ড. মোহাম্মদ আমীন
খান স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমার রুমে ঢুকলাম। ‘আমার রুম’ বলা ঠিক হবে না, সাময়িকভাবে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছে। নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ হলে আমাকে চট্টগ্রাম অফিসে চলে যেতে হবে।
রাকু তখনও বসে আছে।
এখনো তার দুচোখে জড়িয়ে আছে কষ্ট। চাউনিটা শীতল, চোখের গভীরতায় শঙ্কা। তবু কপালের দৃঢ়তায় কঠোর সাহস নিয়ে লড়ে যেওয়ার ইঙ্গিত।
: এই মেয়ে, কী হয়েছে, মিইয়ে আছ কেন?
: স্যার, চাকরিটা আমাকে দেবেন। দেবেন তো?
: তোমাদের বাসা ভাড়া কত দিতে হয়?
: বাসা নয় স্যার।
: কী?
: একটা রুম।
: ভাড়া কত?
: এক হাজার টাকা।
: আয়তন কত?
: আপনার রুমের চেয়ে ছোটো।
ত্রিশ বর্গফুটও হবে না আমার রুম। এরকম একটা কক্ষে পাঁচজন থাকে। আমি রাকুর দিকে তাকাই। তার চেহারায় বস্তিত্বের কোনো অস্তিত্ব দেখলাম না। চোখে অগণিত সম্ভাবনার বিচ্ছুরণ। প্রতিভার এ বিচ্ছুরণ আমাকে টানছে প্রবল স্নেহে।
: এই মেয়ে?
: স্যার।
: এখন কী কিছু কর?
: এক বৃদ্ধার বাসায় আট ঘণ্টা ঝি-কাম ধাত্রীর কাজ করি। দৈনিক চল্লিশ টাকা, একবেলা খাওয়ায়।
: তোমাকে কিন্তু অভিজাত ঘরের মেয়ে মনে হয়।
: এমন অনেকেই বলেন। বুড়ির বাসার একবেলা খাওয়ারই আমার শরীরটাকে বস্তির জন্য বেমানান করে দিয়েছে। আল্পনা-কল্পনা আর টুটুলকে দেখলে

মনে হবে কঙ্কালভূত। খাওয়ারটা বুড়ির বাসায় না-খেয়ে বাসায় নিয়ে আসার অনুমতি চেয়েছিলাম। বুড়ির বিধবা বোন বলেছিলেন, যা নেবে পেটে করে নেবে। হাতে করে কিছু আনতেও পারবে না, নিতেও পারবে না। চুরি করার মওকা খোঁজো, বুঝি না। বাসায় গিয়ে অন্যদের খাওয়াবে, নিজের শরীর ভেঙে পড়বে আর অসুস্থতার কথা বলে কাজে ফাঁকি দেবে— তা হবে না।
কথায় কথায় জল এসে গেল তার চোখে। চোখে জল আসতে বৃষ্টি লাগে না, মেঘও লাগে না; মনই যথেষ্ট। আমি তার চোখের জলের দিকে তাকিয়ে চেয়ারে বসতে গিয়ে প্যান্টের পকেটে থাকা মানিব্যাগের সঙ্গে টেবিলের ধাক্কা লাগে। মোটা হলে মানিব্যাগ এভাবে ধাক্কায়। নইলে চুপচাপ থাকে। এটাকেই হয়তো টাকার গরম বলে। পকেটে হাত দিলাম। ম্যানিব্যাগটা আসলেই বেশ নাদুস-নুদুস। সকালে প্রকাশক একগাদা টাকা দিয়ে গেছেন। পত্রিকা থেকেও এসেছে তিনটা চেক। সবগুলো মানিব্যাগে ভরেছি।
এত টাকা দিয়ে আমি কী করব?
আমার প্রশ্নে আমিই অবাক হয়ে গেলাম। আসলে আমার টাকা খরচ করার জায়গা নেই। তবু বুঝতে পারি না, মানুষ কেন টাকার জন্য পাগল হয়ে যায়। বেতন যা পাই তা দিয়েই দিব্যি চলে যাচ্ছে। তার ওপর আছে পত্রিকায় কলাম লেখার টাকা, বইয়ের সম্মানি আর অনুবাদ বাবদ ফর্মা-ভিত্তিক চুক্তির অর্থ। এডিটিং তো আছেই। সব খরচ গিয়েও প্রতিমাসে বেশ কিছু টাকা থেকে যায়।
: এই মেয়ে?
