Warning: Constant DISALLOW_FILE_MODS already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 102

Warning: Constant DISALLOW_FILE_EDIT already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 103
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়: আধুনিক বাংলা গানের বিস্ময় – Dr. Mohammed Amin

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়: আধুনিক বাংলা গানের বিস্ময়

ড. মোহাম্মদ আমীন

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়: আধুনিক বাংলা গানের বিস্ময়

জন্ম জন্মস্থান : আধুনিক বাংলা গান ও রবীন্দ্র সংগীতের  খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পী, চলচ্চিত্রের নেপথ্য কণ্ঠপ্রদায়ক, বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক, সুরকার এবং  প্রযোজক ও পরিচালক  হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই জুন  পবিত্র বারাণসী শহরে মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে সেপ্টেম্বর মারা যান। তাঁর পিতার নাম কালিদাস মুখোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম কিরণবালা দেবী।

পৈত্রিক নিবাস:  হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মাতামহ ছিলেন খ্যাতিমান চিকিৎসক।  পৈতৃক নিবাসপৈতৃক নিবাস ছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জয়নগরে। তাঁর পরিবার ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কলকাতা শহরে আগমন করে।

ছাত্রজীবন অধ্যয়ন ও সংগীত জগতে প্রবেশ:  নাসিরুদ্দিন স্কুলে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের সূচনা। এরপর ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে অধ্যয়ন করেন।  সেখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় পরবর্তী জীবেনে খ্যাতিমান কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং লেখক সন্তোষ কুমার ঘোষের সঙ্গে। ওই সময় হেমন্ত ছোটো গল্প লিখতেন, সন্তোষ কুমার কবিতা লিখতেন এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায় গান গাইতেন। ইন্টারমিডিয়েট পাস করে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান। কিন্তু সংগীতের মোহে পড়ে ইঞ্জিনিয়ারিং অধ্যয়ন ছেড়ে দেন। অবশ্য প্রথমে তাঁর ইচ্ছা ছিল সাহিত্যিক হওয়ার।  কিছুদিন  দেশ পত্রিকায় লিখেছিলেন। তবে  ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তিনি সম্পূর্ণভাবে সংগীত জগতে আত্মনিয়োগ করেন।

পরিবার: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়রা তিন ভাই এবং এক বোন।  বড়ো ভাই তারাজ্যোতি ছোটো গল্প লিখতেন। ছোটো ভাই অমল মুখোপাধ্যায় গায়ক। তিনি কিছু বাংলা চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছিলেন।  তাঁর গান ‘এই পৃথিবীতেই সারাটা জীবন’। নামকরা চলচ্চিত্র: হসপিটাল এবং অবাক পৃথিবী। তিনি ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের দশকে কিছু গান রেকর্ড করেছিলেন এবং জীবনের অনেকটা পথ একলাই, হেমন্তের এই গানে খুবই স্মরণীয় সুরও দিয়েছিলেন। বোনের নাম নীলিমা।

বিবাহ সন্তান-সন্ততি: হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে সংগীত শিল্পী বেলা মুখোপাধ্যায়ের (মৃত্যু: ২৫শে জুন ২০০৯) সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দেকাশীনাথ বাংলা চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক পঙ্কজ মল্লিক বেলাকে দিয়ে কিছু জনপ্রিয় গান গাইয়েছিলেন। তবে   বিবাহের পর বেলা আর সংগীত জগতে প্রবেশ করেননি। তাঁদের দুই সন্তান — পুত্র জয়ন্ত এবং কন্যা রাণু। রাণু মুখোপাধ্যায় ১৯৬০-এর  দশকের শেষে এবং ১৯৭০-এর দশকের প্রথমদিকে গান গাইতেন। জয়ন্ত ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের দশকের জনপ্রিয় ভারতীয় অভিনেত্রী মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

