ড. মোহাম্মদ আমীন
সংযোগ: https://draminbd.com/কাজল-কাজলা-কাজরি-রূপ-গন্ধ/


সংস্কৃত ‘কজ্জল’ শব্দ থেকে জন্মগ্রহণকারী ‘কাজল’ শব্দটি বাক্যে দুটি পদ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। প্রথমত বিশেষ্য এবং দ্বিতীয়ত বিশেষণ। ‘কাজল’ যখন বিশেষ্য তখন এর অর্থ কজ্জল, কাজল, অঞ্জন।‘কাজল’ যখন বিশেষণ, তখন এটি হয়ে যায় রং এবং তার অর্থ – কাজলের বর্ণবিশিষ্ট। রঙের নাম হোক বা বর্ণ হোক- শব্দটি ছেলে-মেয়ে উভয়ের নাম রাখায় ব্যবহৃত হয়। এজন্য ‘কাজল’কে ভাইয়া বা আপা দুটোই বলা যায়। রং কালো হলেও রমণীদের প্রসাধন হিসেবে কাজলের মহিমা সীমাহীন। কাজল রমণীরা সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করে। হয়তো তাই, কবি-সাহিত্যিক, রমণী-প্রেয়সী, ছেলেবুড়ো সবার কাছে কাজল খুব পছন্দের। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যে কাজল নিয়ে কবিতা লিখেননি- এমন কবি নেই, সাহিত্যিকও। তরুণ বন্দোপাধ্যায়ের উদাস করা ‘কাজল’ গানটি কে না শুনেছেন :
“কাজল নদীর জলে, ভরা ঢেউ ছলছলে
প্রদীপ ভাসাও কারে স্মরিয়া;
সোনার বরনি মেয়ে, বলো কার পথ চেয়ে
আঁখি দুটি উঠে জলে ভরিয়া।”
তবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কাজলে নয়, কাজল চোখেও সব রূপ খুঁজে পেয়েছেন। তাই তার চোখে, কাজল নয়, কাজলকালো চোখই রূপের বন্যা:
“ডাগর ডাগর চোখে কেন কাজল দিলে,
অমন ডাগর চোখে কেন কাজল দিলে
কালো ওই চোখটা থেকেও কাজল কালো কী”
‘কাজল’ ছাড়াও কাজল-প্রকৃতির একটি শব্দ ‘কাজরি’। শব্দটির সঙ্গে ‘কাজল’ শব্দের অর্থগত কোনো মিল নেই, তবে, শব্দটি বাংলা গানের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে। শব্দটির আভিধানিক অর্থ– বর্ষকালে গাওয়া হয় এমন গানের শ্রেণিবিশেষ। ‘কাজরি’ মূলত ভারতের উত্তর-প্রদেশ অঞ্চলের লোকসংগীত। বারানসি এবং মির্জাপুর অঞ্চলকে এ গানের আদি ও প্রধান কেন্দ্র বলা হয়। কাশীতে ‘লুলারক ছট’ নামক একটি পর্বে কাজরি গাওয়ার রীতি প্রচলিত আছে। নজরুলের সেই পাগল-পারা কাজরি গান শুনলে মন বর্ষা হয়ে যায় হরষে:
“দোলে ঝুলন দোলায়,
দোলে নওল কিশোর গিরিধারী হরষে।।
মৃদঙ্গ বাজেনভোচারী
মেঘে বারিধারা রুমু ঝুমু বরষে।।
নাচে ময়ুর নাচে কুরঙ্গ কাজরি
গাহে বন বিহঙ্গ যমুনা-জলে
বাজে জলতরঙ্গ শ্যামসুন্দর রূপ দরশে।।”
‘কাজলপাতা’ এবং ‘কাজললতা’ দুটি ভিন্নার্থবোধক বাংলা শব্দ। ‘কাজল’ শব্দের সঙ্গ ‘পাতা’ যুক্ত হয়ে গঠিত হয়েছে ‘কাজলপাতা’ এবং ‘লতা’ যুক্ত হয়ে গঠিত হয়েছে ‘কাজললতা’। কিন্তু পাতার সঙ্গে শব্দদুটোর আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। ‘কাজলপাতা’ শব্দের অর্থ এমন একটি পাত্র যা দিয়ে কাজল তৈরি করা হয়, বা কাজল তৈরির ধাতব পাত্রবিশেষ। ‘কাজললতা’ শব্দের অর্থও অভিন্ন। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, ‘কাজলতা’ শব্দের অর্থ কাজল তৈরি ধাতব আধার; এই ধাতব আধারে রেখে মেয়েরা কাজল তৈরি করে মুখে দেয়। কাজলের কারণে ‘কাজললতা’ও হয়ে গেছে কাজলের মতো খ্যাত। অমৃক সিং অরোরার গাওয়া এবং পুলক বন্দোপাধ্যায়ের লেখা গানের কাজললতা গানটি শুনলে ইচ্ছা হয়, কাজল তৈরির ধাতবপাত্রে কাজলের উপাদান হয়ে শুয়ে থাকি জীবনভর :
