ঢাকা কালেক্টরের উইল : ঘোড়ার জন্য পেনশন স্ত্রীর জন্য টেনশন

ড. মোহাম্মদ আমীন
কেমন লাগল মিটফোর্ড হাসপাতাল?
সাধারণ।
এখন সাধারণ। প্রতিষ্ঠাকালে শুধু বাংলাদেশের নয়, পুরো ভারতবর্ষের অন্যতম আধুনিক হাসপাতাল ছিল। এটি বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক হাসপাতাল। এ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য রানি ভিক্টোরিয়ার (১৮১৯-১৯০১) নির্দেশে গভর্নর জেনারেল ডালহৌসি তিন জন প্রতিনিধি এবং এক ডজন কর্মকর্তা নিয়োগ করেছিলেন।
কিন্তু এত নোংরা কেন? নোংরামিও হয়; কয়েক দিন আগে এক ডাক্তার এক গরিব ডেঙ্গু রোগিকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন?
প্রশাসন নোংরা হলে প্রতিষ্ঠানও নোংরা হয়। মিটফোর্ড, নোংরামির জন্য নির্মিত হয়নি, ঢাকাবাসীর চিকিৎসার জন্য নির্মিত হয়েছে। বাঙালি ছাড়া স্বজাতিখোর কোনো গোষ্ঠী পৃথিবীতে নেই।
নাম মিটফোর্ড কেন? জানতে চাইল অনুসিন্থিয়া।
রবাট মিটফোর্ড-এর অর্থে প্রতিষ্ঠিত, তাই।
মিটফোর্ড কে?
এক ইংরেজ। তিনি ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের সর্ব-উত্তরের নর্দাম্বারল্যান্ড প্রদেশের মিটফোর্ড ক্যাসলের অভিজাত মিটফোর্ড পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জন মিটফোর্ড ছিলেন চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের দায়িত্বে নিয়োজিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। লন্ডনে লেখাপড়া শেষ করে রবার্ট মিটফোর্ড ১৭৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ১৬ বছর বয়সে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাইটার পদে চাকরি নিয়ে ভারত আসেন। তাঁকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেঙ্গল বেসামরিক প্রশাসনে যুক্ত করা হয়।সে থেকে ত্রিশ বছর তিনি বঙ্গদেশে ছিলেন।
রাইটার তো ছোটো চাকুরি।
এখন ছোটো, তখন ছোটো ছিল না। মেধা ও দক্ষতার মাধ্যমে এ পদ থেকে প্রশাসনের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হওয়া যেত। মিটফোর্ড, রাইটার থেকে কালেক্টর পদে উন্নীত হন। তিনি ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলায় কালেক্টর পদে যোগদান করেন।
ইংরেজ কালেক্টরগণ না কি খুব দুষ্ট ছিলেন?
না, দুষ্টদের জন্য দুষ্ট ছিলেন। মিটফোর্ড কালেক্টর পদে যোগদানের কয়েক বছরের মধ্যে ঢাকায় মহামারী আকারে ভয়াবহ কলেরা ছড়িয়ে পড়ে। একদিন তিনি ঢাকা শহর দেখার জন্য বের হলেন। রাস্তায় লাশ আর লাশ, কলেরায় মানুষ মরছে। সেসময় ঢাকায় দৈনিক গড়ে ১৭৫ জন মানুষ মারা যাচ্ছিল। মিটফোর্ড, জনগণের দুর্দশা দেখে মর্মাহত হন। পানীয় জলের চিকিৎসার জন্য রাত দিন পরিশ্রম করতে লাগলেন। বেতনের টাকা দিয়ে গভীর কূপ খননের উদ্যোগ নিলেন।
তারপর, তারপর কী হলো কাব্বি? মেয়ে জানতে চাইল।
মিটফোর্ড একটি হাসপাতাল গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। কালেক্টর হিসেবে তার সর্বপ্রচেষ্টা নিয়োগ করেও পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা পেলেন না। লন্ডন থেকে উত্তরাধিকা সূত্রে প্রাপ্ত অর্থ ব্যয়ে হাসপাতাল গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলেন, কিন্তু স্ত্রী এলিজাবেথের বিরোধিতার কারণে পারলেন না। বউ বললেন, “এমন করলে তোমাকে আমি ছেড়ে দেব, মামলা করব; স্বদেশি কুকুরদের জন্য এক পাউন্ডও তুমি খরচ করতে পারবে না। এরা এভাবে মরার জন্য জন্ম নিয়েছে।”   তিনি আবার সরকারের ঊর্ধ্বমহলে যোগাযোগ করলেন। ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর উদ্যোগ চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়ে গেল। ঢাকার মানুষ মরছে, তিনি কালেক্টর, কিছুই করতে পারছেন না। অনুশোচনায় তিনি দগ্ধ হচ্ছিলেন। মিটফোর্ড জেলা কালেক্টরের দায়িত্ব হতে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন।
তিনি কয় বছর ঢাকার কালেক্টর ছিলেন?
চার বছর।
এরপর?
কোম্পানির অধীনে বিচার বিভাগীয় পদে যোগ দেওয়ার আবেদন করেন। তাঁর আবেদন গৃহীত হলো। তিনি ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা প্রভিন্সিয়াল কোর্ট অব আপিল অ্যান্ড সার্কিট-এর দ্বিতীয় বিচারক নিযুক্ত হন। ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দের ২০ শে মে এ পদ থেকে অবসরে যান।
তারপর কী হলো?