হেমন্ত কুমার প্রথম ও প্রধান:  হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আঠেরো বছর বয়সে  প্রথম নিজের লেখা গানে নিজে সুর করেন।  চলচ্চিত্রে নেপথ্য গায়ক হিসেবে প্রথম গান করেন ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে হরিপ্রসন্ন দাসের সংগীত পরিচালনায় ‘নিমাই সন্ন্যাস’ চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্রে প্রথম সুরারোপ করেন ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে, হেমেন গুপ্ত পরিচালিত ‘অভিযাত্রী’ ছায়াছবিতে। এই ছবিতে চারটি রবীন্দ্রসংগীত ছিল। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি  অন্য একটি ছবির ছটি গানে সুরারোপ করেন।  তন্মধ্যে হেমন্ত নিজে গেয়েছিলেন (একটি সহশিল্পী সহ) দুটি। এই ছবিতে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের গীতিকার হিসেবে সিনেমায় অভিষেক ঘটে।

গানের প্রথম রেকর্ড:  ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সহায়তায় আকাশবাণীতে প্রথম গান রেকর্ড করেন। গানের প্রথম পঙ্‌ক্তি ছিল ‘আমার গানেতে এলে নবরূপী চিরন্তনী’।

ছোটো পঙ্কজ: সংগীতজীবনের প্রথম দিকে  হেমন্ত মুখোপাধ্যায়  প্রখ্যাত গায়ক পঙ্কজ মল্লিককে অনুসরণ করতেন। এজন্যে তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ডাকনাম ছিল ‘ছোটো পঙ্কজ’। 

প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড:  ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে কলাম্বিয়ার লেবেলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশ করেন। চলচ্চিত্রের বাইরে রেকর্ডের ওই গানগুলো ছিল ‘জানিতে যদি গো তুমি’ এবং ‘বলো গো বলো মোরে’। গানগুলোর গীতিকার ও সুরকার ছিলেন যথাক্রমে  নরেশ ভট্টাচার্য এবং  শৈলেশ দত্তগুপ্ত। এরপর থেকে ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রতিবছর গ্রামোফোন কোম্পানি অব ইন্ডিয়ার (জিসিআই) জন্যে ধারাবাহিকভাবে চলচ্চিত্রের বাইরে হেমন্তের রেকর্ড প্রকাশ করা হতো।

প্রথম হিন্দি গান: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রেকর্ডকৃত প্রথম হিন্দি গান ‘কিতনা দুখ ভুলায়া তুমনে’ এবং ‘ও প্রীত নিভানেওয়ালি’। গান-দুটো ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে জিসিআইয়ের কলাম্বিয়া লেবেলে প্রকাশিত হয়েছিল। গানগুলোর সুরকার ছিলেন কমল দাশগুপ্ত; বাণী লিখেছিলেন ফৈয়াজ হাসমি। হেমন্ত মুখোপাদ্যায় হিন্দি সংগীত জগতে হেমন্ত কুমার নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন।

চলচ্চিত্রে প্রথম গান:  ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা চলচ্চিত্র নিমাই সন্যাস  চলচ্চিত্রে হেমন্ত প্রথম গান গেয়েছিলেন। সংগীত দিয়েছিলেন হরিপ্রসন্ন দাস। তিনি জীবদ্দশায় দেড়শটির অধিক বাংলা চলচ্চিত্রের বিভিন্ন গানে সুর দিয়েছেন এবং নিজে গান করেছেন।

প্রথম সুর-প্রদান:  ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে চলচ্চিত্রের বাইরে বাংলা গানে হেমন্ত নিজে প্রথম দুটি গানে সুর দিয়েছিলেন। গান-দুটো হলো: ‘কথা কোয়োনাকো শুধু শোনো’ এবং ‘আমার বিরহ আকাশে প্রিয়া’।  এগুলোর বাণী লিখেছিলেন অমিয় বাগচি।১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে পণ্ডিত অমরনাথের সংগীত পরিচালনায় তিনি ইরাদা (১৯৪৪ চলচ্চিত্র) চলচ্চিত্রে প্রথম হিন্দি গানগুলো গেয়েছিলেন।

