ড. মোহাম্মদ আমীন
স্যমন্তক: সপ্তদশ ও অষ্টাদশ পর্ব
১৭
রচনাদের বস্তির ঝুপড়িতে ঢুকে আমি আঁতকে উঠি। অতীতে কোনোদিন এমন বিষাদময় কক্ষে ঢুকিনি। কক্ষ নয় যেন নির্বোধের মতো সড়কের পাশে গড়ে তোলা বা ফেলে রাখা সিটি কর্পোরেশনের ইষ্টক বা অয়সনির্মিত খোলা ভাগাড়ের ঘনিষ্ঠতম আশপাশ। কাক-ইঁদুর আর পিঁপড়ে-কেঁচো ভাগাড় থেকে নানা ময়লারাশি এনে ছড়িয়ে দেয় যেখানে। আমার বাবা বলতেন—ভাগাড়পুর।
ঝুপড়ির চারদিকে মরচে-ঝুরঝুরে চালুনি-ছ্যাঁদা টিনের চারটি বেড়া। টিনের এই বাধা উপেক্ষা করে ছ্যাঁদা দিয়ে অনর্গল বাইরের দুর্গন্ধ ভেতরে হানা দিচ্ছে। এটাই ঢাকা শহরের আসল চিত্র। নাক চেপে না-ধরে পারলাম না। জাহান্নম কি এর চেয়ে বিষাদময়!
স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে পিঁপড়ে আর তেলেপোকার দাপট। কেঁচোও দেখা গেল। কেঁচোর দল পিঁপড়ের ভয়ে দেওয়ালের পাশ দিয়ে সাবধানে চলাফেরা করছে। পশ্চিম কোনায় একটা উইয়ের ঢিবি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে। উই পোকারাও ভয় পায় পিঁপড়েকে। কয়েকটা কেঁচোকে পিঁপড়ের দল সন্ত্রাসীর মতো ঝাপটে ধরেছে। কেঁচোর হাড়বিহীন নরম শরীর— যন্ত্রণায় ছটফট করছে। উদ্ধারের কেউ নেই, সবাই বাঁচার তালে এবং বাঁচার জন্য অন্যকে মারার তালে। বামদিকে একদল পিঁপড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বিশাল সাইজের এক তেলেপোকা। কয়েকটা টিকটিকি একসঙ্গে টিকটিক শব্দে ডেকে ওঠল। মনে হলে আমাকে উপহাস করছে— ছি ছি টিক টিক; ধিক ধিক ধিক ধিক।
মেঝেতে একটা ছেঁড়া চাটাই। তার উপর তেলে তেলে ময়লা-কালো তেল-চিটচিটে চারটা বালিশ। ওপরে শতছিন্ন একটা কুৎসিত মশারি। এর নিচে ঘুমিয়ে আছে টুটুল। কতই বা বয়স— দুই হয়তো তিন। তার মুখে মায়া ঢালছে পঁচিশ ওয়াটের বাল্বের মিটমিট আলোর রুগ্ণ রশ্মির করুণ ছোঁয়া।
আহ!
পোকার রাজ্যে কী শান্তিতে ঘুমাচ্ছে উলঙ্গ মানব শিশু টুটুল।
চাটাইয়ের মাথায় টিনের একটি ছোটো বাক্স। পেছনে স্টোভ— তেল আর কালিতে কিম্ভূতকিমাকার। ডানপাশে কিছু বাসন-কোসন এলোমেলো পড়ে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত হরিয়ানার পৌরাণিক কুরুক্ষেত্রের মতো। উত্তর কোনায় বাঁশের তৈরি একটা আলনা, ওটায় ফাঁসি খাওয়া বালিকার মতো সন্ত্রস্ত ভঙ্গিমায় ঝুলছে খানকয়েক মেয়েলি কাপড়। দক্ষিণ কোনায় একটা টেবিল টিনের দেওয়ালের সঙ্গে ঠেসে। তাকে ঘিরে প্লাস্টিকের তিন-পায়া তিনটে চেয়ার যেন ভেঙে পড়ার অপেক্ষায় অনেক কষ্টে দাঁড়িয়ে আছে। টেবিলটা পুরানো হলেও যত্নের জন্য চকচক করছে।
টেবিলের উপর প্লাস্টিকের একটা জগ। জগের গা ঘেঁষে একটি বাংলা কোরআন শরিফ। তার পাশে একটি বাইবেল; নিকটে একটি গীতা। টিনের সঙ্গে লাগানো কিছু পাঠ্যবই; সবগুলো পোস্টার দিয়ে বাঁধানো। গীতবিতানও দেখলাম, দেখলাম গল্পগুচ্ছ। সৈয়দ মুজতবা আলীর শবনমও দেখলাম। টেবিলের নিচে কয়েকটি ইটের উপর বেশ কিছু বই অতি যত্নে পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।
এগুলো কী?
