
কিছুক্ষণের মধ্যে হাজির হলেন ছফা। হাতে সিগারেট, কাঁধে ঝোলা-ব্যাগ।
সালাম দিয়ে বললাম, চাচা, সুলতান আংকেল কোথায়?
তার তামাকের নেশা ধরেছে। হাসনাতের অফিসেই টানা শুরু করতে চেয়েছিল। বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছি। পার্কে বসে হয়তো তামাক টানছে।
আপনার বিজিএস-এর খবর কী?
ওসব ভাতের খবর এখন থাক, রচনা কেমন আছে?
ভালো।
অফিস শেষে কোথায় যাও?
বাসায় গিয়ে লেখালেখি করি, পড়ি, গান করি— এ আর কী।
অফিসার্স ক্লাবে যাও না?
অভ্যেস নেই।
অনেক আমলার জীবন অফিস থেকে ক্লাব আর ক্লাব থেকে অফিস। মাঝখানে কিছু নেই। জীবন নয়— অসহায়ত্বের চূড়ান্ত পরিণতি।
কেন?
অফিসার্স ক্লাবে অফিসারেরা যে আলোচনা করে সেগুলো লোহার মতো— ওজনে ভারি ভারী, দামে বাসি তরকারি। আর আমরা যা বলি তা সোনার মতো। আমলাদের এক টন আমাদের এক মিলিগ্রাম।
আপনার বন্ধু হাসনাত আবদুল হাই, তিনিও তো আমলা।
হাসনাত কাঁটায় কাঁটায় চলেন। সৃজনশীল মানুষ। তার সঙ্গে কেবল সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর অন্নদাশঙ্কর রায়ের তুলনা চলে। তার ক্লাবে যাওয়ার সময় নেই। অফিসার্স ক্লাবগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
কেন?
বিলেতি অফিসারদের ক্লাব প্রয়োজন ছিল। এখন বিলেতি বেগুনের মতো বিলেতি অফিসারও নেই। ক্লাব প্রতিষ্ঠার যে কারণ ছিল সেগুলোও নেই। দিনে অফিস রাতে ক্লাব, কখন করবে সংসার, কখন করবে সৃজনশীল কাজ? সরকারের এসব দেখা উচিত। আরে ব্যাটা, ঢাকা শহরে এক মাইল যেতে দুই ঘণ্টা লাগে। আবার ক্লাব কেন? সরকারকে বলো প্রতি গাড়িতে একটা করে ক্লাব বসিয়ে দেওয়ার জন্য।
মফস্বল এলাকার অফিসারদের জন্য ক্লাব দরকার।

ঢাকার অফিসার্স ক্লাবগুলোতে কী হয় জান?
কী হয়?
ঢাকা ক্লাবে যা হয়।
আমার বন্ধু মিহিরকে রাজশাহী থেকে ঢাকায় বদলি করার জন্য হাসনাত স্যারকে অনুরোধ করতে বলেছিলাম, মনে আছে? বলেছিলেন?
ছফা সিগারেটের শেষাংশ মেঝে ছুড়ে দিয়ে বিরক্তির সঙ্গে বললেন, হাসনাত সস্তা কোনো অফিসার নয়, সে কারও তদবির শোনে না। বাংলা সাহিত্যে তাঁর আসন স্থায়ী হয়ে গেছে। এক লাখ অফিসারেও একজন হাসনাত পাবে না।
মিহিরের কষ্ট হচ্ছে রাজশাহী থাকতে।
রাজশাহী থাকতে কষ্ট হলে চাকরি ছেড়ে দিতে বলো। ঢাকায় এসে থাকুক। রাজশাহীতে মানুষ থাকে না? অফিসার থাকে না? না কি যারা রাজশাহীতে থাকে তারা মানুষ নয়?
একটু বললে এমন কী ক্ষতি চাচা?
ছফার বিরক্তি এখন রাগে, নিজের হোক, অন্যের হোক— আমি কারও জন্য কারও কাছে তদবির করা পছন্দ করি না।
আমি ছাইদানিটা ছফার সামনে ঠেলে দিয়ে বললাম, সামান্য কাজ, বললে ক্ষতি কী?
