ড. মোহাম্মদ আমীন
বাংলাভাষী মধুসূদন ভালো ইংরেজি জানতেন। তিনি ছিলেন ভালো বাংলা-জানা হাতেগোনা কয়েকজন বাঙালির অন্যতম। অল্প সময়ের মধ্যে বাংলায় সৃষ্টি করলেন কালজয়ী কিছু সাহিত্যকর্ম। ইংরেজদের শান-শওকত মধুসূদনকে লোভাতুর করে তুলে। তিনি অবহেলা করতে শুরু করেন মাকে, পিতাকে- সর্বোপরি মাতৃভাষাকে। মা বুঝালেন, বাবাও- লোভীর মন মানে না লোভ ছাড়া কিছু। লোভী মধুসূদন ইংরেজি ভাষার প্রেমে মত্ত হয়ে প্রথমে ছাড়লেন ধর্ম-জাত-কুল। কাকের পাছায় ময়ূরের পালক লাগানোর মতো শঠ অহমিকায় নামের আগে বসিয়ে দিলেন ‘মাইকেল’। বড়ো সাহিত্যিক হওয়ার জন্য, নামের জন্য, অর্থের জন্য সেজে গেলেন ইংরেজ। ঠিক, যেমন অধুনা কিছু কিছু লোক মাতৃভাষা বাংলাকে ইংরেজির তুল্যে অবজ্ঞার চোখে দেখে। তারপর–
হিন্দু মধু, মাইকেল হয়ে ইংরেজ হওয়ার জন্য ছাড়লেন স্বদেশ। ইংরেজিতে বইও লিখে ফেললেন। কয়েকজন ইংরেজ সাহিত্যিককে উপহার দিলেন। পড়ে, পরে মন্তব্য দিতে অনুরোধ করলেন।
ইংরেজরা বললেন, মাইকেল, তোমার লেখা অষ্টম ক্লাসের মানও উতরাতে পারেনি।
কেন?
তুমি বাংলাভাষী। নিজ মায়ের সেবা না-করে ইংরেজির সেবা শুরু করেছ। তোমার লেখা তোমার বিচারে ভালো হতে পারে, আমাদের বিচারে এগুলো ছাই-বালি; তুমি দেশে গিয়ে মাতৃভাষাচর্চা করো। মাতৃভাষার চেয়ে সেরা কোনো ভাষা হয় না।
মাইকেল বললেন, আমি ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যচর্চা করার জন্য ধর্ম ছাড়লাম, দেশ ছাড়লাম, নাম ছাড়লাম, মা ছাড়লাম, ভাষা ছাড়লাম; আর কী ছাড়তে হবে?
ইংরেজরা বললেন, পর-ধর্ম গ্রহণ করা খুব সহজ, কিন্তু পরভাষা গ্রহণ করা অত্যন্ত কঠিন। তোমার ইংরেজি ভাষায় লেখা বাক্যগুলো দিয়ে ‘বই’ হয়েছে, সাহিত্য হয়নি। কুলাঙ্গারের মতো মাতৃভাষারূপী মাকে ছেড়ে তুমি পরভাষার প্রেমে পড়েছ। তুমি লোভী, তুমি কুলাঙ্গার। মায়ের সঙ্গে প্রতারণা করেছ। এমন হীন চরিত্রের লোক দিয়ে আর যাই হোক, সৃজনশীল কিছু হয় না, হবে না।নিজ দেশে থেকেও তুমি ইংরেজি সাহিত্যের চর্চা করতে পারো। অনেকে করেছেন, করছেন। নিজের মাকে অবহেলা না-করেও, অন্যের মায়ের সেবা করা যায়। তুমি নিজের মাকে অবহেলা করে অন্যের মায়ের সেবা করতে এসেছে। আগে দেশ, তারপর বিদেশ।
মাইকেল বললেন, ইংরেজি শ্রেষ্ঠ ভাষা, সহজ এবং সমৃদ্ধ। আমি ইংরেজি চর্চা করে বিশ্বখ্যাত হতে চাই।
ইংরেজরা বললেন, যারা মাতৃভাষার চেয়ে পরভাষাকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, তারা কখনও ভালো মানুষ হতে পারে না। এমন লোককে আমরা আত্মপরিচয়হীন বলি। তোমাদের এমন চরিত্রের জন্য লর্ড ক্লাইভের সামান্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কাছে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়েছ।
মাইকেল উত্তর দিতে পারলেন না। যারা বর্তমানে ইংরেজিকে সহজ এবং মাতৃভাষা বাংলাকে কঠিন বলে গালি দেয়, তাদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি ইংরেজি জানতেন মাইকেল। তার মতো তুখোর ইংরেজি জানা লোক চেষ্টা করলেন ইংরেজ-সাহিত্যিক হতে। পারলেন না।ভেড়ার দলে ছাগল ঢুকতে পারে, মিশে যেতে পারে না। কিন্তু মাইকেল ছাগল হয়ে ভেড়ার দলে শুধু ঢুকতেই চাননি, মিশেও যেতে চেয়েছেন।
মাইকেল শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেন। বুঝলেন- মাতৃভাষার চেয়ে সহজ ভাষা আর নেই। তার মনে পড়ে গেল আবদুল হাকিমের কথা :
“যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।”
মাইকেল ইংরেজিকে মাতৃভাষা বাংলার চেয়ে সহজ আর শ্রেষ্ঠ ভাবতে গিয়ে জারজ হয়ে গেলেন। এখন যেমন অনেকে হয়ে যান। তারপর ধর্ম, দেশ এবং অবশেষে ভাষাত্যাগী মধুসূধন বুঝলেন তিনি শুধু জারজ নন, কুলাঙ্গারও। তিনি শুধু ধর্ম-দেশ আর ভাষা হারাননি, নিজকেও হারিয়ে ভিক্ষুকের চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে গেছেন। অতঃপর অনুশোচনায় দগ্ধ হলেন মাইকেল। ইংরেজদের ভর্ৎসনা, উপদেশ, গালি আর শ্লেষকে উপজীব্য করে লিখলেন :
“হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি।
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি; –
কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!
স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে –
“ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!”
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে।
অনেক শিক্ষিত লোক রোমান ভাষায় বাংলা লেখে। যারা মাতৃভাষাকে বিজাতীয় রোমান ভাষায় লেখে, তারা যেন নিজের মাকে ব্রিটিশ রমণীর পোশাক পরিয়ে হাইড পার্কে দৌড়ানোর স্বপ্ন দেখে।যত ইচ্ছে ভাষা শিখুন, যত ইচ্ছে দেশ ঘুরুন, কিন্তু মাতৃভাষাকে অবহেলা করে নয়। যারা মাতৃভাষাকে অন্য ভাষার চেয়ে কঠিন আর নিকৃষ্ট মনে করে, তারা যেন নিজের মাকে অসহ্য মনে করে। এমন চরিত্রের লোকদের বঙ্গবন্ধু বলেছেন, উচ্ছৃঙ্খল। বঙ্গবন্ধু ভাষায়, “মাতৃভাষার প্রতি যার ভালবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালবাসা আছে একথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দীর্ঘ তিন বৎসর অপেক্ষার পরও বাংলাদেশের বাঙ্গালী কর্মচারীরা ইংরেজী ভাষায় নথিতে লিখবেন সেটা অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরণের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছৃঙ্খলতা চলতে দেয়া যেতে পারে না।”