“রূপসী দোহাই তোমার,
তোমার ওই চোখের পাতায়
আমাকে কাজললতার কালি করো…”
অসমীয়া ভাষায় নির্মল প্রভার লেখা গানে এবং মান্নাদে-এর সুরে কাজললতা পেয়েছেন ভিন্ন মাত্রা। তিনি গেয়েছেন :
“কাজললতা তোমারে নাম শীতলতা নাই”
কাজল শব্দে আকার দিলে পাওয়া যায়, কাজলা। ব্যুৎপত্তিভেদে কাজলা শব্দটির তিনটি অর্থ দেখা যায়। ‘কাজলা’ যখন তদ্ভব এবং সংস্কৃত ‘কজ্জলাভ’ হতে উদ্ভূত, তখন এর অর্থ- কৃষ্ণবর্ণ, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা প্রভৃতি। এটি স্ত্রীলিঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যতীন্দ্র মোহন বাগচীর ‘কাজলা দিদি’ কবিতা ‘কাজলা’ শব্দকে আমার এতই প্রিয় করে তুলেছিল যে, স্কুলকালে, মামীর ‘কাজললতা’ থেকে কাজল চুরি করে মুখে মাখতেও দ্বিধা করিনি। আহ, কী মধুর কবিতা :
“বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?”
কাজলা যখন সংস্কৃত কাষ্ঠ থেকে আগত, তখন এর অর্থ – করাতিদের ব্যবহৃত ^ আকৃতির কাঠের গোঁজবিশেষ। এটি একটি যন্ত্র, অতএব, বিশেষ্য। কাঠমিস্ত্রিদের কাছে এটি দেখা যায়।‘কাজলা’ যখন সংস্কৃত ‘কজ্জল’ থেকে আগত, তখন এর অর্থ – কালো ইক্ষুবিশেষ। সাধারণভাবে এটি ‘কাজল আখ’ নামে পরিচিত।
কাজল শব্দের শেষে ই-কার দিলে হয়, ‘কাজলি’; তখন এটি কিন্তু কোনো স্ত্রীজ্ঞাপক শব্দ নয়; বেশ জনপ্রিয় মাছ। কাজল বা কাজললতার মতো রমণীর প্রসাধন না-হোক, অনুপম স্বাদের এই মাছটি রূপাবয়বে চর্বিহীন ষোড়ষীর চঞ্চল রূপে আমাদের নদর-উদর একাকার করে দেয় লালায় লালায়। আসলে, পানির উপরভাগে ঝাঁক বেঁধে চলে এমন চারজোড়া লম্বা স্পর্শীযুক্ত বাঁশের পাতাসদৃশ্য চ্যাপটা ও সরু আশহীন মিঠা-পানির বিশেষ প্রজাতির রুপোলি মাছকে কাজলি। এটি বাঁশপাতা মাছ বা বংশক নামেও পরিচিত। বাজারে গেলে কেনার সামর্থ থাকুক বা না থাকুক, কাজলি মাছ দেখলে অনুভূত স্বাদ ওই চিকন-চাকন মাছকে কেনার জন্য ইচ্ছাকে জীবিত কাজলির মতো চঞ্চলতায় প্রাণিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু, কাজলকালো মেয়ের মতো কাজলি মাছও সাধারণ্যের উপভোগের বাইরে থেকে যায়। হায়ের কপাল!
জানা অজানা অনেক মজার বিষয়: https://draminbd.com/?s=অজানা+অনেক+মজার+বিষয়
শুবাচ গ্রুপের সংযোগ: www.draminbd.com
শুবাচ যযাতি/পোস্ট সংযোগ: http://subachbd.com/
আমি শুবাচ থেকে বলছি
Total Page Visits: 671 - Today Page Visits: 3