ছফা বললেন, এটা আমার দিকে ঠেলে দিলে কেন?
ছাই ফেলার জন্য।
ধূমপায়ীদের কাছে পুরো পৃথিবীটাই ছাইদানি। এত ছোটো ছাইদানিতে আমার পোষাবে না। আমি যাচ্ছি, ওয়াল্লাহ্ তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি।
বলুন।
তুমি রচনাকে নিয়ে সন্ধ্যায় চলে এসো। গুরুর কাছে যাব। সরদার ফজলুল করিমও থাকবেন। আমার গুরুকে তোমার কেমন লাগে?
গুরু মানে প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক। ছফার সঙ্গে কয়েক বার গিয়েছিলাম তার বাসায়। তাঁদের আলাপ আমার খারাপ লাগত না। তবে তেমন আকর্ষণও বোধ করতাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসের মতো নিরামিষ লাগত, বের হয়ে আসার জন্য ছটফট করতাম।
বললাম, অত ভারি আলাপ আমার ভালো লাগে না।
কুকুরের পেটে ঘি হজম হয় না। ভারি কথা বুঝার জন্য ভারি জ্ঞান দরকার। তোমার তা এখনও হয়নি। আমলাদের কলমে কালি থাকে, কোনো জ্ঞান থাকে না। অনেকটা বই বিক্রেতার বইয়ের মতো। আমলাদের কলমের কালি মানুষকে ময়লা দিতে পারে, জ্ঞান দিতে পারে না। আমার গুরুকে বুঝতে হলে আরও পড়তে হবে। তোমরা আমলা, বইকে বউয়ের মতো ভয় পাও। আমলা শব্দের আদি অর্থ জান?
বানর।
বানরের আর কী জ্ঞানই বা থাকবে! জীবনবোধ সম্পর্কে অজ্ঞ অতি সাধারণ মানের একদল বাংলা-আমলা বাংলাটাকে ডুবিয়ে ছেড়েছে।
বুদ্ধিজীবীদের কি কোনো দায় নেই?
বুদ্ধিজীবীরাই তো আমলাগুলো বানিয়েছে। নইলে ওদের তো ঘাস-কাটার যোগ্যতাও ছিল না।

সব দোষ আমাদের দিচ্ছেন কেন?
আমার ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাসে’ তুমি এর জবাব পাবে। এখন বাংলা সাহিত্যে কোনো বুদ্ধিজীবী আমার চোখে পড়ে না। যারা আছে তারা এক-একটা প্রতিবন্ধী।
হুমায়ুন আজাদ, শামসুর রাহমান, হুমায়ূন আহমেদ, আল মাহমুদ, বঙ্কিম …।
ছফা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, বাজারি লেখক হুমায়ূন আহমেদ বাজার দখল নিয়ে ব্যস্ত। সে টাকার জন্য সব করতে পারে। সে ঔপন্যাসিক হলে আমি কী?
হুমায়ুন আজাদ?
সে একটা সজারু। দেইখো, একদিন তার আত্মরক্ষার অস্ত্রই তার জন্য কলা গাছের মতো কাল হয়ে দাঁড়াবে। সজারুটা অন্যের লেখা নকল করে। নিজের বউ পর্যন্ত তাকে সহ্য করতে পারে না। তোমরা কীভাবে সহ্য কর? একটা আস্ত ইডিয়ট।
কারও বউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। আপনি বিয়ে করেননি তাই জানেন না।
তুমিও তো বিয়ে করনি, নাকি করেই ফেলেছ?
আমি হাসলাম।
ছফা বলেই চলেন, শামসুর রাহমানের বগলে রাজনীতি আর আল মাহমুদের বগলে ধর্ম— মগজে কিচ্ছু নেই। আর আমলাদের মগজ জিয়লগাছ। বেড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়। ওই জিয়লগাছগুলো ফুলফলহীন পরগাছা; পাতা ছড়িয়ে খেতে সূর্যের আলো পড়ায় বাধা দেয়। তাই কৃষক একসময় তাদের কেটে ফেলতে বাধ্য হয়।
নজরুল?
