হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় : বাংলা সাহিত্যে স্বাধীনতার প্রথম কবি

ড. মোহাম্মদ আমীন

হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় : বাংলা সাহিত্যে স্বাধীনতার প্রথম কবি

হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়  ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই এপ্রিল  রাজবলহাটের নিকট গুলাটিয়া গ্রামে কুলীন ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস  ছিল হুগলীর উত্তরপাড়া গ্রামে। হয় তার। তিনি হিন্দু কলেজের ছাত্র এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। মধুসূদন পরবর্তী কাব্য রচয়িতাদের মধ্যে তিনিই সে সময় সবচেয়ে খ্যাতিমান কবি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বাংলা মহাকাব্যের ধারায় হেমচন্দ্রের বিশেষ দান হচ্ছে স্বদেশ প্রেমের উত্তেজনা সঞ্চার। 

পিতার মৃত্যুতে আর্থিকভাবে অসহায় হয়ে পড়েন।  ১৮৫৩  খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী  হেমচন্দ্রকে কলকাতার হিন্দু কলেজে সিনিয়র স্কুল বিভাগের দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দেন। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে  জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে মাসিক দশ টাকা বৃত্তি লাভ করেন। একই বছর তিনি কলকাতার ভবানীপুর নিবাসী কালীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা কামিনী দেবীর সংগে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সিনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করে দুই বছরের জন্য মাসিক পচিশ টাকা বৃত্তি লাভ করেন। চতুর্থ বার্ষিক শ্রেণিতে পাঠকালে বৃত্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন ছেড়ে দেন।

১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে হেমচন্দ্র মিলিটারি অডিট অফিসে কেরানি পদে চাকরি গ্রহণ করেন । পরে ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমির প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে এল এল ডিগ্রি অর্জনের পর কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করেন এবং ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে মুন্সেফ পদ পান। কয়েক মাস পরে তিনি পুনরায় হাইকোর্টে ওকালতিতে ফিরে এসে ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বিএল পাশ করেন। এপ্রিল ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে তিনি সরকারি উকিল নিযুক্ত হন।

১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে এডুকেশন গেজেট পত্রিকায় হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভারত সঙ্গীত’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে তিনি সরকারের রোষানলে পড়েন। একই সঙ্গে পত্রিকার সম্পাদক ভূদেব মুখোপাধ্যায়কেও সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। এই কবিতায় স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষভাবে ভারতবাসীকে অধীনতার পাশ থেকে মুক্ত হবার আহ্বান জানানো হয়। প্রকৃতপক্ষে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথম কবি যিনি সমগ্র স্বাধীন ভারতের এক সংহতিপূর্ণ চিত্র দেখেছিলেন। ভারত সঙ্গীত কবিতাকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম স্বাধীনতার কবিতা বলা হয়। এটি বাংলা সাহিত্যে জাতিধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে অখণ্ড ভারত-স্বপ্ন কবিতা নামেও খ্যাত। জীবন সঙ্গীত হেমচন্দ্র রচিত বিখ্যাত একটি কবিতা।  এটি বাংলা সাহিত্যে কয়েকটি জনপ্রিয় কবিতার অন্যতম।

হেমচন্দ্রের প্রথম কাব্য চিন্তাতরঙ্গিনী (১৮৬১) এবং সর্বাধিক প্রসিদ্ধ রচনা বৃত্রসংহার কাব্য (১৮৭৫-৭৭ দুই খণ্ড) এই কাব্যগ্রন্থে তিনি পৌরাণিক কাহিনীর সাহায্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আহ্বান জানিয়েছিলেন।  তার অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ: বীরবাহু (১৮৬৪),  আশাকানন (১৮৭৬), সাঙ্গরূপক কাব্য, ছায়াময়ী (১৮৮০), বিবিধ কবিতা (১৩০০) ও  দশ মহাবিদ্যা(১৮৮২) ।

তিনি ১৯০৩  খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে মে কলকাতার খিদিরপুরে মারা যান।

 