প্রথম রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড : ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রিয় বান্ধবী বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁর প্রথম রবীন্দ্র সংগীত রেকর্ড করা হয়। গানটা ছিল ‘পথের শেষ কোথায়’। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দেই তিনি কলাম্বিয়া লেবেলের অধীনে চলচ্চিত্রের বাইরে প্রথম রবীন্দ্র সংগীত রেকর্ড করেন। গানগুলো ছিল ‘আমার আর হবে না দেরি’ এবং ‘কেন পান্থ এ চঞ্চলতা’। এর আগে তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো/আকাশবাণীতে আমার মল্লিকাবনে রেকর্ড করেছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রেকর্ডটা বিস্মৃতিতে চলে গিয়েছে।১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের মার্চে কলকাতায় দেবব্রত বিশ্বাসের (১৯১১-১৯৮০) সম্মানে হেমন্ত এক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন; ওই অনুষ্ঠানে কিংবদন্তি রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস নিঃসংকোচে বলেছিলেন যে, হেমন্ত হচ্ছে রবীন্দ্র সংগীতকে জনপ্রিয় করে তোলার ‘দ্বিতীয় নায়ক’, প্রথম জন হলেন কিংবদন্তি পঙ্কজ কুমার মল্লিক।

সংগীত পরিচালক: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়  ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে সংগীত পরিচালক হিসেবে প্রথম বাংলা চলচ্চিত্রে পদার্পন করেন। চলচ্চিত্রটির নাম ছিল অভিযাত্রী।  

হলিউডে হেমন্ত:  হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কনরাড রুকসের সিদ্ধার্থ চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক ছিলেন। তিনি ওই চলচ্চিত্রে নেপথ্য গায়ক হিসেবে ”ও নদীরে…” (সংগীত এবং কণ্ঠ তাঁর ”নীল আকাশের নীচে” থেকে) গেয়েছেন। হেমন্ত হলিউডে নেপথ্য গায়ক হিসেবে গান করা প্রথম ভারতীয়।

সামসময়িক শিল্পী: বাংলায় তাঁর সামসময়িক পুরুষ সংগীত শিল্পীরা ছিলেন জগন্ময় মিত্র, রবীন মজুমদর, সত্য চৌধুরী, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য, সুধীরলাল চক্রবর্তী, বেচু দত্ত এবং তালাত মাহমুদ।

 হেমন্ত-সলিল:  হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে চলচ্চিত্রের বাইরে  গাঁয়ের বধূ গানটি রেকর্ড   করেন। দু-পিঠের ৭৮ আরপিএম ছ-মিনিটের ওই ডিস্ক রেকর্ডের গানটি বাংলা গানের জগতে ভিন্ন ধারার অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।  এই গান হেমন্ত এবং সলিল চৌধুরীকে পূর্ব ভারতে এক অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল।

মুম্বাই গমন:  হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আনন্দমঠ নামে প্রথম হিন্দি চলচ্চিত্রে সুরসৃষ্টির আমন্ত্রণ পান।ওই আমন্ত্রণে সড়া দিয়ে ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে মুম্বাই যান  এবং ফিল্মিস্তান স্টুডিয়োতে যোগ দেন। আনন্দমঠ (১৯৫২) চলচ্চিত্রের সংগীত মাঝারি সাফল্য পেয়েছিল। আনন্দমঠ-এর পর শর্ত চলচ্চিত্রের মতো কয়েকটা ফিল্মিস্তান চলচ্চিত্রে তিনি সুরসৃষ্টি করেছিলেন। একই সঙ্গে হেমন্ত মুম্বাইতে নেপথ্য গায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। অভিনেতা দেব আনন্দের জন্যে নেপথ্য গায়ক হিসেবে তাঁর গান শচীন দেব বর্মন সুরারোপিত জাল (“য়েহ রাত, য়েহ চাঁদনি ফির কাঁহা…”), হাউস নম্বর ৪৪ (“চুপ হ্যায় ধরতি, চুপ হ্যায় চাঁদ সিতারে…”), সোলবা সাল (“হ্যায় আপনা দিল তো আওয়ারা…”), ফান্টুস (“তেরি দুনিয়া মে জীনে সে…”), এবং বাত এক রাত কি (“না তুম হামে জানো…”) খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