: স্যার, চাকরিটা আমার হবে তো?
মানিব্যাগ থেকে একশ টাকার বিশটি নোট বের করে মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিলাম, নাও।
টাকাগুলো নিয়ে আমার পা দুটো ছুঁয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়াল, স্যার, আমার চাকরিটা?
: কাল ফার্স্ট আওয়ারে এসো। দেখি কী করা যায়।
: স্যার।
: বলো।
: টাকাগুলো নিতে খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি বাস্তবতাকে এড়াতে পারি না। তাই লজ্জার মাথা খেয়ে নিয়ে নিলাম। প্রয়োজন কোনো কিছু মানে না, এমনকি লজ্জাও। ঘুমানোর জন্য টাকাগুলো নিতে হলো।
: টাকার সঙ্গে ঘুমের সম্পর্ক কী?
: বাবা চিৎকার করবেন না। ওষুধ খেয়ে আরামে ঘুমাতে পারবেন। তিনি আরামে ঘুমাতে পারলে আমাদেরও আরামে ঘুম হবে।
: এখন যাও। কাল এসো। দেখি কী করা যায়।
রাকু বলল, স্যার, আপনার এ টাকা হতে একশ টাকা মাছ কেনার জন্য খরচ করব। ছোটো মাছ। অনেক দিন থেকে ছোটো ভাইটা বড়ো মাছ খেতে চাইছে।
: বড়ো মাছ নেবে না কেন?
: বড়ো মাছ কিনতে হলে বড়ো টাকা লাগে। আমরা ছোটো মানুষ, ছোটো মাছ পেলে খুশিতে মন ভরে যায়। গরিবের মাছের আবার জাত কী!
এমনভাবে সে কথাগুলো বলছিল, আমার বুকে যেন কেউ পাথর ছুঁড়ে মারছে। মানুষের অভাব কত কঠিন হলে সামান্য প্রাপ্তিতে মনটা এত ঘেমে যায়!
রাকু চলে যাবার জন্য উঠলেও স্থির দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। হাতে প্রচুর কাজ জমা পড়ে আছে। মেয়েটা বের হলে শুরু করব। রাকু তার একগোছা চুল কপোল হতে কানের উপর তুলে দিতে দিতে বলল, স্যার, একটা কথা বলব?
: বলো।
: মনে হতো মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব নয়, মনে হতো সর্বনিকৃষ্ট। এখন বুঝলাম— কিছু কিছু মানুষের জন্য মানবজাতি সৃষ্টির সেরা দাবি করতেই পারে। “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।”
আমার ঠোঁটজোড়া বিড়বিড়িয়ে ওঠে শব্দহীন প্রকাশে, তোমার প্রশংসায় শ্রদ্ধা আছে, কৃতজ্ঞতা আছে, সর্বজনীনতা আছে। অনেক বড়ো হবে তুমি, অনেক বড়ো হতে হবে তোমাকে। মুখে বললাম, তোমা অনেক দূর যেতে হবে।
রাকু তার কণ্ঠকে একটু নামিয়ে বলল, স্যার, আমি যত শিখরে যাই না কেন, শেকড় কখনো ভুলব না। রবীন্দ্রনাথ আমাকে ওই কথাই স্মরণ করিয়ে দেন-
যত বড়ো হোক ইন্দ্রধনু সে
সুদূর আকাশে আঁকা,
আমি ভালোবাসি মোর ধরণীর
প্রজাপতিটির পাখা।
তাই হওয়া উচিত, আমি বললাম, “শেখর ডালপাতা নিয়ে জলরাজ্য মেঘ ভেদ করতে পারে, কিন্তু খাদ্য তৈরির প্রয়োজনীয় জল নিতে হলে মাটির নিচে অবস্থিত শিকড়ের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ অনিবার্য। শিকড়চ্যুত শেখর শুকনো পাতার বিবর্ণ ইতিহাস, ভবিষ্যৎ যার পচন; মৃত্যু আর জড়ত্ব।
ইদানীং ও ইদানীং-এর বিপরীতার্থক শব্দ