসবে।
রচনা উৎফুল্ল গলায় বলল, চাচা, ভালোবাসায় পথ-অপথ নেই। এটি সর্বগামী। আলোও সর্বগামী নয়, বাধা ফেলে থেমে যায়, বাতাসও সর্বগামী নায়, বস্তুর বাধা অতিক্রম করতে পারে না; কিন্তু ভালোবাসা কোনো বাধাই মানে না।
তুমি খুব ভালো মেয়ে।
চাচা, আপনি খুব ভালো মানুষ।
তোমার চাচিকে কথাটা একটু বলিও। সে কিছুতেই এটি মানতে চায় না মা।
কী বলেন তিনি?
আমি নাকি একটা অপদার্থ, একটা বলদ, একটা কাপুরুষ।
রচনা উল্লসিত হয়ে বলল, ভালোবাসার পাত্রকে সবাই এমন বলে। চাচি আপনাকে খুবই ভালোবাসেনÑ নইলে এমন করে বলতে পারতেন? আপনিও খুব ভালোবাসেন, নইলে মেনে নিতে পারতেন?
তাই তো মা, এতদিন তো এমন করে ভাবিনি?
আপনি ভাবেননি, কিন্তু আপনার মন ঠিক ভেবেছে।