রাকু বলল, রবীন্দ্র রচনাবলি।
বস্তিতে একসঙ্গে তিনটি ভিন্ন ধর্মের গ্রন্থ পাশাপাশি দেখে আমার চোখ বিস্ময়ে কপালে। জানার আগ্রহকে প্রবল চাপে চেপে রেখে দিলাম। জানার সময় যথেষ্ট আছে। রাকু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখুন স্যার— কয়েকদিন না-থাকায় ঘরটাকে কেমন নরক বানিয়ে ফেলেছে। তিনজন মিলে সারাদিন শুধু দুষ্টামি করে। বাবা মারা যাবার পর আরও সাংঘাতিক হয়ে গেছে। একটু যদি পরিষ্কার করত ঘরটা।
আমি কিছু বললাম না। সবার চোখেমুখে ক্ষুধা ছাড়া আর কিছু নজড়ে পড়ল না। এমন কক্ষ যত পরিষ্কার করা হবে তত অপরিষ্কার হবে। আল্পনা-কল্পনা রাকুর বকার ভয়ে কাঁপছে, কিন্তু রাকু বকল না। রুমে ফ্যান আছে, তবে বন্ধ। জানালাও দেখা গেল না। ঘুলঘুলিই একমাত্র ভরসা। তাও মাকড়সার জাল, চুলোর ধোঁয়া আর ধুলোবলিতে ঢেকে। প্রচণ্ড গরম লাগছে। চারদিকের টিনগুলো চুলোর গরম কড়াই যেন। ছ্যাঁদাগুলোই কেবল হাওয়া পাওয়ার পথ। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমার জামাকাপড় ঘামে ভিজে জবজবে।
রাকু আমাকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে চাইল। নিষেধ করায় থেমে গেল।
ফ্যান চালাও না? প্রশ্ন করলাম।
রাকু বলল, স্যার, ফ্যান চালালে মাসে অতিরিক্ত চারশ টাকা দিতে হয়। লাইন নেই, ফ্যানটাও নষ্ট।
: এত কম আলোর লাইট কেন?
: এর বেশি হলে প্রতিমাসে আরও পঞ্চাশ টাকা করে দিতে হবে।
আল্পনা আর কল্পনা আমার পরিচয় পেয়ে দুদিক হতে জাপটে ধরল। এমন গভীর পরশ অতুলনীয়। মনে হলো, তাদের মৃত বাবা সম্পদের পাহাড় হয়ে ফিরে এসেছে।
রাকু ফরসা নয়, কিন্তু সুন্দর, চেহারায় গোধূলির মায়া। চোখ দুটো দেখলে স্নেহভরা আকর্ষণ অনুভূত হয়। এমন চোখ বস্তিতে একদম বেমানান। আল্পনা-কল্পনা ফরসা— মুখটা না গোল না লম্বা। পুরো শরীরে চামড়া আর হাড় ছাড়া মাংসের চিহ্ন তেমন একটা চোখে পড়ল না। বুড়ির বাসায় একবেলা খেতে না পেলে রাকুর অবস্থাও করুণ হতো। মাথা ন্যাড়া করে ফেলায় দুই বোনকে আরও রুগ্ণ দেখাচ্ছে। মনে হলো দুটো শুকনো শলা বাতাসে নড়ছে-উড়ে যাবে তাই।
মশারির নিচে আবার চোখ দিলাম। টুটুলের ঘুম তখনো ভাঙেনি। ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলাম, শিশু নয় যেন ঘুমন্ত কঙ্কাল। অভাবের ধাক্কায় সবকটি হাড় চামড়া ফুঁড়ে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে।
: রাকু, তোমার ভাইবোন দেখতে বেশ।
: স্যার, আল্পনা-কল্পনা পেয়েছে মায়ের রং। টুটুল বাবার মতো হয়েছে।
আমি বললাম, এখান থেকে কিছু নিয়ে যাওয়ার আছে কি?