চলচ্চিত্র প্রযোজনা: হেমন্ত ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের দশকের শেষদিকে নিজ মালিকানাধীন হেমন্ত-বেলা প্রোডাকশন্স নামের প্রতিষ্ঠান থেকে চলচ্চিত্র প্রযোজনা শুরু করেন। ওই ব্যানারে প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র ছিল  মৃণাল সেন পরিচালিত নীল আকাশের নীচে (১৯৫৯)। কাহিনি নেওয়া হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিকায় কলকাতার রাস্তার এক চিনা ফেরিওয়ালার পরিশ্রমের যন্ত্রণা থেকে। এই চলচ্চিত্র ভারত সরকার প্রদত্ত দেশের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র সম্মান রাষ্ট্রপতির স্বর্ণ পদক লাভ করেছিল। পরের দশকে হেমন্তের প্রযোজনা কোম্পানি নাম পরিবর্তন করে গীতাঞ্জলি প্রোডাকশন্স করা হয়।  এখান থেকে  হিন্দি চলচ্চিত্রের প্রযোজনা হতে থাকে। তন্মধ্যে বিশ সাল বদ, কোহরা, বিবি অওর মকান, ফরার, রাহগির এবং খামোশি  প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

এর পর বাংলায় ফেরা। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে হেমন্ত পলাতক চলচ্চিত্রের জন্যে সুর সৃষ্টি করেন, যেখানে তিনি পরীক্ষামূলকভাবে বাংলা লোক সংগীত এবং লঘু সংগীতের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। এটা একটা বড়ো সাফল্যের প্রমাণ দিয়েছিল এবং হেমন্তের সংগীত গ্রন্থনার ধরন ভবিষ্যতের চলচ্চিত্রগুলোতে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল, যেমন, বাঘিনি এবং বালিকা বধূ। বাংলা ছবিদ্বয় মণিহার এবং অদ্বিতীয়া সাংগীতিক এবং বাণিজ্যিক দিক থেকে বড়ো সাফল্য পেয়েছিল, তাঁর সংগীত গ্রন্থনায় লঘু ধ্রুপদী ছোঁয়া ছিল। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনে গ্রামোফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়া হেমন্তকে দিয়ে এক বড়ো অংশের স্মারক প্রস্তুত করেছিল। এটাও এক বড়ো সাফল্যের মুখ দেখেছিল। হেমন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভ্রমণ সমেত অনেক কনসার্টের জন্যে বহুবার বিদেশে গিয়েছিলেন। সর্বসাকুল্যে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের দশকে তিনি বাংলার প্রধান পুরুষ গায়ক হিসেবে নিজের জায়গা ধরে রেখেছিলেন এবং হিন্দি চলচ্চিত্রের সংগীতকার ও গায়ক হিসেবে পরিগণিত হয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য:  ১৯৬০-এর দশকে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতিনাট্যগুলোর  প্রধান পুরুষ কণ্ঠ ছিলেন। গীতিনাট্যগুলোর মধ্যে বাল্মিকী প্রতিভা, শ্যামা, শাপমোচন, চিত্রাঙ্গদা এবং চণ্ডালিকা প্রভৃতি অন্যতম। ওই গীতিনাট্যগুলোর প্রধান নারী কণ্ঠ হিসেবে থাকতেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯২৪-২০০০) এবং সুচিত্রা মিত্র (১৯২৪-২০১০)। তাঁদের বলা হতো ‘হেমন্ত-কণিকা-সুচিত্রা’ এবং সঙ্গে ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস। অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, সাগর সেন, সুমিত্রা সেন এবং ঋতু গুহ ছিলেন সেই সময়কার রবীন্দ্র সংগীতের অন্যান্য প্রধান শিল্পী।

চলচ্চিত্র পরিচালক:  ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে হেমন্ত তাঁর নিজের প্রযোজিত অনিন্দিতা চলচ্চিত্রে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এর মূল উপজীব্য ছিল দিনের শেষে ঘুমের দেশে… তার এই শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় রবীন্দ্র সংগীত। ওই একই বছরে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক কনরাড রুকসের ডাকে হেমন্ত হলিউডে গিয়েছিলেন। 

যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব:  যুক্তরাষ্ট্র সরকার হেমন্তকে মেরিল্যান্ড, বাল্টিমোরের নাগরিকত্ব দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়া প্রথম ভারতীয় গায়ক। 

হৃদরোগ:  ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে হৃদাঘাত হয়। ফলে তাঁর কণ্ঠস্বর ক্ষেপণের, বিশেষত তাঁর শ্বাস নিয়ন্ত্রণের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছিল। তিনি আশির দশকের গোড়ার দিকে ধারাবাহিকভাবে গান রেকর্ড করছিলেন, কিন্তু তাঁর পুরুষালি কণ্ঠে একটু স্বরের তফাত পড়ে। 

শেষ অ্যালবাম:  ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে হেমন্ত গ্রামোফোন কোম্পানি অব ইন্ডিয়া থেকে তাঁর শেষ অ্যালবাম প্রকাশ করেন। এটা ছিল চলচ্চিত্রের বাইরের গান নিয়ে প্রকাশিত একটা ৪৫ আরপিএম সমন্বিত সম্প্রসারিত রেকর্ড। পরবর্তী বছরগুলোতে হেমন্ত ছোটোখাটো কোম্পানিগুলো থেকে কিছু চলচ্চিত্রের বাইরের গান রেকর্ড করেছিলেন যারা উঠতি ক্যাসেটভিত্তিক সংগীত তৈরি শিল্পের সঙ্গে এঁটে উঠছিল। 

মানবধর্মী কর্মকাণ্ড:  তাঁর মানবধর্মী কার্যকলাপের মধ্যে অঙ্গীভূত ছিল পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় তাঁর নিজের গ্রমা বহড়ুতে তাঁর প্রয়াত পিতার স্মরণে একটা হোমিওপ্যাথিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা। জনকল্যাণে অর্থ সংগ্রহের জন্য নিয়মিত  আকাশবাণী, দূরদর্শন (টিভি) এবং চলন্ত অনুষ্ঠান/কনসার্টে সময় দিতেন।

পুরস্কার প্রত্যাখ্যান:  ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পদ্মভূষণ পুরস্কারের জন্যে মনোনীত হন। তবে তিনি তা বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। ইতঃপূর্বে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে  তিনি একইভাবে পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রত্যাখ্যান  করেছিলেন।

গণসংবর্ধণা: ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সংগীত জীবনের ৫০ বর্ষপূর্তিতে তাঁকে এক রাজকীয় গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়।  কিংবদন্তি সংগীত শিল্পী লতা মঙ্গেশকর তাঁকে স্মারক দিয়ে সংবর্ধনা জানান।

চলচ্চিত্রের শেষ গানেও পুরস্কার: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়  ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে ৬৯ বছর বয়সে লালন ফকির  চলচ্চিত্রে গান গেয়ে শ্রেষ্ঠ পুরুষ গায়কের সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন।

বাংলাদেশ সফর:  ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার গ্রহণ এবং একটি কনসার্টে সংগীত পরিবেশনের জন্য আয়োজক গোষ্ঠীর বিশেষ অনুরোধে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশ আসেন।  ওই সফরের অব্যবহিত পর ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি দ্বিতীয়  হৃদাঘাত পান  এবং দক্ষিণ কলকাতার একটি নার্সিং হোমে রাত ১১:১৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

বাংলা ছায়াছবি ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়:  হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রায় দেড়শোটি বাংলা ছবিতে সুর দিয়েছেন, গান গেয়েছেন। এখনো গ্রামোফোন কোম্পানি অব ইন্ডিয়া বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হওয়ায়  প্রত্যেক বছর অন্তত একটা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অ্যালবাম প্রকাশ করে থাকে। 

পুরস্কার: হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ভারত সরকার প্রদত্ত পদ্মভূষণ ও পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করলেও তিনি অনেকগুলো বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানক পুরস্কারে ভূষিত হন।তন্মধ্যে অন্যতম হলো:

