ইউসুফ খান
হুনুরে চীন আর হুজ্জুতে বাঙাল
হুতোম প্যাঁচার নকশায় আছে ‘সাধারণে কথায় বলেন ‘হুনরে চীন’ ও ‘হুজ্জুতে বাঙ্গাল’ কিন্তু হুতোম বলেন হুজুকে কল্কেতা।’ হুতোমের দিনকালে এসব কথার মানে সর্বসাধারণে বুঝত, ‘সাধারণে কথায় বলেন’। হুতোমের ভাষা কলকাতার মুখের ভাষা ছিল। তারপর ফোর্ট উইলয়ামকে মাঠে নামিয়ে ফারসির ব্যাপক বিদায় ঘটালে এসব শব্দ প্রাচীন পুঁথিতে মুখ লুকোল। এসবের মানে বুঝতে এখন আমাদের সেকেলে অভিধান হাতড়াতে হয়।
হক হুজাজ হুজ্জত
আরবি حق হক অর্থ সত্য, ন্যায়, حجج হুজাজ মানে যুক্তি প্রমাণ, حخت হুজ্জত মানে যুক্তি, তর্ক, ন্যায়, সত্যসন্ধান। ন্যায়শাস্ত্র ও তর্কশাস্ত্রের যে তর্ক তাকে বলা হয় হুজ্জত। সবাই মান্য দেয় যে কথাটায় তাকে নিয়ে কোনও হুজ্জত নেই, কিন্তু কোনও কিছুর মান্যতা নিয়ে মতানৈক্য থাকলে সবপক্ষ বসে হুজ্জত করে বিতর্কের মীমাংসা করা হয়,

যুক্তি দিয়ে শান্তিপূর্ণ ভাবে। হুজ্জতি حختی মানে নৈয়ায়িক। আরবিতে হুজ্জত শব্দের এই সাধারণ অর্থটার গুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় – তর্কে অকাট্য প্রমাণ দিয়ে বিপক্ষের মুখ বন্ধ করে দেওয়া। বাংলায় যত দিন গেছে মানেটা লঘু থেকে লঘুতর হয়েছে। বাংলায় প্রথম দিকে হুজ্জত মানে ছিলো সাধারণ তর্কবিতর্ক কথা-কাটাকাটি তুই-ভুল-আমি-ঠিক গোত্রের বাক্যালাপ। কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বাঙ্গালীর মেয়ে’ কবিতায় বাঙালি মেয়েদের সম্পর্কে বলেছেন:
‘নিজে ঘাটে, অন্যে দোষে, মুখসাপটে দড়,
হুজ্জুতে হারিলে কেঁদে পাড়া করে জড়’
এখন বাংলায় হুজ্জত-এর মানে দাঁড়িয়েছে – হুজ্জুতি গাজোয়ারি ফালতু তর্ক করে ঝামেলা বাড়ানো, দরকারে হাত পা চালিয়ে দেওয়া।
হুজ্জুতে বাঙ্গাল
দেশভাগের আগে থেকেই পূর্ববঙ্গের বাঙালদের সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের ঘটিদের প্রাথমিক ধারণা ছিল যে, বাঙালরা কুচুটে ঝগড়ুটে হুজ্জত-করার ঝামেলা-বাঁধানোর লোক। বাঙালরা পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে দরকার হলে কোর্ট কাছারি পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়ে নিরীহ শান্তিপ্রিয় ঘটিদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে। বিশেষ করে সেট্লার বাঙালদেরকে ঘটিরা উৎকট উপদ্রব ঠাউরাতো। চাপা আতঙ্কে থাকত, কোনও বাঙাল যেন আবার তার পাশে বসত না বসায়। ঘটি বাড়িতে ভায়ে-ভায়ে উত্তুঙ্গ ঝগড়ার সময়ে সিরিয়াসলি বলতে শুনেছি – তোর ভিটেয় আমি বাঙাল বসিয়ে ছাড়ব। ঘটিদের লবজ-য় ‘ভিটেয় বাঙাল বসানো’ কথাটা বংশ ধ্বংসের অভিসম্পাতের একটা ইডিআম। ‘হুজ্জুতে বাঙাল’ ঘটিদের বিশ্বাসের উচ্চারণ।
কারও কারও দাবি ‘হুজ্জতে বাঙ্গাল হুনরে চীন’ কথাটা প্রথম বলেন বাদশা জাহাঙ্গির। মূল উর্দুতে মুহাবরা-টা ছিলো ‘হুজ্জত-এ বাঙ্গাল হিক্মত-এ আফগান’ বা ‘হুজ্জতে বাঙ্গাল হিক্মতে চীন’। এটা মুজতবার লেখাতেও আছে। মানে কুটতর্কে বাংলা আর কায়দা কৌশল ফন্দিতে চীন সেরা। অর্থাৎ মূল প্রবাদটাতে বঙ্গদেশ আর চীনদেশের কথা বলা হয়েছে, কোনও বাঙাল-ঘটির কথা হচ্ছে না। ঘটিরা বুঝে বা না বুঝে এটাকে বাঙাল বদনামের কাজে লাগিয়ে দিয়েছে।
বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানো
বাঙালরা কথায় কথায় লোকজনকে কেস দিয়ে কোর্টে নিয়ে যায়, তাই সব কোর্ট তার ঘোরা আছে চেনা আছে, তাকে নতুন করে দেখানোর কিছু নেই। হাইকোর্ট বাঙালের মামাবাড়ির মতো, তাই মায়ের কাছে মামাবাড়ির গল্প বলতে যাওয়ার মতো, বাঙালকে হাইকোর্টের কথা বলে ভয় দেখানো বাতুলতা, মামলাবাজ বাঙাল হাইকোর্টকে ভয় পায় না। ঘটি ভাষ্যে ‘বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানো’ বাগধারাটার এই মানে।
উৎস: হুনুরে চীন আর হুজ্জুতে বাঙাল, ইউসুফ খান, কলকাতা, ২০২০ সেপ্টেম্বর ১১।