রাকু টেবিলে ইশারা দিয়ে বলল, এটা কেনার জন্য বাবা ভিক্ষা পর্যন্ত করেছেন।
আমি বললাম, টেবিল আর বইগুলোই শুধু নাও।
কল্পনা বলল, আমাদের জামাকাপড়? টুটুলের মার্বেল, ডাস্টবিনে কুঁড়িয়ে পাওয়া পুতুল, আল্পনাপুর চিরুনি, আমাদের বাক্স?
বাক্সের দিকে তাকালাম। চৌকোনা একটা টিনের বাক্স। এগিয়ে যেতেই সুড়ুৎ করে কয়েকটি ইঁদুর বাক্স থেকে বেরিয়ে পালিয়ে গেল। আরও কাছে গিয়ে দেখলাম বাক্সের এক কোনায় ইঁদুর-সাইজের একটি ছ্যাঁদা।
এটাই কি তোমাদের বাক্স?
কল্পনা বাক্সটি জড়িয়ে ধরে বলল, হ্যাঁ।
কী আছে ওখানে? জানতে চাইলাম।
রাকু বাক্সটা খুলল। আলনার কাপড়ের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম পুরানো কয়েকটি ফ্রক-জামা, একটি চাদর, একটি অ্যালবাম, চার জোড়া কাপ-পিরিস, ম্যালামাইনের চারটা প্লেট, চারটা গ্লাস, সস্তা দামের কিছু অলংকার, প্লাস্টিকের দুটো বল, কয়েকটা মার্বেল— টাকার হিসাবে সব মিলিয়ে পাঁচশ টাকার বেশি হবে না।
বস্তিঘরের মালিককে খবর দেওয়া হলো। তিনি কাছেই ছিলেন, খবর পাওয়ামাত্র চলে এলেন। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। বেশ সুঠাম দেহ। দাড়িগুলো মেহেদিরঙে রঞ্জিত। আমি সালাম দিলাম।
ভদ্রলোক কোনোরূপ ভদ্রতা না-দেখিয়ে বললেন, মুই এই বস্তিগো সর্দার, মালিক বি কইতে পারেন। মুই বাংলাদেশের হক্কল ভাষায় বইলতে পারি। মুর নামডা মাজিদ, তই মাইনষ্যে কসাই মইজ্যা ডাহে, বুইজলাইননি? গোরুর মতো মানুষ কাইটা আরাম পাই।
আমি বললাম, রাকুদের নিয়ে যেতে এসেছি।
: কহন যাইব?
: আজকে, এক্ষুনি। কোনো পাওনা থাকলে বলুন।
কসাই মইজ্যা বললেন, তিন মাস সাত দিনের ভাড়া পাইবাম। শোধ না-কইরলে নইড়তেও দিমু না কইলাম।
হিসাব করে ভাড়াটা বুঝিয়ে দিলাম। ভাড়া পেয়ে কসাই মইজ্যা খুশি হলেন না, বরং বেজার হয়ে গেলেন। চাপা রাগে উপহাস ঢেলে বললেন, সায়েব অইব না। মাইয়াগো মুর বস্তিতে দুই সাল থাইকতে অইব।
: কেন?
: ভাড়া দেড় আজার ট্যাকা। মাইয়া মানুষ বইলা একআজার ট্যাকায় ভাড়া দিছিলাম। ভাইবছিলাম এমন ডাঙ্গর মাইয়া, ফিউচারে কাজে লাইগবার পারে। আমার বুকটা বেবাক খালি কইরা আপনে ফুর্তি করার লাইগা লিয়া যাইবেন, অইত না। আপনে যান, চেমরিগো আমার লাইগবো। কী কইছি হুইনছন?

বাপডা মইরা ভালোই অইছে। অহন পথ ক্লিয়ার।
আমি রাগের গলায় বললাম, আপনি কিন্তু সীমা লংঘন করছেন!