  • ১৯৫৬: ফিল্মফেয়ার বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড: নাগিন
  • ১৯৭১: ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট মেল প্লেব্যাক সিঙ্গার: নিমন্ত্রণ
  • ১৯৮৬: ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট মেল প্লেব্যাক সিঙ্গার: লালন ফকির
  • ১৯৬২: বিএফজেএ বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড স্বরলিপি – বিজয়ী
  • ১৯৬৩: বিএফজেএ বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড (হিন্দি); বিস সাল বাদ – বিজয়ী
  • ১৯৬৪: বিএফজেএ বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড পলাতক – বিজয়ী
  • ১৯৬৭: বিএফজেএ বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড মণিহার – বিজয়ী
  • ১৯৬৮: বিএফজেএ বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড বালিকা বধূ – বিজয়ী
  • ১৯৭৫: বিএফজেএ বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড ফুলেশ্বরী – বিজয়ী
  • ১৯৮৬: বিএফজেএ বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড ভালোবাসা ভালোবসা – বিজয়ী
  • ১৯৮৭: বিএফজেএ বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড পথভোলা – বিজয়ী
  • ১৯৮৮: বিএফজেএ বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড আগমন – বিজয়ী
  • ১৯৭২: বিএফজেএ বেস্ট মেল প্লেব্যাক সিঙ্গার অ্যাওয়ার্ড ধন্যি মেয়ে – বিজয়ী
  • ১৯৭৫: বিএফজেএ বেস্ট মেল প্লেব্যাক সিঙ্গার অ্যাওয়ার্ড ফুলেশ্বরী – বিজয়ী
  • ১৯৭৬: বিএফজেএ বেস্ট মেল প্লেব্যাক সিঙ্গার অ্যাওয়ার্ড প্রিয় বান্ধবী – বিজয়ী
  • ১৯৮৫: বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সাম্মানিক ডি.লিট
  • ১৯৮৬: সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার
  • ১৯৮৯: মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার

কয়েকটি জনপ্রিয় গান:  হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া অসংখ্য গানের মধ্য থেকে জনপ্রিয় গান বেছে নেওয়া সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া সুঁই খোঁজার মতো জটিল। তবু আমার মতে তাঁর কয়েকটি জনপ্রিয় গান নিচে দেওয়া হলো।

  • অলিরও কথা শুনে বকুল হাসে
  • আয় খুকু আয়,আয় খুকু আয়
  • আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি,আর মুগ্ধ এ চোখে চেয়ে থেকেছি
  • আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম
  • আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
  • আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে
  • আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা,আর কতকাল আমি রব দিশাহারা
  • আমিও পথের মত হারিয়ে যাবো
  • এই পথ যদি না শেষ হয়
  • এই রাত তোমার আমার, ওই চাঁদ তোমার আমার…শুধু দুজনে
  • ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে
  • ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলোনা, ও বাতাস আঁখি মেলো না
  • কেন দূরে থাকো, শুধু আড়াল রাখো
  • কে যেন গো ডেকেছে আমায়
  • কোন এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায়
  • ছেলে বেলার গল্প শোনার দিনগুলো
  • জীবনপুরের পথিক রে ভাই 
  • পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব মাগো, বলো কবে শীতল হবো
  • বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও,মনের মাঝেতে চিরদিন তাকে ডেকে নিও
  • মাগো ভাবনা কেন
  • মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে
  • মেঘ কালো, আঁধার কালো, আর কলঙ্ক যে কালো
  • রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে
  • ইয়াদ কিয়া দিল নে কাহাঁ হো তুম
  • ইয়ে রাত ইয়ে চাঁদনী ফির কাহাঁ 
শুবাচ গ্রুপের লিংক: www.draminbd.com
——–

বিসিএস বাংলা : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর /১

বিসিএস বাংলা : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর/২

বিসিএস বাংলা : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর /৩

বিসিএস বাংলা : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর /৪

বিসিএস বাংলা : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর /৫

বিসিএস বাংলা : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর /৬

বিসিএস বাংলা : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর/৭

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়: আধুনিক বাংলা গানের বিস্ময়