বজ্র, বিদ্যুৎ আর ফুল, এই তিনে নজরুল। অনেকে তাঁকে ফরমায়েশি লেখক বলে সমালোচনা করেন। আমরা সবাই ফরমায়েশি লেখক, কেউ বিত্তের কেউ চিত্তের। কেউ পানের আবার কেউ পানের।
আমি বললাম, নজরুল না কি এক খিলি পান দিলে গান লিখে দিতেন।
তাহলে কত বড়ো মন তাঁর চিন্তা করে দেখো।
আবুল ফজল বেশ উদার, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীলও ছিলেন, আমি বললাম।
ছোটোবেলায় আবুল ফজলের লেখা আমারও ভালো লাগত। বেশ শ্রদ্ধা করতাম। পরে দেখলাম, তিনি একজন নাস্তি-আস্তি।
এটা আবার কী? আমি প্রশ্ন করলাম।
সুবিধাবাদি। ক্ষণে আস্তিক, ক্ষণে নাস্তিক। শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে আবুল ফজল সাহেব ছিলেন নাস্তিক। জিয়া তাঁকে শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টার পদ দিলেন। ওই পদে টিকে থাকার জন্য তিনি ফাক্কা হুজুর হয়ে গেলেন। টুপি মাথায় দিয়ে সিরাত মজলিশে গিয়ে শরীর দুলিয়ে দরুদ পড়তেন।
বললাম, আপনার গুরু রাজ্জাক তো কোনো লেখকই না। শুধু গ্রাম্য মাতবরের মতো বড়ো বড়ো কথা বলেন।

গণ্ডমূর্খের মতো কথা বলো না। আমার গুরুর মতো জ্ঞানী পৃথিবীতে বিশটাও পাবে না। ডিক উইলস তাঁর বিখ্যাত ‘এশিয়া অ্যাওয়েকস’ পুস্তকটি রাজ্জাক স্যারকে উৎসর্গ করেছেন। রবীন্দ্রনাথকেও দেননি।
লোকে বলে তিনি নাকি কিছুই জানেন না?
আমার কথা শুনে ছফা ক্ষেপে গেলেন, তুমি আমার বাসায় আর কখনো যাবে না, ফোনও করবে না। আমি তোমাকে চিনি না, তুমিও আমাকে চিন না। রাজ্জাক স্যারকে তুমি চিনতে পারনি, আমাকে চিনবে কীভাবে? তাকে বোঝার মতো লোক বাংলাদেশে দশটাও নেই। তুমি তো তেলেপোকা।
আমি হেসে বললাম, সরি চাচা, আপনার জন্য এক কাটুন রোথম্যান এনেছিলাম।
দাও।
বাসায় কখন যাব?
সিগারেটের সঙ্গে কিন্তু সম্পর্কের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি না-বলছি, তুমি যাবে না আমার বাসায়।
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম সম্পর্কে কিছু বলে যান?
সম্রাট আবার কী? যেখানে সম্রাট সেখানে রাজনীতি, সাহিত্য আসবে কোত্থেকে? ‘উপকারীকে ল্যাঙ মারা’ বলে একটা কথা আছে। বঙ্কিম ছিলেন সেরকম ল্যাঙ মারা লোক। একটা আস্ত অকৃতজ্ঞ, অকৃতজ্ঞদের সোজা ভাষায় ভণ্ড বলা যায়।
তিনি কী করেছেন?
মুসলিম দানবীর মুহসিন-ফান্ডের টাকায় লেখাপড়া করেছেন। তারপর সাহিত্যে মুসলিমদের ল্যাঙ মেরে, আজেবাজে কথা বলে উপকারীর ঋণ শোধ করেছেন। আমি আসি। পরে কথা হবে।
আর একটু বসুন।
না যাই। সুলতান আবার কার সঙ্গে কী অঘটন ঘটিয়ে বসে।
আমি কয়টার দিকে যাব?
ছয়টার যেন বেশি না হয়। গাড়ি নিয়ে এসো। যদি না আসতে পার তাহলে আমি চলে যাব তোমার বাসায়। রান্নাবান্না করে রাখবা। রচনাকে আমার দোয়া দিও।
ইদানীং ও ইদানীং-এর বিপরীতার্থক শব্দ