: সায়েব চিমা-টিমা রাহেন। এটা আমাগো রাইজ্য। জন্ম আমার পাকিস্তান, কৈশোর কাইটছে চাডিয়া। আমার নয় পোলা। এক একডা বাঘের লাহান। দুইশ মাস্তান বি আছে, এক একডা হায়নার লাহান। আমি যা কই, তাই অইবো। বেশি মাতলে কাইটা-কুইটা হাওয়া কইরা দিমু, দেখাইমুনি? থানা-পুলিশ আমাগো কেনা গোলাম। যা কই তাই হুনে। ওসি আমার পালা কুত্তা।
আপনি এসব কী বলছেন? আমি আরও রেগে যাই।
কসাই মইজ্জা চিৎকার দিলেন, তোরা কে কোনাই এদিক আয়, হালার এই সায়েবটারে কুইট্টা গোরুর মাংসের সঙ্গে মিচাই দি।
কসাই মইজ্জার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চার জন লোক এসে আমাকে ঘিরে ধরল। সবার হাতে মারাত্মক সব অস্ত্র। এতগুলো লোকের চিৎকারে টুটুলের ঘুম ভেঙে গেল। সে ‘আপু’ বলে চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠল। আল্পনা-কল্পনা ভয়ে কাঁপছে।
রাকু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, স্যার, আপনি চলে যান।
: কেন?
: নইলে এরা আপনাকে মেরে ফেলবে।
: এত সহজ?
বস্তির মালিক শ্লেষ গলায় বলল, যাও মিয়া, বাঁইচতে চাইলে এহনি ভাগো। পিরিত করতে অইলে চোনারগাঁও হোটেলে চইল্যা যাও। বস্তিতে পিরিত কইরতে অইলে আমার লগে আগে চুক্তিতে আইতে হইবো।
বস্তির মালিকের হুমকি শুনে সাদা পোশাকের কয়েকজন লোক এগিয়ে এল। তাদের একজনের হাতে ওয়্যারলেস সেট। এতক্ষণ তারা নীরবে আমাদের লক্ষ করছিল।
ওয়ারলেস সেট হাতে-থাকা লোকটি আমার সামনে এসে স্যালুট দিয়ে বলল, স্যার, আমি এস আই শরীফ।
: গুড।
: আমার সঙ্গে পর্যাপ্ত ফোর্স আছে, বলুন কী করতে হবে?
পুলিশ দেখে ভয় পেয়ে গেলেন কসাই মইজ্জা। তার লোকদের সামনে নিজে নিজে কান ধরে উঠবস করতে করতে আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, স্যার,

আমার ভুল অই গেছে গা। মাফ কইরা দেইন। এই কান ধইরলাম, উঠবইস কইরছি। আর জীবনেও এমন করুম না। আপনে পুলিশের পুলিশ, ওসির বাপ এসব জাইনলে আমার নিজের মাইয়াগুলোরেও দিয়া দিতাম। স্যার গো মাফ কইরা দেইন।
আমি বললাম, শরীফ?
: জি স্যার।
: বদমায়েশগুলোকে নিয়ে যাও—
শরীফ বলল, নারী নির্যাতন, অবৈধ অস্ত্র, হত্যার চেষ্টা, চাঁদাবাজি। অস্ত্রগুলো আলামত হিসেবে যথেষ্ট।
পুলিশের লোকজন বস্তির মালিক ও অস্ত্রধারীদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ-ভ্যানে তুলে নিল। কাণ্ড দেখে আল্পনা-কল্পনা খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরল। টটুল মশারি থেকে বের হয়ে রাকুকে জড়িয়ে ধরে।
এসআই শরীফ বলল, স্যার, আমি মালামাল আমাদের গাড়িতে তুলে নেব। কী কী নিতে হবে আমাকে দেখিয়ে দিন। আমি নিয়ে আসছি। আপনি এদের নিয়ে আপনার গাড়ি করে চলে যান।
রাকু বলল, একটা বইও যেন বাদ না যায়।
১৮
এগারোটার পর ঢাকার রাস্তা কিছুটা ফাঁকা হয়ে যায়। যাত্রাবাড়ি হতে আফজল ভবনে পৌঁছতে বেশিক্ষণ লাগল না। আফজল চৌধুরী, আফজল ভবনের দোতালায় থাকেন। তিনি আমাদের প্রতীক্ষায় পায়চারি করছিলেন বারান্দায় । গাড়ির আওয়াজ শুনে কৈশোরক চঞ্চলতায় নিচে নেমে এলেন দ্রুত।
সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বললেন, নাতি-নাতনির দল, তোমাদের কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
আমি বললাম, না।
নাত-নাতনি পেয়ে আফজল চৌধুরী মহাখুশি। নিজে নিজে সবার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিলেন। ন্যাড়া মাথার নতুনদের ভালো লেগে গেছে তার। একটু পরে এলেন পুলিশ, তাদের গাড়িতে সামান্য মালামাল। পুলিশ দেখে আফজল চৌধুরী আরও খুশি। ক্ষমতাধর ভাড়াটে পেয়েছেন। কদর আরও বেড়ে গেল। আদর আর কদর ক্ষমতাসীনের পিছনে পিছনে ছুটে বেড়ানো চাকর।
আমি বললাম, দাদু, বাসাটা একটু পরিষ্কার করতে হবে; লোক পাওয়া যাবে?