মিটফোর্ড ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ইংল্যান্ডের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। ইংল্যান্ডে গিয়েও তিনি ঢাকাবাসীর দুর্দশার কথা ভুলতে পারছিলেন না। রাতে ঘুমোতে পারছেন না, ঢাকার কথা মনে পড়ে যাচ্ছি, মনে পড়ে যাচ্ছিল লাশের কথা, ঢাকাবাসীর দুর্দশার কথা। মুমূর্ষু মানুষের কষ্টের কথা; কী করা যায়? এতদিন চাকুরে ছিলেন বলে স্বউদ্যোগে কিছু করতে পারেননি। তিনি আইনজীবী মরফিন হ্যালন্ডের সঙ্গে আলাপ করলেন।
কী করতে চান আপনি? হ্যালন্ড জানতে চাইলেন।
আমার স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে সবাই স্বনির্ভর। আমার প্রচুর অর্থ, এক জনের জন্য এত অর্থের প্রয়োজন নেই। আমি চাই আমার সম্পদ ঢাকাবাসীর কল্যাণে ব্যয় করতে।
করে ফেলুন।
স্ত্রীপুত্র আর আত্মীয়স্বজন বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমি একটা খসড়া উইল করেছি। আপনি এটি রেজিস্ট্রি করে দিন। খুব গোপনে করতে হবে। আত্মীয়-স্বজন জানতে পারলে আমাকে আস্ত রাখবে না।
১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে মিটফোর্ট একটি উইল করলেন। উইলের নবম ধারায় বলা হয়, “উইলের অন্যান্য ধারায় বর্ণিত নির্দেশ পূরণ করার পর অবশিষ্ট যে সম্পত্তি ও অর্থ থাকবে তা থেকে তার ঘোড়াগুলোকে পেনশনভোগী হিসেবে লালন করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংরক্ষিত রেখে বাকি টাকা ঢাকা শহরে দাতব্য এবং জনকল্যাণমুখী কাজে ব্যয় করার জন্য প্রেরণ করতে হবে।”
উইলে কত টাকা দিয়েছিলেন ঢাকাকে? জানতে চাইল অনুসিন্থিয়া।
প্রায় ৮ লাখ টাকা। বর্তমানে আশি কোটির টাকার বেশি।
উইল করার পর মিটফোর্ডের মনটা হালকা হয়ে গেল। তিনি বেড়াতে গেলেন ফ্রান্সে। যাবার আগে আইনজীবী হ্যালন্ড বললেন, কিন্তু কীভাবে এবং কী কাজে খরচ হবে এত টাকা তা তো উইলে নেই। আমি এসে জানাব, “মিটফোর্ড বলেছিলেন।” কিন্তু মিটফোর্ড ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ২১ সেপ্টেম্বর প্যারিসে মারা গেলেন।
ইস!
মৃত্যুর পর উইল কার্যকর করতে গেলে বাধ সাধে মিটফোর্ডের আত্মীয়স্বজন। স্ত্রী এলিজাবেথ এবং তাঁর বান্ধবী ম্যারি আপোলিন উইলের বিরোধিতা করে মামলা করে দিলেন। বিভিন্ন আদালতে দীর্ঘ সময় ধরে মামলা চলল। বহু আত্মীয়স্বজন, ব্রিটিশ সরকার এবং ভারত সরকার মামলায় জড়িয়ে পড়ে।
অবশেষে ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডনের সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টের চান্সারি বিভাগ উইলের বৈধতার আংশিক স্বীকৃতি দিয়ে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে।
কী বলল আদালত?
১৭,৭৪৮ পাউন্ড ১২ শিলিং ৩ পেন্স বা তৎকালীন ১,৭৭,৪৮৬ টাকা ২ আনা ঢাকায় প্রেরণ করার নির্দেশ দেয়। এ টাকায় গড়ে উঠে ঢাকা তথা বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান মিডফোর্ড হাসপাতাল।
তিনি তো উইলে হাসপাতাল নির্মাণের কথা লিখেননি?
দানের অর্থ দিয়ে কি করা হবে সে সম্পর্কে মিটফোর্ডের কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশনা ছিল না। ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি মিটফোর্ডের অর্থ দিয়ে পূর্ববাংলার জনগণের জন্য ঢাকায় একটি আধুনিক পাশ্চাত্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। এটিও চূড়ান্ত করা হয় যে হাসপাতালটির নাম মিটফোর্ড-এর নামানুসারে ‘মিটফোর্ড হাসপাতাল’ রাখা হবে। মিটফোর্ড-এর অর্থে বর্তমান স্থানে ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে হাসপাতাল নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তখন এই স্থানটি ‘কাটরা পাকুড়তলী’, বাবুবাজার নামে পরিচিত ছিল। পূর্বে এই জায়গায় ওলন্দাজ কুঠি ছিল। ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মে মিটফোর্ড হাসপাতালটির কার্যক্রম শুরু হয়। তখন এতে পুরুষদের জন্য দুটি ও মহিলাদের জন্য একটি ওয়ার্ডসহ ৮২টি বেড ছিল।
সবগুলো টাকা পেলে কী হতো?
মিটফোর্ড পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল হতো।
বউয়োর জন্য তিনি উইলে কিছু রাখেননি?
রোখেছিলেন।
কী?
উইলের শেষ ধারা- ঘোড়ার জন্য পেনশন, স্ত্রী এলিজাবেথের জন্য টেনশন।
Total Page Visits: 305 - Today Page Visits: 2

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Language
error: Content is protected !!