জীবন সঙ্গীত
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
বলো না কাতর স্বরে,                বৃথা জন্ম এ সংসারে
   এ জীবন নিশার স্বপন,
দারা পুত্র পরিবার,                   তুমি কার কে তোমার
      বলে জীব করো না ক্রন্দন;
মানব-জনম সার,                  এমন পাবে না আর
         বাহ্যদৃশ্যে ভুলো না রে মন;
কর যত্ন হবে জয়,                জীবাত্মা অনিত্য নয়
       ওহে জীব কর আকিঞ্চন ।
করো না সুখের আশ,           পরো না দুখের ফাঁস,
            জীবনের উদ্দেশ্য তা নয়,
সংসারে সংসারী সাজ,         করো নিত্য নিজ কাজ,
            ভবের উন্নতি যাতে হয় ।   
দিন যায় ক্ষণ যায়,             সময় কাহারো নয়,
            বেগে ধায় নাহি রহে স্থির,
 সহায় সম্পদ বল,                 সকলি ঘুচায় কাল
           আয়ু যেন শৈবালের নীর ।
 সংসার-সমরাঙ্গনে               যুদ্ধ কর দৃঢ় পণে,
        ভয়ে ভীত হইও মানব;
কর যুদ্ধ বীর্যবান,                যায় যাবে যাক প্রাণ
          মহিমাই জগতে দূর্লভ ।
 মনোহর মূর্তি হেরে,             ওহে জীব অন্ধকারে,
               ভবিষ্যতে করো না নির্ভর;
 অতীত সুখের দিন,             পুনঃ আর ডেকে এনে,
           চিন্তা করে হইও না কাতর ।
 মহাজ্ঞানী মহাজন,           যে পথে করে গমন,
         হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়,
 সেই পথ লক্ষ্য করে            স্বীয় কীর্তি ধ্ব্জা ধরে
         আমরাও হব বরণীয় ।
 সমর-সাগর-তীরে,            পদাঙ্ক অঙ্কিত করে
       আমরাও হব হে অমর;
 সেই চিহ্ন লক্ষ করে,           অন্য কোনো জন পরে,
        যশোদ্বারে আসিবে সত্বর ।
 করো না মানবগণ,          বৃথা ক্ষয় এ জীবন
         সংসার সমরাঙ্গন মাঝে;
সঙ্কল্প করেছ যাহা,            সাধন করহ তাহা,
           রত হয়ে নিজ নিজ কাজে ।
দিন যায়, ক্ষণ যায়,             সময় কাহারো নয়,
           বেগে ধায়, নাহি রহে স্থির,
সহায় সম্পদ বল,                সকলি ঘুচায় কাল,
            আয়ু যেন শৈবালের নীর ।
        জাতি-দেশ-বর্ণ ভেদ ধর্ম ভেদ নাই ।
শিশুর হাসির কাছে,      সবি প’ড়ে থাকে পাছে,
      যেখানে যখন দেখি তখনি জুড়াই।
ভারত সঙ্গীত

কোরাস
ভারতবর্ষ আমার জন্মভূমি, মাটি আমার মা।
ভারতবর্ষ আমার স্বপ্ন-স্মৃতির জীবন সাধনা।
ভারতবর্ষ আমার মাতৃভূমি, মাটি আমার স্বর্গ,
ভারতবর্ষ আমার পূণ্যভূমি, সারাজীবনের গর্ব।

গীত
ভারতের বুকে চলেছে বয়ে, গঙ্গা ও যমুনা,
ওপার বাংলায় বইছে যেমন, পদ্মা ও মেঘনা।
উঁচু হিমালয়ের মতোই, আমাদের উঁচু মাথা।
ভারতবাসীর গর্ব আজিকে, তিনি ভারতমাতা।

কোরাস
ভারতবর্ষ আমার জন্মভূমি, মাটি আমার মা।
ভারতবর্ষ আমার স্বপ্ন-স্মৃতির জীবন সাধনা।
ভারতবর্ষ আমার মাতৃভূমি, মাটি আমার স্বর্গ,
ভারতবর্ষ আমার পূণ্যভূমি, সারাজীবনের গর্ব।

গীত
সাগরের জলে, ধুয়ে মুছে যায়, জাতির যত গ্লানি,
আমরা বীর ও বাঙালীর জাত, শরমে মরম মানি।
মানিনা হিন্দু, মানিনা মুসলিম, একটাই জাতি আছে।
জাত বিদ্রোহী, ভারতবাসী, দু’হাতেই কৃপাণ নাচে।

কোরাস
ভারতবর্ষ আমার জন্মভূমি, মাটি আমার মা।
ভারতবর্ষ আমার স্বপ্ন-স্মৃতির জীবন সাধনা।
ভারতবর্ষ আমার মাতৃভূমি, মাটি আমার স্বর্গ,
ভারতবর্ষ আমার পূণ্যভূমি, সারাজীবনের গর্ব।

গীত
জ্বালাও আগুন দিকে দিকে, আগুন জ্বলুক চক্ষে,
ভীরু ও দুর্বল কাপুরুষ নই, আছে দুঃসাহস, বক্ষে।
শত্রুর সাথে করি লড়াই, অস্ত্র ধরতে জানি সবাই।
গঙ্গা নদীর বসে কিনারায়, ভারতের জয়গান গাই।

কোরাস
ভারতবর্ষ আমার জন্মভূমি, মাটি আমার মা।
ভারতবর্ষ আমার স্বপ্ন-স্মৃতির জীবন সাধনা।
ভারতবর্ষ আমার মাতৃভূমি, মাটি আমার স্বর্গ,
ভারতবর্ষ আমার পূণ্যভূমি, সারাজীবনের গর্ব।

 

শুবাচ গ্রুপের লিংক: www.draminbd.com
তিনে দুয়ে দশ: শেষ পর্ব ও সমগ্র শুবাচ লিংক
 
Total Page Visits: 665 - Today Page Visits: 1

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Language
error: Content is protected !!