: আপনি হলেন গিয়া আমার জীবন-দাতা আহমদ হোসেন স্যারের নাতি। বাসা ধুয়ে-মুছে একদম ফকফকা করে রাইখছি। ঢুইকবেন আর ঘুমাইবেন। পাটি-বালিশও দিয়েছি। যা লাগে সব দেব— শুধু বইলবেন। কেনাকাটার পর ফেরত দিয়ে দিলে হবে।
: ধন্যবাদ, দাদু।
আফজল চৌধুরী বললেন, খাবার রেডি হয়ে আছে। হাতমুখ ধুই চলি আঁইয়ুন। অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে।
নতুন বাসায় ঢুকে আল্পনা, কল্পনা আর টুটুল খুশিতে বাকবাক। আনন্দে সবার চোখে জল এসে গেল। এমন জল-কাড়া আনন্দ দেখে আমার চোখেও জল নেমে এল। টটুল তালি দিয়ে লাফাতে লাফাতে চিৎকার করছে—আল্লাহ গো, কত্তো বড়ো ঘর! আমি হুটবল খেইলব। আপু, আমার জাম্বুরাটা আইনছনি?
কল্পনা অবাক চোখে বাসার চারদিকে তাকাতে তাকাতে বলল, সোনা ভাই, তোমাকে না বলেছি সুন্দরভাবে কথা বলার জন্য? সুন্দর কথা সুন্দর মানুষ। পচা কথা পচা মানুষ।
টুটুলের আনন্দ দেখে মনে হলো আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী শিশুটির সামনে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ খেয়াল হলো, টুটুলের গায়ে কোনো পোশাক নেই। পোশাক থাকলে টুটুল কী এত খুশি হতে পারত? মনে হয়— না।
পোশাক এক প্রকার অহংকার আর অহংকার হলো সুখের মল। অহংকার ত্যাগ করাই সুখের ধর্ম। এজন্য অহংকার আর সুখ একসঙ্গে থাকতে পারে না। একসময় মানুষের কোনো অহংকার ছিল না। অহংকারই মানুষের বিভেদ-রেখার বিস্তার। যার যত অহংকার, সে তত জঘন্য জানোয়ার।
আল্পনা-কল্পনা আর টুটুলকে বাথরুমের ব্যবহার শিখিয়ে দেওয়া হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে রাকুও বাসার সবকিছু মোটামুটি দেখে নিল। আমি তাড়া দিচ্ছি তাড়াতাড়ি করতে।
টিনের বাক্স থেকে প্যান্ট বের করে পরতে গিয়ে টুটুল চিৎকার দিয়ে ওঠে, আল্লাহ গো, আমার প্যান্টটা ইঁদুরে খাইয়া ফেলেছে। আমি এখন কী পরে বেড়াতে যাব রে?
আল্পনা বলল, দুই বছরও হয়নি প্যান্টের বয়স, মাত্র দুইবার পরেছে।
কল্পনা তার ফ্রক দেখে শোকার্ত গলায় চিৎকার দিয়ে ওঠে, আপু, উইপোকা আমার ফ্রকটাও খেয়ে ফেলেছে। আল্পনা চুপ। এখন পর্যন্ত একটা কথাও সে বলেনি। তার নতুন ফ্রকটারও একই অবস্থা।
রচনা বলল, উইপোকা আর ইঁদুর কাপড় খায় না।
কল্পনা বলল, তাহলে কাটে কেন?
রচনা বলল, বাবা কী বলতেন?
আল্পনা সুর করে বলল :
উঁই আর ইঁদুরের দেখ ব্যবহার
যাহা পায় তাহা কেটে, করে ছারখার
কাঠ কাটে, বস্ত্র কাটে, কাটে সমুদয়
সুন্দর সুন্দর দ্রব্য, কেটে করে ক্ষয়।
এমন কিছু মানুষ আছে— অতি হিংস্র মতি
উঁই-ইঁদুরের মতো শুধু, করে সবার ক্ষতি।
ইদানীং ও ইদানীং-এর বিপরীতার্থক শব্দ